অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
প্রতীক্ষা... - ফাহমিদা রিআ

কাগজে কলমে হিসেব করলে পাক্কা সতেরো বছর।
এত বছর বয়স পর্যন্ত সুপ্তিতো জানতোই না যে তার মা বেঁচে আছে।
জ্ঞান হওয়া অবধি সে দেখেছে তাদের বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটায় দাদীর সাথে তার বসবাস। পাশে আরও দুটো রুম। একটায় বাবা এবং মা আর অন্যটায় রাশেদ থাকে। রাশেদ ওর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটো। সুপ্তির বয়স যখন তিন বছর তখন   ওর বাবা নতুন মা নিয়ে আসেন।  তারপর একটু বড় হয়ে সুপ্তি  সবে বাড়ির লাগোয়া প্রাইমারী স্কুলে  কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া শুরু করেছে, তখন রাশেদের জন্ম। এসব কিছুই সুপ্তি দাদীর কাছে শুনেছে। ওর মনে পড়ে না কিছুই। শুধু জানে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশিরা তার অবুঝ মনটাকে বারবার প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতো বিরামহীন। সৎমা খেতে দেয় কিনা, চড় থাপড় মারে কিনা, চোখ রাঙিয়ে ভয়  দেখায় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। 
সুপ্তি বুদ্ধি হবার পর থেকে এসবের কোন জবাব দেয় না আর। কারন সে জানে, মায়ের বিকল্প মাই।
গর্ভধারিনী মায়ের সাথে অন্যকে মিলাতে যাওয়াতো বোকামি। 
দাদী প্রায়ই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সুপ্তি লেখাপড়া শিখে বড় হ'সোনা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নাহলে পরের ঘরে গিয়েও শান্তি নেই। খাওয়ার খোঁটা, কাজের খোঁটা চলতেই থাকবে।
তোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো না দেখে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না। 
কিছুদিন থেকে দাদীর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না । বাবা মোড়ের ডাক্তার চাচার কাছে থেকে বারবারই ওষুধ যোগ করছিলেন বেলায় বেলায়।
দাদী শুকনো মুখে  শুধু বলছিলেন, অত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেইরে। সময় হয়ে গেলে ধরে রাখা যায় না।

হঠাৎ সেদিন দুপুরে খাবার পর সুপ্তিকে কাছে ডাকলেন।শিয়রে বসিয়ে হাতটা টেনে নিয়ে বললেন,
--সুপ্তি, তোর কি মায়ের কথা মনে আছে?
--একটুও না। মাতো একটা দুধের বাচ্চাকে রেখেই মরে গেলো। অতটুকুন বয়সের কথা কি মনে থাকার কথা?
--তোর মা মরে যায় নি সুপ্তি। খুঁজলেই পাবি। এটা বলবার জন্য  অনেকদিন থেকে অপেক্ষায় আছি যে। আমি মরে গেলে সত্যটা জানাই হবে না তোর। তুই যে আমার অনেক ভালোবাসার।  তোর সাথে প্রতারণা মানে আমার ভালোবাসাকে ঠকানো। 
তোর  আরও বড় হওয়া পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলাম।   শরীরের যা অবস্হা এরপরে আর সময় নাও পেতে পারি। তাই...

সুপ্তি দাদীর হাতটা ধরে টের পেলো এতক্ষণে, অস্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন দাদীর হাতে। থিরথিরে কাঁপন যেন।  কি জানি দাদী স্বাভাবিক আছেন তো?
দাদীর কপালে হাত রাখে সুপ্তি। নাহ্ জ্বর নেইতো। 

তারপর সুপ্তি যা শুনলো নিজেকে সম্পুর্ন অচেনা এক পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। চোখের তারায় সতেরো বছর আগের অদেখা  দিনগুলো যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো দাদীর স্মৃতিচারণে। 

