অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
শাহেদ বখত ময়নুর আমার মুক্তিযুদ্ধ : একজন গেরিলার আত্মকথা - বিজিৎ দেব

দেশভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনার বিবরণ নিয়ে গেরিলা যোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নুর ( জন্ম. ১৯৫০) লিখিতভাষ্য আমার মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থটি বিভিন্ন কারণে মূল্যবান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ এবং গেরিলাযুদ্ধ এই দুইভাবে রণাঙ্গন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। গেরিলা যুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ লাভ করে। এবং সর্বোপরি একটি অসাম্প্রদায়িক যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি শাসক- শোষকের জগদ্দল থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু এর জন্য প্রতিটি স্বাধীনতাকামী জনগণকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। তাঁদের ঋণ অপরিশোধযোগ্য। একজন গেরিলাযোদ্ধা শাহেদ বখত মযনু নিজে যুদ্ধ করেছেন, ছিলেন যুদ্ধের সংগঠক এবং যুদ্ধের ভেতর-বাহির যতটুকু সম্ভব অবলোকন করেছেন নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হলো নির্মোহ ইতিহাস। সেই দায়বোধ তাঁর স্মৃতিচারণে আছে। সত্য প্রকাশের জন্য ইলিম থাকতে হয়, সেটা বাস্তবেই তাঁর মাঝে উপস্থিত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি এবং তাদের অনুচর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকার কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণ প্রাথমিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনি বাংলাদেশে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং নারী নির্যাতন করেছে। রাজাকারের দল এদেশের মা-বোনকে পাকবাহিনির হাতে তুলে দিয়েছে। এসবের প্রত্যক্ষদর্শী  গেরিলা  যোদ্ধা ময়নু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অলিখিত অনেক বিষয়-প্রসঙ্গের বর্ণনা আছে এতে। বিশেষত রাজনগর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা  বিষয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লেখক নিজেই। এই কার্যকারণে গ্রন্থটি বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য সঠিক নির্দেশক। শাহেদ বখত ময়নু পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে বন্দিদশায় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দৈবক্রমে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বেঁচেছেন। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা ময়নুর লিখিত বিবরণ আমাদের জানান দেয় যে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও পরিস্থিতির কথা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে উপস্থিত ছিলেন শাহেদ বখত ময়নু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছেন এবং লক্ষ লক্ষ জনতার জনযুদ্ধের শপথে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্পে নিবিষ্ট হন। নয় মাসের পথপরিক্রমায় অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছিল তার মুক্তিযুদ্ধ জীবনে। এসবের বিস্তারিত বর্ণন এই গ্রন্থ। প্রমথ চৌধুরীর একটি আপ্তবাক্য হলো- ‘যে ফুল দিনে ফোটে রাতে তার জন্ম হয়।’ শাহেদ বখত ময়নু উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারকে। ব্রিটিশ-আমল থেকে রাজনগরের ফকিরটুলা বখত-বাড়ি ছিল শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, মনুষ্যত্ব-স্বদেশপ্রেমে, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে অন্যতম। তাঁর চাচা আব্দুল মালেক বখত গ্রেটব্রিটেনে পাকিস্তান হাইকমিশনে দীর্ঘদিন ওয়েলফেয়ার অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন, এই সুবাধে তেষট্টিজন বাঙালিকে বিনেপয়সায় ব্রিটেনে নিয়ে যান। তারা বিমানের ভাড়া পর্যন্তও দিতে পারেনি। তাঁর আরেক চাচা জননেতা মখদ্দুস বখত ১৯৫৪ সালের রাজনগর থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৫৬ সালে   মৌলভীবাজার, সিলেট এবং ঢাকায় শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মেলনের মাধ্যমে রাজনগর থানা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি উপহার দেন। এ-কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদক, মৌলানা নাসিরউদ্দিনকে সভাপতি এবং বাবু শশাংক শেখর ঘোষ প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। উল্লেখ থাকে যে জননেতা মখদ্দুস বখতের সন্তান মিলন বখত বর্তমানে রাজনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মনসুরনগর ইউপি চেয়ারম্যান। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন শাহেদ বখত ময়নুর অনুজ কবি ও লেখক মহসিন বখত, অনুলিখনের কাজ করেছেন কবি জাভেদ ভূঁইয়া, সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন খছরু চৌধুরী।  এবং গৌরচন্দ্রিকা লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল  মোহাম্মদ। গ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর নিখুত মন্তব্য- ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে অগণিত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, কিন্তু ময়নু ভাইয়ের মতো যুদ্ধদিনের এমন প্রচ্ছন্ন স্মৃতি খুব কম লোকের  পেয়েছি। তিনি অবলীলায় ছবি এঁকে বলে যান একজন গেরিলা যোদ্ধার জীবন কেমন ছিল।’ গ্রন্থটির প্রকাশক : নাট্যকার সুফিয়ান ও কবি মালেকুল হক,  নাগরী প্রকাশন। মূল্য : ৬৫০ টাকা। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। অক্ষর বিন্যাস : সীমান্ত দাস। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৫২। 

আমার মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থটিতে লেখক ছাব্বিশটি উপশিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর স্মৃতিচারণ করেছেন। তা হলো : আমার রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের পট পরিবর্তন,  দেশভাগ, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, সত্তরের নির্বাচন ও মালেক বখত, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু, বাড়ির পথে যাত্রা, আমার মুক্তিযুদ্ধ, আসামের বিলবাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, কেসরিরকোল ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া ও জেনারেল ওসমানীর সাক্ষাৎলাভ, দেরাদুনে ট্রেনিং, বিএলএফের আঞ্চলিক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির আগমন, আমাদের যুদ্ধযাত্রা, দুইজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যা প্রতিশোধ গ্রহণ, কুত্তার মুখে মানুষের মাথার খুলি, সুনীতি ধরের বাড়ি ও হিন্দুদের ভীতি, মামাবাড়িতে ঘাঁটি, ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় আক্রমণের পরিকল্পনা, বৈদ্যরূপে ভগবান ও মনির রাজাকার, পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের টর্চার সেলে আমরা, আমাদের বন্দিত্বের অবসান, রাজনগর মুক্ত দিবস, পাঁচগাঁওয়ের গণহত্যা ও আত্তর মণ্ডলের জবানবন্দি, মুক্তিযুদ্ধে এক অসহায় মায়ের আত্মদান, অনিল দেব আমার বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারির করুণ মৃত্যু ও রাজনগর থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। 

পাকিস্তান সৃষ্টির উল্লাস নিয়ে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে পশ্চিমপাকিস্তানির দুষ্টচক্র কর্তৃক বৈষম্যের শিকার হন ভাষা নিয়ে। একটা কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রায় আড়াই-হাজার মাইল দূরে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর খড়গ চালনা করতে শুরু করে। আর বৈষম্য তো ছিলই। আমাদের অর্থনীতির সুফল তারা ভোগ করতো। এপ্রসঙ্গে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিত লিখেছেন যে‘ ... পশ্চিমে কি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এতটুকু দরদ বা চিন্তা ভাবনা আছে; না এই এলাকা শুধু দুগ্ধবতী গাভি, শোষণের জন্য এক উপনিবেশ?’ ( স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ : আবুল মাল আবদুল মোহিত, পৃ. ২৫)  

শাহেদ বখত ময়নু তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে তিনি ১৯৬৭ সালে শীতের সময়ে রাজনগর থেকে ঢাকায় গমন করেন তাঁর চাচার ভাড়া বাসায়। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন হরদম আন্দোলন মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন যে আমাদের কৃষক, শ্রমিক শুধুই উৎপাদন করতো, কিন্তু সেটার নায্য মূল্য পাওয়া ছিল অমাবস্যার চাঁদের মতন। আমাদের চা, পাট, কাগজ মিলের লভ্যাংশ গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেতো। পূর্ব পাকিস্তানকে তখন থেকেই তারা মরুভূমিতে রূপান্তরিত করে। আবুল মাল আবদুল মোহিতের কথায় বলতে হয় যে পূর্ব পাকিস্তান দুগ্ধবতী গাভি, দুধ পশ্চিমের প্রাপ্য। কিন্তু পূর্ব  পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমুচিত জবাব দিয়েছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শাহেদ বখত ময়নুর জীবনের এক সোনালি অধ্যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনীর হুংকারে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে স্বশরীরে উপস্থি ছিলেন ময়নু। এথেকেই তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন, সাধ পূরণের ইচ্ছা জাগে। তিনি সংকল্প নেন যুদ্ধে যাওয়ার। ৭ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তখন থেকেই তারা নীল-নকশা করতে থাকে। তারা ২৫ মার্চের রাতের মধ্য দিয়ে তাদের ধ্বংসযজ্ঞের কার্যক্রম শুরু করে। টিক্কা খান, জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীর ছকের মাধ্যমে গণহত্যা, নারী নির্যাতন শুনু হয়। শাহেদ বখত ময়নু স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ঢাকা শহরের এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাস্তায় গাছের গোড়া ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছেন। রাস্তা কেটে পাড়া-মহল্লার  রাস্তা বিচ্ছিন্ন করা হয় যাতে মিলিটারির গাড়ি প্রবেশ না-করতে পারে। কোনও কোনও পাড়ায় তাঁদের বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন নিজে থেকেই। ২৫ তারিখ ভয়াল রাতের  গোলাগুলি আমাদের ঘরের দেওয়াল ও টিনে এসে লেগেছিল। ( দ্রষ্টব্য: আমার মুক্তিযুদ্ধ, শাহেদ বখত ময়নু, পৃ. ৩০) প্রত্যক্ষদর্শী শাহেদ বখত ময়নুর বিবরণ এটি। পাকিস্তানের এই আক্রমণ ছিল অতর্কিত। রাবণের পুত্রকে  যেভাবে পূজারত অবস্থায় বধ করা হয়েছিল। সাহায্য করেছিলেন রাবণের সহোদর বিভীষণ। আর মুক্তিযুদ্ধে বিভীষণ ছিণ রাজাকার এবং বিহারীরা। ২৫ মার্চের গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববাংলায়  ভয়ভীতি প্রদর্শন করা। যাতে বাঙালির আন্দোলন থেমে যায়। কারণ তখন শেখ মুজিবুর রহমানকেও বন্দি করে। ২৬ মার্চ সাময়িক সময়ের জন্য কারফিউ তুললে ঢাকার উদভ্রান্ত বাঙালি গ্রামীণ জনপদে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। লক্ষ্যে পৌঁছতে কি বেদনা পোহাতে হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থের লেখকের স্মৃতিচারণে বলেছেন সন্তান সম্ভবা এক বোন ও অন্যান্য সদস্য নিয়ে কিছু পায়ে হেঁটে, কিছু নৌকাযোগে হবিগঞ্জে পৌঁছেন। এরমধ্যে পথে না গুঞ্জন, চোর-ডাকাতের ভয়। তবুও নাকি এই সময় কিছু স্বেচ্ছাসেবির দল অভয় দিয়ে সাহায্য করেছিল। কী করুণ দৃশ্য ছিল এই নয় মাসের যুদ্ধে। তখন বিহারীর উপদ্রব ছিল অসহনীয়।  

