অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ফুলবানু - সুফিয়া ফারজানা

ফুলবানুর বিয়েটা টিকলো না শেষ পর্যন্ত। ফুলের মতই সুন্দরী ফুলবানু। সহজ-সরল নরম মনের মেয়ে। কিন্তু তবুও ফিরোজ আর কিছুতেই রাজি নয় এই বউ নিয়ে সংসার করতে। ফুলবানুর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, সে জ্বিনেধরা মেয়ে। কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসে। কথা বললে কথার উত্তর দেয় না। মাঝরাতে খোলা চুলে বাড়ির পিছনের পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকে। এসব সমস্যার কারণেই বহুদিন বিয়েও হয়নি তার। এখন বয়স চব্বিশ-পঁচিশ তো হবেই। অসম্ভব সুন্দরী বলেই ফিরোজ এসব কথা শুনেও বিয়ে করেছিল ফুলবানুকে। কিন্তু বিয়ের পর তিন বছর কেটে গেলেও সন্তানসম্ভবা হল না ফুলবানু। তার উপর এসব দোষ তো আছেই। ফিরোজ ম্যাট্রিক পাস ছেলে। দেখতে সুদর্শন। জমিজমাও আছে তাদের। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ফিরোজ। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। মা আছেন। মা-ছেলের সংসার জমির আয় দিয়ে ভালভাবেই চলে যায়।ফিরোজ কোন দুঃখে এই পাগল বউ নিয়ে সংসার করবে?

স্বামীর ঘর থেকে বিদায়ের সময় খুব কাঁদলো ফুলবানু। কিন্তু তালাক হয়ে গেছে, এখন তো যেতেই হবে তাকে। ফুলবানুর বড় ভাই এসে তাকে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। বাবা-মা মারা গেছেন অনেক বছর আগেই। বড় ভাই নিজেও অভাবী মানুষ। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে তার ভাইয়ের। ভাবী মোটেও খুশি হলেন না ফুলবানুকে দেখে। অনেক কষ্টে আপদ বিদায় করেছিল তারা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই আধাপাগল জ্বিনেধরা ননদটি আবার তার ঘাড়েই এসে চাপলো। এখন বাকী জীবন এই আপদকে পুষতে হবে ভাত-কাপড় দিয়ে। এমনিতেই ভাত, কাপড় দু'টোরই বড়ই অভাব তার সংসারে। 

ফুলবানুকে তালাক দিয়ে মনে বেশ শান্তি পেল ফিরোজ। মায়ের অনুরোধে পরের মাসেই তার খালাতো বোন মদিনাকে বিয়ে করলো সে। মদিনার বয়স আঠারো-ঊনিশ হবে। গায়ের রং কালো হলেও বেশ লম্বা আর সুঠাম স্বাস্থ্য মদিনার। তাছাড়া কাজেকর্মে খুবই ভালো, চটপটে মেয়ে। পড়াশোনাও করেছে স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত। সুন্দরী বিয়ে করে তো দেখলো ফিরোজ। এবার আর সুন্দরী চায় না সে, এবার একজন সত্যিকারের বউ চায়, ঘরণী চায়। মদিনাকে বিয়ে করে সত্যিই বেশ সুখী হল ফিরোজ। বিয়ের পরের বছরই মদিনার গর্ভে এক চাঁদের মত পুত্রসন্তান জন্ম নিলো। এত তাড়াডাড়ি মদিনার ছেলে হওয়ায় ফিরোজ আর তার মা তো মহাখুশি। এতদিনে ভিটায় চাঁদ উঠলো তাহলে। বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের।

সেদিন ছিল রবিবার। ঘাট থেকে বেশ বড় একটা ইলিশ মাছ এনেছিল ফিরোজ। একেবারে আসল পদ্মার রূপালি ইলিশ। মাছটা বরাবরের মত মায়ের হাতেই দিলো ফিরোজ। মাছ কুটতে খুব ভালবাসেন মা। তক্ষুনি বটি নিয়ে বসে গেলেন মাছ কুটতে। ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে চারদিক ম ম করতে লাগলো। মাছ দেখে মদিনাও মহাখুশি। কত দিন ইলিশ মাছ খায় না! সেও খুব ভালবাসে ইলিশ মাছ। কিন্তু গরিব ঘরের মেয়ে মদিনা বাবার বাড়িতেও ভালো-মন্দ খেতে পায়নি খুব বেশি। তবে ফিরোজ তার সব শখই পূরণ করছে ইদানীং। বাজার থেকে চুপিচুপি গরম গরম জিলাপি নিয়ে আসে ফিরোজ তার জন্য। গত হাটবারে একটা লাল রঙের তাঁতের শাড়ি এনে দিয়েছে ছেলে হওয়া উপলক্ষে। 

সন্ধ্যার একটু আগে ফিরোজ গোসল করতে পুকুরঘাটে গেল। একটু পরে ছেলে কোলে ঘাটে গেল মদিনাও। শানবাঁধানো ঘাটে বসে ছিল মদিনা ছেলে কোলে নিয়ে। কথা বলছিল ফিরোজের সাথে। কিন্তু বসা থেকে উঠতে গিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে পা পিছলে পুকুরে পরে গেল মদিনা ছেলেসহ। ফিরোজ সাথে সাথে ডুব দিলো পুকুরে। আপ্রাণ চেষ্টায় কোনরকমে ছেলেকে নিয়ে পাড়ে উঠে আসতে পারলো ফিরোজ। কিন্তু মদিনাকে পেল না সে আর। তারপর ঠিক কি হয়েছিল, কেউই অবশ্য জানে না। কিছুক্ষণ পরেই মদিনার লাশ ভেসে উঠলো পুকুরের অন্য পাড়ে। সন্ধ্যা মিলানোর পরে পুকুরঘাটে গিয়ে সবাই দেখে, শানবাঁধানো ঘাটে মদিনার ছেলে কোলে করে খোলা চুলে বসে আছে ফুলবানু। ফিরোজ অচেতন হয়ে পরে আছে ঘাটে।
(সমাপ্ত)

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