রংধনু: গানে গানে রাঙাতে আসছে অটোয়া - সুপ্তা বড়ুয়া
কথিত আছে অটোয়া শহরে প্রায় ১০ হাজার বাঙালির বসবাস। আবার অনেকের অভিযোগ, এ শহরে তেমন কিছুই হয় না। আদতে কোনটাই হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। এখানে অতিমারী পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালিদের মিলনমেলায় মুখরিত থাকতো। প্রতি সপ্তাহান্তে অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়ে যেতো। একটু এদিক ওদিক যারা খোঁজ রাখে তারা সহজেই প্রতি সপ্তাহান্তে কোন না কোন অনুষ্ঠানে সবার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে যেতো। যেন একটা ছোট্ট ছিমছাম মফস্বলে, যেখানে সবাই সবাইকে চেনে। অতিমারী পরবর্তী অটোয়ার বাঙালি সমাজ যেন একটু আন্তে আস্তেই জাগছে, নানামুখী নিয়ন্ত্রণের বেড়া টপকে অতটা স্বাগ্রহে যেমন তেমন কেউ কোন অনুষ্ঠান করতে এগিয়ে আসছিলো না, তেমনি গত বছর কিছু অনুষ্ঠান হলেও পুরোদমে অংশগ্রহণ হচ্ছিলো না সকলের। এবছর বোধয় আবার পুরোদমে নিজেদের চেনা রুপে ফিরতে চাইছে অটোয়াস্থ বাঙালী সমাজ। এসব কিছু মাথায় রেখেই এবছর অটোয়ায় নিজেদের রং ছড়াতে আসছে 'রংধনু'। হঠাৎ কিছু গান পাগল বাঙালী কিভাবে কিভাবে যেন একত্রিত হয়ে গেলো, তৈরি করে ফেললো ৭ জন সদস্য নিয়ে 'রংধনু' নামে একটি ব্যান্ড দল।
এই ১০ হাজার বাঙালির পদচারণে মুখরিত অটোয়ায় হঠাৎ করে সাংসারিক মানুষেরা জীবনের হাজারো কর্মব্যস্ততা আর দায়িত্বের মাঝে ব্যান্ড দল 'রংধনু' গঠন করে ফেলবে চারমাস আগে সে কি আমরাই বুঝতে পারছিলাম! আমাদের শত দ্বৈমত, অমিল, মতামতকে এক পাশে ফেলে, আমরা কেবল গানের জন্য যেন হয়ে গেলাম একাত্ম। রংধনু সাতটি রং যেমন ভিন্ন আবার একসাথেই তারাই যেমন একক এবং অভিন্ন, তেমনি আমরাও। ব্যান্ডের বর্তমান লাইন আপ কিবোর্ড, গিটার এবং ভোকালে অত্যন্ত গুণী আরেফিন কবির, ড্রামসে নিপুণহাতে ঝড় তোলা সাঈদ ইসলাম (খোকন), লিড গিটার এবং ভোকালে অসাধারণ গুণী প্রখ্যাত শাহ আলম (শুভ), অটোয়ার নতুন প্রতিভা বেইস গিটারে ঝড় তুলতে দূর্জয় বড়ুয়া তৈরি। ভোকালে লাইন আপ কানাডার জনপ্রিয় পরিচিত কণ্ঠশিল্পী আরেফিন খান, অটোয়ার সুখ্যাত গায়ক মীর জাবেদ এলাহী (জুয়েল) এবং সুপ্তা বড়ুয়া।
এই ব্যান্ডটির প্রাথমিক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাঈদ ইসলাম (খোকন) এবং টিটু কিবরিয়া। টিটু কিবরিয়া গানের অত্যন্ত অনুরাগী, এবং বলতে গেলে এই ব্যান্ড দলটির স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে তার নিষ্ঠা আর আগ্রহই যেন সবার চেয়ে বেশি। সাঈদ ইসলাম (খোকন) ভাইয়ের তেমন অক্লান্ত পরিকল্পনা, দৃঢ়তা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় 'রংধনু' যেন মেলে ধরলো তার রং। সংগীত পরিচালনা এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সৃষ্টিশীল আরেফিন কবির, যার মতো গুণী মানুষ খুব কমই রয়েছেন অটোয়ায়। ২০১৯ সালে যদিও তখন ব্যান্ডের কোন নাম তৈরি হয় নি, তথাপি সাঈদ ইসলাম, শাহ আলম (শুভ), আরেফিন খান মিলে অটোয়ায় কিছু অনুষ্ঠান করে বেশ সাড়া ফেলেছিলো। অতিমারীর ঠিক আগে আগে আরেফিন কবির এই তিনজনকে নিয়ে আরো কিছু অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যেগুলো অতিমারীর ভয়াবহতায় পন্ড হয়ে যায়। তারপর তো সেই ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতেই কেটে যায় অনেক বছর, যার জন্য সবাইকে একত্রিত করাই যেন একটা বিরাট কাজ হয়ে দাঁড়ালো।
জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারীর হাড় কাঁপানো শীতের দিনগুলো কিভাবে কিভাবে যে এবছর চট জলদি চলে গেলো, 'রংধনু'র সাথে নিয়মিত প্র্যাকটিসের হট্টগোলে। যদিও সাঈদ ইসলাম (খোকন) দেশে থাকার কারণে যেন একটু ছন্দপতন হচ্ছিলো। যেই না তিনি দেশ থেকে ফিরলেন যেন একদম শীতের শেষে বসন্তের মতো আমাদের প্র্যাকটিসও যেন প্রাণ ফিরে পেলো, শুরু হয়ে গেলো একেবারে ধুন্ধুমার মাতোয়ারা কান্ড। চাকরি ছুটি শেষে আমরা সকলেই হাজির, কেউ পরীক্ষা শেষ করে হাজির, রোজা রেখে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়েও যেন ক্লান্তি নেই নিজেদেরকে ঝালিয়ে নেওয়ার। আহা, গানের জন্য, নিজেদের গানের জন্য এই সুদূর প্রবাসে নানামুখী কথা রেখেও সবার যেন একটাই স্বপ্ন, ব্যান্ড দল রংধনুকে ঘিরে, রংধনু অটোয়ায় রং ছড়াবে সবার মাঝে। 'রংধনু'র সার্বিক ব্যবস্থাপনা আর পরিচালনায় রয়েছেন টিটু কিবরিয়া, জুলফিকার রহমান, আনোয়ার হোসেন, সাঈদ ইসলাম এবং মীর জাবেদ এলাহী।
আমরা যারা প্রবাসী, তারা বেশিরভাগই ৯-৫ চাকরি আর সংসার নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু গান যেন আমাদের এই প্রবাসে একটু স্বস্তির স্থান, আশার স্থান। তদুপরি এই গান হয়তো আমাদের শেকড়ের সাথে বন্ধন অটুট রাখার কিংবা কানাডায় বেড়ে ওটা নতুন প্রজন্মের সাথে আমাদের সংস্কৃতির যোগসূত্র। তবে চমকপ্রদ বিষয় হলো নিজেদের মনকে শান্তি করতে কিংবা বন্ধন তৈরি করতে গান নিয়ে স্বপ্নীল কিছু মানুষ একেবারে ব্যান্ড দল গঠন করে ফেলবে, এই বয়সে একটু ছেলেমানুষিই মনে হবে অনেকের কাছে। কারণ আমরা দৈনন্দিন জীবনে এত হিসেব কষতে ব্যস্ত, যে কোন কিছুতে আমাদের প্রাপ্তি যোগ কি, সেটাই যেন আমাদের সকলের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেজন্য এই ব্যান্ড, রংধনু, আমাদের একটা স্বস্তির স্থান, আস্থার জায়গা যেখানে আমরা নিজেদের মনের খোরাক জোগাতে পারবো পাশাপাশি সকলের মাঝে রং ছড়াতে পারবো। আমরা যারা সংসারের ঘেরাটোপে আটকে গেছি, নিজেদের ভালো রাখার কথা যখন চিন্তা করি, তখন আমাদের 'শ্যাম রাখি না কূল রাখি' অবস্থা। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই সংসারেই নিজেকে যদি পুরোদমে নিয়োগ করতে চাই, তাহলে নিজেদের ভালো থাকাও অতীব জরুরী। বলতে গেলে এটা নিজেদেরকে ভালো রাখার একটা প্রয়াস, রংধনু। পাশাপাশি এ ছোট্ট অটোয়া শহরেও যে এমন গান পাগল কিছু মানুষ আছেন, নিজেদের সংস্কৃতিকে আলাদাভাবে জানান দেওয়ানোর জন্য, অস্তিত্বকে প্রকাশ করার জন্যও যে কিছু মানুষ অন্তত চেষ্টাটুকু করতে পারে, তা এই ব্যান্ড দলকে দিয়েই যেন আমরা প্রকাশ করতে চাই। রংধনু'র এই বন্ধনের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার, ভালোবাসা কিংবা পাগলামি'র কিয়দংশও যদি সকলে মিলে সফল করতে পারি তাতে বরং আমরাই সমৃদ্ধ হবো। 'রংধনু' ৬ মে, ২০২৩ শনিবার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে আটোয়াবাসীর সামনে। আশা করি সকলে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে এই প্রয়াসকে সফল করে তুলবেন এবং আপনাদের শুভকামনায় আমাদের অনুপ্রাণিত করবেন।
সুপ্তা বড়ুয়া
অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
16-04-2023
-
-