অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
আমার রবীন্দ্রনাথ - সুলতানা শিরীন সাজি

জ সোমবার (৮ মে,২০২৩) ২৫ শে বৈশাখ, ১৪৩০ সাল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মদিন।  ১৮৬১ ইংরেজী সালের এই দিনে এবং ১২৬৮ বাংলা সনের ২৫ বৈশাখ, কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক ধর্ণাঢ্য  ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি গুরু।

ছেলেবেলা থেকে বড়বোনের গাইতে শোনা গান"ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু"র সুর এমনভাবে কানের মধ্যে আর বুকের মধ্যে বাসা বাঁধলো।  আমি নাকি তখন ভালো করে কথা বলতে শিখি নাই। অথচ গাইতাম সেই গান। ছোটবেলায় যখন গান গাওয়া শুরু হলো। লালমনিরহাট এর চাঁদের হাঁটের গোকুলদা বলেছিলেন ,"কখনো রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া কিছু গাইবিনা।" কেনো যেনো অন্য গান আর গাওয়ার চেষ্টাও করিনি। 
আব্বা মাঝে মাঝে বলতেন মা ওই গানটা শোনাও তো, "আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়"। আমি বলতাম," আব্বা আমি রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া কিছু গাইতে পারিনা "। আব্বা তখন বলতেন," ঠিক আছে তাই শোনাও"। শোনাতাম,"আরো আরো, প্রভু, আরো আরো, এমনি ক'রে আমায় মারো, "এই উদাসী হাওয়া পঠে পথে মুকুল গুলি ঝরে", " আমার ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন", ছিন্ন পাতায় সাজাই তরণী একা একা করি খেলা", "হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি, উথলে নয়নবারি", "জোনাকী কি সুখে ওই ডানা দু'টি মেলেছ", "সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে"। এইসব গান বেশির ভাগ ক্যাসেট শুনতে শুনতে শেখা। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর অথবা রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তীতে তাজুল ভাই, গোকুল দাও নতুন নতুন গান শেখাতেন। 

আমাদের ছোটবেলায় স্কুল, পড়ালেখার পর অবসর মানে তো শুধু গানশোনা আর বই পড়া। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে মনের আনন্দে গান গাওয়া। সেইসব সময়ে আমি আমাদের উপর তলায় থাকা লতা আপা, কখনো আমার আপুর সাথে বসে বসে গীতবিতান খুলে গান গাইতাম। সুর জানা গান শেষ হবার পর সুর না  জানা গান গুলো নিজেদের সুরে গাইতাম। যার কারনে গীতবিতানের  বেশির ভাগ গানই মুখস্ত ছিলো। 
ছোটবেলায় ভাইজান, আপু ঢাকা থেকে বাড়ী আসবার সময় ক্যাসেট করিয়ে আনতো গীতালী থেকে। সুচিত্রা মিত্র, কনিকা ব্যানার্জী, সুবিনয় রায়, অর্ঘ্য সেন, চিন্ময় চ্যাটার্জী, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন থেকে শুরু করে কত শিল্পীর যে গান। আমাদের ছেলেবেলা মানেই তো অজস্র বই আর গান। 
স্কুল শেষ করে যখন কলেজ এ ভর্তি হলাম ঢাকাতে, গান শেখার সুযোগও এলো ছায়ানটে। কিন্তু শেষ করা হলোনা। হোষ্টেলে থাকার সময় রাত জেগে বসে গানের পর গান। আহারে স্মৃতিময় সেইসব দিন। আমার কালো রং এর হারমোনিয়ামটা কে জানে কোথায় ধুলোমাখা পড়ে আছে।  
কয়েক বছর আগে যখন সামহোয়ারইন ব্লগে নিয়মিত লিখতাম। একদিন দেখলাম আমার এক কবিতায় এসে  ব্লগের দারুন এক লেখক বিহংগ লিখে গেছে......"বৃষ্টির জলরাশির ভাবগম্ভীর নিনাদে, কিংবা বাংগালী মানুষের মননের শংখনাদে, প্রকৃতি, প্রেম, আর জীবনবোধের যার লেখনি আমাদের প্রাণদ্যোতনায় চির ভাস্বর, সেই কবিগুরুর আজ জন্মদিন। কবির জন্মদিনে ব্লগের পাতায় আপনার নতুন কবিতা প্রত্যাশা করছি, 'কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধান্জলি' এরকম কিছু।" 
খুব অবাক লাগলো। আমার ভিতরের অদ্ভুত সেই দ্যোতনা, কবি গুরুর প্রতি প্রগাঢ় টান। যার গানে আমি হারিয়ে যাই। তাঁকে নিয়ে লেখার তাড়না আমারও হচ্ছিল। কিন্তু এই তাগিদটুকু খুব অনুপ্রাণিত করলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছোটবেলা থেকে মায়ের বলা কবিতা, "দুই বিঘা জমি" থেকে চিনেছি। বোনের গাওয়া গান থেকে জেনেছি।  সেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি অনায়াসে। মা তার আশীর্ধ বয়সেও কবিতাটি আবৃত্তি করতেন স্মৃতি থেকে। দেশে গেলে প্রতিবার মায়ের মুখে কবিতাটা শুনতাম। কি ভালো যে লাগতো!