সুপ্তির বাবা আরিফ তখন সদ্য চাকরীতে জয়েন করেছেন, নিজ বাসভুম  থেকে অনেক দূরের পাহাড়ী অঞ্চলে। বিধবা মার কাছে শাসনবিহীন মানুষ হওয়া আরিফ ছোট থেকেই ছিলো একগুঁয়ে আর একরোখা। যখন যা মনে হয়েছে নিজের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
মার একার সংসারের ঘানি টানা থেকে মাকে হাল্কা করতে দূরত্বটাকে কঠিন মনে না করে দূর প্রান্তের চাকরীর পোস্টিংটাকে লুফে নিয়েছিল আরিফ।
মাসান্তে মাকে টাকা পাঠানো, চিঠিতে কুশল বিনিময়, এভাবে নির্বিঘ্নে দুটো বছর যেতে না  যেতে বাঁধালো গোল। বলা নেই, কওয়া নেই আরিফ রাতের গভীরে একদিন হাজির হলো পলাতক দৃষ্টির ভাঙ্গাচোরা চেহারা নিয়ে। সংগে টোপা গালের  ফুলো ফুলো চোখের মাখনের মত মোলায়েম রঙের এক পাহাড়ী কন্যা।  যেন মোমের পুতুল।

আর এই পুতুলটিকে বিয়ে করে পালিয়ে আসা ছাড়া আরিফের গত্যন্তর ছিলো না। ওদের গোত্রের কেউ এটা মেনেতো নিবেই না, উপরন্তু হাতের কাছে পেলে একেবারে প্রাণনাশ করে ছাড়বে।
পুতুল কন্যটির ভালোবাসায় এমনই ডুবে গিয়েছিল আরিফ যে, ওকে পাওয়াটাই একমাত্র লক্ষ্য ছিলো।
মা  কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ধীরে ধীরে আশাহত হতে লাগলো আরিফ এবং বৌ উভয়েই। অন্য সংস্কৃতি, অন্য ভাষা, অর্থনৈতিক সংকটে হাঁপিয়ে ওঠতে লাগলো দুজনেই।

ধীরে ধীরে বৌটি মনমারা হতে থাকলো দিনের পর দিন। তারও আশা ভঙ্গের করুণ পরিণতি হয়েছিলো এই মফস্বলের সাদাসিধে সংসারটায় এসে। 

বছর ঘুরতে না ঘুরতে কোল জুড়ে সন্তান এলো। আর্থিক টানাপোড়েনে আরিফ ছুটোছুটি করতে লাগলো এক কাজ থেকে আরেক কাজে অন্য শহরে। সপ্তাহান্তে বাড়িতে এসে  বৌয়ের বিরূপ শীতল মনোভাবে সময় ক্ষেপন করে নিজেদের অজান্তেই  দূরে সরতে লাগলো  ক্রমশই। সন্তান জন্মদানের লম্বা সময়টায় স্বাভাবিক খাবার ওষুধের  অপর্যাপ্ততায় আর মানসিক চাপে  ক্লান্ত হতে হতে অসুস্হ হয়ে পড়লো বৌ।  শাশুড়ি সেবা শশ্রুষার দায় কাঁধে নিয়ে  হাঁপিয়ে ওঠলেন কদিনেই।   
ফলশ্রুতিতে উপায় খুঁজলেন।  আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি রফাটা হলো বৌ শাশুড়ির একান্ত চেষ্টায়। বৌমা নিজের বাবার নাম ঠিকানা শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললো,  আমি এভাবে নীরবে শেষ হবো না মা।আমার বাবার অঢেল  সম্পত্তির একমাত্র উত্তরসুরী আমি। বিনা চিকিৎসায় মরে গিয়ে আমার সন্তানকে মা হারা করার চেয়ে বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে  অধিকার আদায়টাই জরুরী। আরিফ জানলে বাধ দিবে, আমার বাবাও হয়তো আটকে রাখতে চাইবে। কিন্তু সন্তানের টানে আমি ফিরতে পারবোই যেভাবেই হোক।ততদিন সুপ্তিকে কাছ ছাড়া করবেন মা, আগলে রাখবেন।
এই ঘটনাগুলো এত দ্রুত একের পর এক ঘটে যেতে লাগলো যে আরিফ সপ্তাহান্তে এসে নিরব শ্রোতা হয়ে শুধু শুনলো। 
ওদের তাচ্ছিল্য আর অহংকারী মনোভাব সম্পর্কে আরিফ আগেই জানতো তাই  কিছু একটা আঁচ করে নিতে অসুবিধা হলো না। তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ করলে সরাসরি হুমকি এলো, এই পর্ব ভুলে যেতে। কষ্টের সংসারে তাদের কন্যাকে আর ফিরতে দিবেন না তারা।  নিজেদের পাহাড়ি এলাকাতেই আবার সংসারী হবার তোড়জোড় চলছে, এও জানালেন। এ অবস্হায় কোন রকম আবেগকে  প্রশয়তো দিবেই না,  আরিফকে পেলে ফলাফল হবে ভয়াবহ।

সব শুনে বিধবা মা তাঁর একমাত্র সন্তানকে ওদের রোষানল থেকে মুক্ত করতে আরিফকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিন কয়েকের মধ্যে বিয়ে দিলেন দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ার সাথে। 

আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশিরা জানলো চিকিৎসাধীন অবস্হায় মারা গেছে  পুতুল বৌটি পিতৃগৃহেই।

কিন্তু সতেরো বছর আগের সেই স্বল্পকালীন পর্বটা  মুছে ফেলাটা অতটা সহজ ছিল না বলেই আজ সেই রেশ ধরে সুপ্তি হাজির হয়েছে। 

দাদীর মুখ নিঃসৃত ঠিকানায় দুর্গম এলাকায়, সে সময়ের  নাম করা ব্যক্তির নাম আর স্হানের নামের উপর আস্হা রেখে  অনেক  কাঠ খড়  পুড়িয়ে সুপ্তি পৌঁছুলো বটে, ভেবেছিলো  ব্যস্ত হাতে সংসার আর এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের মাঝে ঠিক চিনে নিবে তার পুতুল সদৃশ্য মাকে। কিন্তু এমন দৃশ্যের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। 
অশীতিপর বৃদ্ধ  কাঁপা হাতে জড়িয়ে ধরলেন সুপ্তিকে। একসময়ের রাশভারী ভীষন দেমাগি অহংকারী লোকটির দুচোখে গড়িয়ে পড়া অশ্রু দেখে সুপ্তির বুক কেঁপে ওঠলো। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে যা বললেন তার অর্থ বুঝে সুপ্তির এত চেষ্টা আর আগ্রহ গুলো মিইয়ে গেলো মুহুর্তে। 
উনি মেয়ের অসম্মতিতেই  বিয়ে দেয়ার দুদিনের মাথায় সেই যে ফিরে এলেন আর ও মুখো হননি।  ধীর স্হির অনড় অচল হয়ে যেতে থাকলেন একটু একটু করে। ডাক্তার বললেন, মেন্টালি শকড্। জোর করে কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। হয়তোবা  আপন মনেই স্বাভাবিকতায় ফিরে আসবেন একদিন।

সেই প্রতীক্ষা নিয়ে দিন গুনছেন বৃদ্ধ আজ সতেরোটা বছর।  

বৃদ্ধকে অনুসরন করে এগিয়ে গেলো সুপ্তি কয়েকটা সিঁড়ি ডিঙিয়ে কাঠের তৈরি চমৎকার ঘরটায়। শিকের গরাদে দু হাত রেখে জানালায় দৃষ্টি ছুঁড়ে চেয়ে আছেন এক মহিলা। পিঠ ছড়ানো কাঁচা পাকা হাল্কা হয়ে যাওয়া চুলের গোছা।
বৃদ্ধ আঙুল নির্দেশ করে বললেন,
--সুপ্তি, ঐ আমার মেয়ে। তোমার মা।

সুপ্তির কি যেন হয়ে গেলো হঠাৎ।  অচেনার সব পর্দা সরে গিয়ে গলা চিরে বেরিয়ে এলো তীব্র চিৎকার 
--মা আ আ আ আ আ আ আ.........
ফিরে তাকালেন মা। খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
--এসেছিস?

ফাহমিদা রিআ
ঢাকা, বাংলাদেশ