অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
বাঙালির নজরুল - মোহাম্মদ ইল্ইয়াছ

মাদের বাংলা সাহিত্যের কাব্যশাখার বরপুত্র হলেন শ্রী মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ। কিন্তু কাব্য সরস্বতীর বর পাননি বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ,অমিয়  চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, ও হুমায়ুন আজাদ-এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমাদের কবিরা সকলেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে  নামজাদা। কাব্য বিচারের নিরিখে কাউকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে কালের বিচারে তারা অনেকেই কালজয়ী ও কালোত্তীর্ণ।

   কাজী নজরুল ইসলাম এঁদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক কবি। শুধু কবিই নয়-জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের তাঁর এক বিদ্রোহীসত্তা। যার উন্মেষ দেশ ও জাতির পরাধীনতার  জাল ছিঁড়ে  অন্যায় অবিচার শাসন-শোষণের  বিরুদ্ধে। তাঁর শক্তিসেল ছিলো শব্দধ্বনি। এ শব্দধ্বনি দিয়ে  তিনি যেমন কাব্যশরীর নির্মাণ করেছেন, যেমনি বাস্তবজীবনেও ছিলেন ভাব-বিলাসের বিরুদ্ধবাদী। নিজের বাস্তব জীবন থেকে শেখা বাস্তবতার ধাপগুলো তাঁকে তৈরি করেছে। তাঁর কাব্যসৃষ্টির সম্ভার যদি আমরা বাদ দিয়ে ভাবি-তাহলে তাঁর জীবন-নাট্যের ইতিহাস হয় বাস্তব ইতিহাস, নয়তো সমাজ-বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস কখনো ম্লান হয় না। শত, হাজার, লক্ষ- কোটি বছর সভ্যতার আলোয় উদ্ভাসিত সেই নাট্যাখ্যান।

    কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা কি অভিধায় ডাকবো? তিনি লেটো দলের কিশোর গায়ক ও গান রচনাকারী, তাঁর আগে মক্তবের ক্ষুদে শিক্ষক, খাদেম, রুটির দোকানের চাকুরে,গার্ড সাহেবের বাসার কাজের ছেলে,পল্টন-সৈনিক, কাব্যকর্মী, 'জয়বাংলার' কবি,পত্রিকার সম্পাদক, রাজনীতিক,সংসারী এবং দীর্ঘসময়ের নির্বাক মানুষ। তাঁর জীবনের এই নাট্যআখ্যানগুলো কেবলই দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত। একথা অতীবও সত্য আমরা কেবল তাঁর সাহিত্যজীবন নিয়ে চর্চা করি। কিন্তু জীবন- নাট্যোর নজরুলকে নিয়ে সাধারণত অগ্রসর হই না। আবার তাঁকে নিয়ে তর্কের শেষ নেই।  বিভ্রান্তিও আছে অনেক।

   তবে এটা আরো সত্যি বাংলাদেশে অভ্যুদয়ের আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যেমন কাব্য ধ্বনির মাধ্যমে, তেমনি সবাক জীবনের ঐ অভ্যুদয়ের মহানায়কের সঙ্গেও ছিলো তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তাঁর কাব্যের শব্দগুচ্ছ এ কারণেই শেখ মুজিব বেছে  নিয়েছিলেন সংগ্রাম ও আন্দোলনের শক্তি-সাহসের প্রতীক হিসেবে। সেই শব্দগুচ্ছের 'জয়বাংলা' ধ্বনি তাঁর ভাষণে এবং শ্লোগানে ব্যবহার করে বাঙালিকে জাগিয়েছেন। দেশ পাকি-হানাদার মুক্ত হলে বঙ্গবন্ধু-তাঁর প্রিয় কবিকে এনেছিলেন বাংলাদেশে।  নিবাস দিয়েছিলেন তাঁর নিবাসের অতি নিকটে। তখন নজরুল নির্বাক এবং স্বচ্ছল জীবনের অধিকারী। এটি বাঙালি জনমানুষের ভালোবাসারই প্রতিদান। আরো সৌভাগ্য  এ বাংলার মাটিতেই চিরনিদ্রা, তাঁর গান বাংলাদেশে রণসঙ্গীত এবং তাঁর নামে সুশোভিত প্রতিষ্ঠান কবি নজরুল ইনস্টিটিউট ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

    কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহাকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়ার একটি খড় দিয়ে ছাওয়া মাটির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে। আর বঙ্গাব্দের ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। মাত্র দশ বছর বয়সে পিতাকে হারান। বাল্যকালে তাঁকে নানা নামে ডাকা হতো। তবে দুখুমিয়া নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলো। তারাক্ষ্যাপা নামেও অনেকে ডাকতেন।

   নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইশকুলে পড়াশোনা করেন। স্হানীয় মক্তব  বা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ঐ  ইশকুলের ক্ষুদে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। আর্থিক অনটনের কারণে এমনটি হয়েছিল। এ সময়  তিনি মাজারের দেখাশোনা ও মসজিদে ইমামতী করেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর ইশকুল শিক্ষক  ফজলে আহমদ ও চাচা বজলে করিমের কাছে  আরবি-ফারসি শেখেন। আর লেখালেখির চর্চা শুরু  করেন। কিছুদিন পরে আবার তিনি  বর্ধমানের মাথরুন ইশকুলে ভর্তি হন।কিন্তু অর্থের অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। ফলে ভর্তি হন স্থানীয় লেটো গানের দলে। কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী লেটোর দল ও পড়াশোনা সম্পর্কিত একটি রচনায় বলেছেন; তখন চুরুলিয়া এবং তার আশেপাশের গ্রামে 'লেটো গান' খুব জনপ্রিয় ছিল। লেটো গানে কবি গানের মতই দুই দলের মধ্যে সওয়াল-জবাবের লড়াই এর মধ্য দিয়ে জয় পরাজয়  নির্ধারিত হত।  কবিতা লেখা, সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ তাঁর  সহজাত হওয়ায় লেটো দলে যোগ দেন সম্ভবত  বেশী টাকা রোজগারের জন্য।  কিন্তু  একথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, তাঁর  এই লেটো দলে যোগদান- অদূর ভবিষ্যতে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং  তাৎক্ষণিক  গান লেখা এবং তাতে সুর- সংযোজনা করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।  তাছাড়া লেটো দলের জন্য নানা ধরনের পালা লিখতে গিয়ে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন।

    ১৯১০ সালে নজরুলের প্রতিবেশীরা তাঁকে রাণীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই নজরুল  ঐ স্কুল ছেড়ে মাথরুন উচ্চ ইংরেজী স্কুল  বা নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক  ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক।  ষষ্ঠ শ্রেণীর পর সম্ভবতঃ আর্থিক কারণে  স্কুল ছেড়ে  বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন। এরপর বর্ধমান অন্ডাল ব্রাঞ্চ রেলওয়ের এক খৃষ্টান গার্ডের খানসামার কাজ নেন। কিন্তু  এ কাজও তার পোষালো না।  তখন তিনি আসানসোলের এক চা-রুটির দোকানে এবং গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ নেন। চা-রুটির দোকানে কাজ করতে করতে আসানসোলের পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে।  নজরুলের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে  এবং তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে  তিনি ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।  ১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে নজরুল ত্রিশাল থেকে দেশে ফিরে আসেন। নজরুল বরাবরই  মেধাবী ছাত্র ছিলেন- বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ত্রিশালে বার্ষিক পরীক্ষায়  তিনি  প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার  করে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথমে নিউস্কুল বা এ্যালবার্ট ভিক্টর ইনস্টিটিউশনে পরে বর্ধমান ফিরে গিয়ে ১৯১৫ সালে রাণীগঞ্জে শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে  ভর্তি হন এবং  দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি এখানেই পড়াশুনা করেছিলেন। এরপর  বাঙালী পল্টনে যোগ দেন। এই সময়  চারজন শিক্ষক বিশেষ ভাবে নজরুলের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে সতীশ কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণ চন্দ্র ঘটক, ফারসি ভাষায়  হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চায় শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    এই রচনাটিতে কল্যাণী কাজী নজরুলের সেনাবাহিনীতে যোগদান ও সাহিত্য চর্চার প্রাথমিক পর্যায়ের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আরো লিখেছেন- ১৯১৭ সালের জুলাই মাসের পর প্রি-টেস্টের সময়  নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম, পরে প্রশিক্ষণের জন্য  লাহোর হয়ে নওশেরা যান। পরে করাচি সেনানিবাসে তাঁর সৈনিক জীবন শুরু  হয় এবং প্রায় পৌনে তিন থেকে তিন বছর  এখানে কাটান। তাঁর  প্রশংসনীয় কাজের জন্য  তিনি খুব  শিঘ্রই সাধারণ  সৈনিক  থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত  হয়েছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। সৈনিক জীবনের বেশীর ভাগই তাঁরই করাচি ব্যারাকেই কাটে। এখানে  তাঁর সাথে পরিচয় হয় ফরাসী সাহিত্যের সুপণ্ডিত এক পাঞ্জাবী মৌলভীর সাথে। তাঁর  কাছ থেকেই তিনি ফারসি সাহিত্য  এবং গজলের জ্ঞান লাভ  করেন।  এ বিষয়ে নজরুল  বলেছেন  'আমাদের  বাঙালী পল্টনে একজন পাঞ্জাবী মৌলভী থাকতেন। একদিন  তিনি  দিওয়ান-ই হাফিজ  থেকে  কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। শুনে আমি এমন মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই  তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করি।  তাঁরই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।'