যেবার শেষের কবিতা পড়েছিলাম, এত ভালো লেগেছিল। "সংঘাত" পর্বে সিলেট আর শিলচরের পাহাড়ের বর্ণনা দারুণ লাগতো। যেখানেই যেতাম হাতের কাছে থাকতো বইটা । ক্যাসেটেও কতবার যে নাটকটা শুনেছি। এক জায়গায় অমিত লাবণ্যকে বলেছিল, "স্পষ্টই বুঝতে পারছি, আমি লিখবো বলেই সমস্ত পৃথিবী আজ অপেক্ষা করে আছে"। অদ্ভুত লাগতো এ জায়গাটা আমার।  ভালোবাসার কোন কবিতাই পছন্দ হচ্ছিল না অমিতের তাই এমন কথা।
এভাবেই  কবিগুরু জীবনের নানান সময়ে প্রভাবিতে করেছেন, করছেন।  জোড়াসাঁকোতে ১৫৪ বছর আগে জন্ম নেয়া সেই অদ্ভুত মানুষটা এভাবেই আমাদের অনেকের জীবনে জড়িয়ে আছেন আলো হয়ে। তাঁর লেখা পুজা, প্রেম, ঋতু, বিচিত্র, প্রকৃতি পর্বের গান শুনলে অবাক হতে হয় এমন কিছু নেই যা তাঁর দৃষ্টি থেকে দুরে থেকেছে। অনুভব থেকে দুরে থেকেছে। তিনি সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে ভালোবেসেই যেনো ভালোবাসতে শেখা। "তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে, আমায় শুধু ক্ষণেক-তরে" এই গানেই কবি বলছেন, "আজকে শুধু একান্তে আসীন, চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন, আজকে জীবন-সমর্পণের গান গাব নীরব অবসরে" এই গান শুনলে ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে যাই। 
"যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে, তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে, যেন আমায় স্মরণ করে।" এই গান তো শুধু গান না, আমার কাছে প্রার্থণার বানী হয়ে ধরা দেয়, যতবার গাইতে বসি ততবার!

কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধান্জলী ( ২০০৮ এ লেখা )

কবি আজ ১৪৭ তম জন্মদিন আপনার। 
আজ ২৫ শে বৈশাখ' ১৪১৫ সাল। 
আজকের সকালটা খুব রৌদ্রময় ছিলো। 
টিউলিপ ফোঁটা সকাল। 
হাঁটতে হাঁটতে অনেকদুর। 
গাছগুলো নতুন পাতায় ভরছে প্রতিদিন। 
ভাবছিলাম, আপনাকেই ভাবছিলাম
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"র কবি। 

১৪৭ বছরের আগের সেই সকালটা কেমন ছিলো? 
এমনই রোদেলা, উন্মনা বাতাসের এক সকাল? 
ট্রোজান রাস্তাটা ধরে সামনে যাই। 
সেন্ট লুইস -ম্যারি দ্য মন্টফোর্ট চার্চের সিড়িতে বসি। 
আশে পাশের বাতাস গুলো কি আমার জন্য 
অপেক্ষায় ছিলো? 
গাছের নতুন সবুজ পাতাগুলো দুলছিলো। 
আমি এক পরবাসী মেয়ে 
একলা বসে রবীন্দ্রনাথকে ভাবলাম। 
গলা ছেড়ে গাইলাম, "আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি 
তুমি এই অপরুপ রুপে হাজির হলে জননী। 
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে।" 

আমার একলা সকালে 
এভাবেই পালিত হলো 
আপনার জন্মদিন।
আপনাকে দিলাম ১৪৭ টা ম্যাপল পাতাময় পাখা। 
বাতাস ঘুরে ঘুরে সেখানে পৌছে যাবে
যেখানে আপনি আছেন। 

কবি আপনি সবখানেই আছেন।
যেখানে বাঙালী আছে। 
যেখানে বাংলা আছে। 
যেখানে প্রেম আছে। 
যেখানে বিরহ আছে। 
যেখানে গান আছে, সুর আছে। 
যেখানে জীবনের জয়গান আছে। 
আপনি সবখানেই আছেন কবি।

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা