সুখ দুঃখ - সুফিয়া ফারজানা
আজ অনেক দিন পরে খুব একা একা লাগছে সাদিয়ার। মেয়ে মুনিয়াকে নিয়ে এত বড় ফ্ল্যাটে সে একা। শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে ছোট ছেলের কাছে চলে গেছেন গত পরশু। ফয়সাল গিয়েছে মাকে রেখে আসতে। এবার প্রায় তিন মাস বড় ছেলের কাছে ঢাকায় ছিলেন শাশুড়ি। এই তিন মাস কেমন ছিলেন তিনি? সাদিয়া ঠিক জানে না। খুব ভালো ছিলেন না, এটুকু বুঝতে পারে। আর সাদিয়া?? না, সাদিয়া ভালো ছিল না। সাদিয়ার শ্বশুর মারা গিয়েছেন তাদের বিয়ের আগেই। শ্বশুরকে দেখেনি সাদিয়া। আর সাদিয়ার বাবা - মা কেউই নেই। সে বড় ভাইয়ের সংসারে মানুষ। বিয়ের পর দশ বছরে সাদিয়া বহুবার চেয়েছে, তার অকালমৃত মায়ের অভাব শাশুড়িকে দিয়ে পূরণ করতে। শাশুড়ি তো পর নন, তিনি ফয়সালের মা। আর ফয়সাল তো সাদিয়ার অস্তিত্বের অংশ। তাহলে তার মা কেন সাদিয়ারও মা হবেন না? কিন্তু সেটা হয় না। তাই সাদিয়ার বেলাতেও হয়নি।
গত সোমবারের কথাই ধরা যাক। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বেশ বড়সড় একটা রুই মাছ এনেছিল ফয়সাল। সাথে বেগুন, আলু, আরও কিছু সবজি। সাদিয়া জানতো, শাশুড়ি রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট ভালবাসেন। সেই রাতে অনেকটা সময় ইলেকট্রিসিটি ছিল না। প্রচন্ড গরমে ঘেমে, ভিজে মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট রান্না করলো সাদিয়া, সাথে রুই মাছ ভুনা আর বেগুন দিয়ে মাছের তেল। সব আইটেমই শাশুড়ির পছন্দ, সাদিয়া জানতো। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে ভাত বেড়ে দিলো সাদিয়া। ফয়সাল মাকে খেতে ডাকলো। কিন্তু শাশুড়ি বিছানা থেকে উঠে রুমের লাইটটা অফ করে আবার বিছানায় শুয়ে পরলেন। বললেন, তার মাথা ধরেছে। তাই রাতে কিছুই খাবেন না। ফয়সাল তবু মাকে অনেক জোর করলো একটু খাওয়ার জন্য। না, তিনি খাবেনই না। খেলেনও না রাতে কিছুই। ফয়সাল আর কিছু বললো না। সে অবশ্য বেশ তৃপ্তি করেই খেলো। বললো, "রান্না অনেক মজা হয়েছে, সাদিয়া। তুমি খেয়ে নাও।"
কিন্তু সাদিয়াও আর তেমন কিছু খেতে পারলো না কেন জানি। মেয়ে মুনিয়াকে ভাত মেখে খাইয়ে দিলো। তার সাথে নিজেও দুই এক লোকমা খেল সাদিয়া। তারপর ডাইনিং, রান্নাঘর পরিস্কার করে সব গুছিয়ে শুয়ে পরলো। এরকম আগেও হয়েছে, প্রায়ই হয়। শাশুড়ি যে আসলে কি চান, কোনটাতে খুশি, আজও বুঝতে পারে না সাদিয়া। তবু চেষ্টা করে সে। তার আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি নেই।
শ্বশুর বাড়ির লোক মানেই পর, এরকম গতানুগতিক ভাবনায় কখনও বিশ্বাস ছিল না উচ্চ শিক্ষিত, প্রগতিশীল সাদিয়ার। কিন্তু আজকাল সে বিভ্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে কি অধিকাংশ মানুষ যা বলে, সেটাই সত্যি? শ্বশুর বাড়ি মেয়েদের আপন হয় না কখনও? সাদিয়ার শাশুড়ি হয়ত মানুষ খারাপ নন। কিন্তু তিনি হাসতে জানেন না। তার মুখে হাসি খুবই কম দেখেছে সাদিয়া। কাজের কথা ছাড়া জগতে আরও কথা আছে, কথা বলার বিষয় আছে, এটা যেন জানেনই না তিনি। সাদিয়া কাজ না করে শুয়ে বসে থাকলে তিনি রেগে যান, আবার কাজ করতে গেলেও অনবরত কাজের ভুল ধরেন। কতদিন রান্না ভালো হয়নি বলে সাদিয়ার রান্না তরকারিতে পানি দিয়ে উঠে গেছেন তিনি! অত্যন্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের, বৈষয়িক এই মানুষটির স্বভাব পুরোপুরি সাদিয়ার বিপরীত। পছন্দ অপছন্দ, ভাল লাগা, মন্দ লাগায় মিল না থাকলে আসলে মানিয়ে চলা একটু কঠিন হয়ে যায়। সাদিয়া গান শুনতে ভালবাসে, বই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার ঘর গুছাতে, রান্না করতেও খুব ভালো লাগে সাদিয়ার।
ফাঁকা বাসায় মনটা খুবই খারাপ লাগছে আজ কেন জানি। পরশু যাওয়ার পরে শাশুড়ি ফোন দেননি একবারও। সেটাই স্বাভাবিক, সাদিয়া জানে। কিন্তু ফয়সাল? সেও কথা বলেছে মাত্র দুই একবার। এত বড় একটা বাসায় ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে কেমন আছে সাদিয়া, একবারও জানতে চায়নি ফয়সাল। মানুষ এমন কেন? সাদিয়া বুঝতেই পারেনি আজও, তার আসলে কি অপরাধ।
মুনিয়াকে জোর করে হরলিক্স খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎ কেন জানি কান্না আসে সাদিয়ার। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সাদিয়ার হোয়াটসঅ্যাপে লাভ রিয়াক্ট আসে একটা। নিচে ফয়সালের মেসেজ, "মিস ইউ, সাদিয়া। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরছি।"
হঠাৎ মনের মেঘ কেটে গিয়ে এক ফালি সূর্য উঁকি দিলো যেন। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো সাদিয়ার। ফয়সাল চার দিন ছুটি নিয়ে গিয়েছে। তার ফেরার কথা আগামী পরশু। আজ রাতের ট্রেনে আসবে মানে? এবার আনন্দে চোখে পানি এসে যায় সাদিয়ার। ঠিক সেই মুহূর্তে পাঁচ বছরের মুনিয়া বলে উঠে, "মা, তোমার কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন, মা? বাবার জন্য মন খারাপ?"
সাদিয়া কিছু না বলে একটু হেসে মুনিয়াকে কোলে তুলে নেয়। জীবন আসলেই সুন্দর।
সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
03-05-2023
-
-