  এখান থেকেই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত। করাচি সেনানিবাসে বসে লেখা  তিনি কলকাতায় পাঠাতেন বিভিন্ন  পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯১৯ সালে সওগাত  পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম লেখা ' বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম কবিতা 'মুক্তি'।  এছাড়া  করাচিতে লেখা গল্প 'হেনা', 'ব্যথারদান', 'মেহের নেগার', 'ঘুমের ঘোরে' এবং  কবিতার মধ্যে 'আশায়', ও ' কবিতা- সমাধি' উল্লেখযোগ্য।

    ১৯২০ সালের মার্চ মাসে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে বাঙালী পল্টন ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল  দেশে ফিরে এলেন। কলকাতায়  এসে প্রথমে তিনি উঠলেন রমাকান্ত বোস স্ট্রীটে বন্ধু শৈলজানন্দের মেসে। কিন্তু সেখানে তিনি- চারদিন  থাকার পর মেসের কয়েকজন ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য তাঁকে ঐ মেস ছাড়তে হল। এরপর ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে ' বঙ্গীয় মুসলমান- সাহিত্য-সমিতি'র অফিসে মুজফফর আহমদের সঙ্গে একঘরে থাকতে  শুরু করেন।  সাহিত্য  জীবনের শুরুতে ' মোসলেম ভারত'  বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ' উপসনা' পত্রিকায় তাঁর 'বাধন-হারা' উপন্যাস এবং 'বোধন', 'শাত-ইল-আরব',  'আগমনী', খেয়াপারের তরণী', 'কোরবানী', 'মোহরম', ' ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম', প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হয়। এইসব লেখা  গতানুগতিক লেখার চেয়ে  স্বতন্ত্র হওয়ায় সহজেই তিনি  সাহিত্য-সমাজে আদৃত হয়ে নিজের আসনটি পাকা করে নিলেন এবং সেই সময়কার শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সংস্পর্শে এসে নিজেকে নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ করেন।১৯২১ সালের অক্টোবরে শান্তিনিকেতনে গিয়ে  তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন এবং অচিরেই  তিনি তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

    এরপর শুরু হয়  নজরুলের পুরোপুরি কাব্যজীবন পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও সংবাদ পত্র সম্পাদনা। রবীন্দ্রনাথের পর সঙ্গীত চর্চায় এতোবড়ো সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকার এ ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি ছায়াছবি ও নাটকে অভিনয় করেছেন  এবং গানও লিখেছেন। সচীনসেন গুপ্তর সিরাজউদ্দোলা নাটকের (ছায়াছবি) গান তারই লেখা-যা অমরত্ব লাভ করেছে। তিনি  সম্পাদনা করেন ধূমকেতু,  লাঙল, যুগবাণী  ও গণবাণী।ধূমকেতু ছিলো অর্ধসাপ্তাহিক। কবিগুরুর বাণী ধারণ করে এটি প্রকাশিত হতো।  কিন্তু  ব্রিটিশ সরকারের  বিরুদ্ধে  মা দুগগা কে লড়াইয়ের আহবান জানিয়ে একটি কবিতা লিখলে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ  ঘোষিত  হয়৷ জেলে যেতে হয়  কবিকে।তাঁর বিষের বাঁশী ও ভাঙার গানও  নিষিদ্ধ হয়। ১৯২৫ সালে রাজনৈতিক ও সম্মেলনে যোগ দিতে শুরু করেন। একবার বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে- ফরিদপুর ঢাকা অঞ্চলের নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। তাঁর দলের নাম ছিলো  শ্রমিক স্বরাজ দল। এতো সবের মধ্যে তাঁর সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি।১৯২৯ সালের ১০ ই ডিসেম্বর কলকাতার  এ্যালবাট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। তখন তিনি  রবীন্দ্র গগণের নক্ষত্ররাজ। ইতোমধ্যে তাঁর  কবিতা, গান, নাটক  ও উপন্যাস  এবং  প্রবন্ধের বইগুলো  পাঠকের হাতে পৌঁছে  গেছে  এবং বিদ্রোহী কবি হিসেবে সর্বজননীন স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁর বিদ্রোহী, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, শিকল পরাছল, কারার ঐ লৌহকপাট,  চল্ চল্ চল্,  অগ্নি- বীণা, মোরা একবৃন্তে, সাম্যবাদী,মৃত্যুক্ষুধা, যুগবাণী,, নারী, সাম্য, বাঙালির বাঙলা, মসজিদ-মন্দির ও হিন্দু-মসলমান রচনাগুলো মানুষ মুখস্থ করে ফেলেছে।

   কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কবি ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে  সকল প্রকার চিকিৎসা দেয়া হয়। পাঠানো হয় বিলেতে। কিন্তু  তিনি সুস্থ হননি। নির্বাক জীবন যাপন করেছে  মৃত্যু অবধি। অন্যদিকে কবির স্ত্রীও ১৯৩৯ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশ জীবন-যাপন করেছে তিনি ১৯৬২ সালে তিনি মারা যান। তাকে তার  জন্মভূমিতে সমাহিত করা হয়।  নজরুলের জন্মভূমি চুরুলিয়াতেই তাঁদের  নামে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

   সবাক জীবনে নজরুল পূর্ববঙ্গে বহুবার বহু জেলায় এসেছেন। ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখমালী, ময়মনসিংহ  সহ অনেক স্থানে তাঁর পদচারণা আমরা দেখেছি।  কলকাতা থাকতে  কুমিল্লার দৌলতপুরের এক গ্রন্থপ্রকাশক আলী অাকবর খানের সঙ্গে দোস্তী হয়। এই মানুষটি একবার কবিকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং  সেখানে তার বোনের মেয়ে নার্গিসকে কবির সাথে বিয়ে দেবার আয়োজন করে।  কথিত আছে ইসলামী  রীতি অনুযায়ী বিয়ের পূর্বেই আকদ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু  বিয়ের শর্তপূরণ কবি রাজি না হয়ে  ঐ রাতেই কুমিল্লার সেনপরিবারের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে তাদের বাড়ি আসেন। এক পর্যায়ে কবির বন্ধু  ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেডম  মুজফফর আহমদের স৷ থে কলকাতা ফিরে যান এবং সেখানেই সেনপরিবারের মেয়ে প্রমীলাকে বিয়ে করেন। প্রমীলা হলো   আপন চাচাতক বোন। উল্লেখ্য-প্রমীলাদের বাড়ি আমাদের বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের শিবালয় যমুনা ঘেঁষা তেওতা গ্রামে। এই গ্রামে প্রমীলার স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করছেন বর্তমান সরকার।  নজরুল প্রমীলা পরিবারের উত উত্তরসূরিরা বর্তমানে ঢাকায় ও কলকাতায় বসবাস করছে।

  বায়াত্তরের পূর্বে কবি কলকাতায় আর্থিক- অনটনের মধ্যে জীবন নির্বাহ করছেন। অবশ্য পাকি সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে আড়াইশ টাকা করে মাসিক ভাতা দিতো। একাত্তরে কবি ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শব্দ- সৈনিক। বায়াত্তরে বঙ্গবন্ধুই কবিকে ঢাকা নিয়ে আসেন, গাড়ী, বাড়ি, ভাতা ও পতাকা দেন। তাঁকে নাগরিকত্ব, ডিলিট উপাধি ও একুশে পদক প্রদান করা হয়।  মূলত তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অতিথি হিসেবে এখানে ছিলেন। ১৯৭৬ সালে ২৯ শে আগস্ট সকাল ১০ টায় ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর কবিতানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

  কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন অসাম্প্রাদায়িক মানুষ।  হিন্দু- মুসলিম মিলনের অগ্রদূত এবং  সর্বহারা শ্রেণির মুখপাত্র।  সমাজের ভেদাভেদ তাঁকে পীড়া দিত। ভণ্ড ধর্মবাদীদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না।  এ কারণে  তাঁকে অসহ্য বেদনা-ব্যথা সইতে  হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষাভাষী  সর্বজনপ্রিয় কবি। অজর তাঁর সৃষ্টি- সত্তা। আমরা চিরদিন স্মরণ করবো, শ্রদ্ধা জানাবো।

তথ্যপঞ্জি -
১. কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা-   মুজফফর আহমদ।
২. কাজী নজরুল ইসলাম- কল্যাণী কাজী।
৩. নজরুল জীবনী- রফিকুল ইসলাম। 
৪. সওগাত যুগে কাজী নজরুল ইসলাম- মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।

মোহাম্মদ ইল্ইয়াছ
ঢাকা, বাংলাদেশ