শাহেদ বখত ময়নু বাড়িতে আসার পর গভীর সাহসের সঙ্গে রাজনগর থানার নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। গণসংযোগ করেন ওইসময়ের ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে প্রয়াত আছকির খান, আসকান মিয়া, মুস্তাফিজুর রহমান মানিক, আজাদ মিয়া, জাফর মিয়া, বারি মিয়াদের সাথে। তাঁদের নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। নাজমা রেস্টুরেন্ট ছিল তখন মিটিং এর উর্বর জায়গা। যা লেখকের জবানিতে উঠে এসেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শাহেদ বখত ময়নু আসামের বিলবাড়িতে যাত্রা শুরু করেন। ট্রেনিং ছিল খুবই কষ্টের। ট্রেনিং শেষে যে খাবার দেওয়া হতো সেই বিবরণের মাত্রা অনুভব করলে বোঝা যাবে দেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতিটাও কত দুঃসহ ছিল। তিনি লিছেন- আমরা ক্লান্ত অবস্থায় এখানে-সেখানে বসে আছি খোলা আকাশের নিচে গভীর জঙ্গলে। এর অনেক সময় পর, আমাদের জন্য খিচুড়ি নিয়ে আসা হয়ে। খিুচড়ি বিতরণকালে আমাদের এক বিপত্তি দেখা দিলো, কারণ এতো মানুষের জন্য  গ্লাস-প্লেইট কোনও কিছুরই ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। তখন আমরা আমাদের কাপড়ছোপড় দিয়েই খিচুড়ি গ্রহণ করি। খিচুড়ির চালে ছিল পোকামাকড়ের উপস্থিতি ( দ্রষ্টব্য: আমার মুক্তিযুদ্ধ, শাহেদ বখত ময়নু, পৃ. ৩৯)। দেরাদুনেও তারা ট্রেনিং নেন। তখন তাঁদের গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল শেখানো হয়। এবং এতদসঙ্গে জনমত তৈরির কথাও বলা হয়। যাতে জনযুদ্ধে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। বাস্তবে তা-ই হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় গোষ্ঠী ব্যতীত সবাই কোননা কোনওভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি এবং রাজাকারের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব যুদ্ধ সঞ্চালিত হয়েছিল। ওইসময় পাকিস্তানি সেনারা রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিল। এবং সাধারণ জনমনে পূর্ব পাকিস্তানের লড়াকু সৈনিকদের উপস্থিতিও জানান দেওয়া হয়েছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন করা; এতে রেল লাইন, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু, বৈদ্যুতিক লাইন গুড়িয়ে দেওয়া এবং অতর্কিক আক্রমণ ছিল গেরিলাদের কাজ। শাহেদ বখত ময়নু লিখেছেন যে তাদের শেখানো হয়েছিল যে  গেরিলা মাস্ট নট ডাই। অর্থাৎ গেরিলারা মরেনা। গেরিলা বা গোয়েরা একটি হিংস্র জন্তু। কিন্তু জন্তুর সঙ্গে গেরিলার পার্থক্য হলো তোমরা রাজনৈতিক  প্রজ্ঞাবান। এটা সুন্দর একটি বিষয়। রাফ, টাফ ফেরোসাস এই তিনটি বিষয়জ্ঞান ছিল গেরিলার। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম তাঁর বাংলাদেশের গেরিলাযুদ্ধ ( ২০১৮ ) বইতে গেরিলাকে লিখেছেন এভাবে মাছ যেমন পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, গেরিলারা তেমনি বিশাল জনপদের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। ‘আঘাত করো এবং সরে পড়- এই ছিল রণনীতি। জনগণের মধ্যে মিশে পড়া গেরিলাদের পাকিস্তানি সৈনিকেদের খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিডিয়া উয়িংস কর্ণেল সিদ্দিক সালিক তাঁর পুস্তকে লিখেছেন- ‘একজন গেরিলা অতিসহজেই তার স্টেনগানটি ফসলের মাঠে ফেলে নিরাপরাধ কৃষকের মতো কাজ করতে পারে। ঠিক এইভাবে একজন জেলে মাছ ধরার সময় মাইন পুতে  সরে পড়তে পারে।’ 

গেরিলা যুদ্ধ থেকে জনযুদ্ধ। এই গেরিলারাই এদেশের মুক্তিকামী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা পিএসসি রফিকুল ইসলাম বলেন যে গেরলিা যুদ্ধে যে অভাবিত সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তা দুটো কারণে সম্ভব হয়েছিল- এক. দেশের অভ্যন্তরে সাত কোটি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন- যারা আশ্রয়, আহার ও খাবার দিয়ে সাহায্য করেছেন। দ্বিতীয়, উন্নতমানের গেরিলাদের অংশগ্রহণ- যারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এবং যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রাণ বিসর্জন দিতে সদা প্রস্তুত। নয় মাসের যুদ্ধে ২৩১টি ব্রিজ, ১২২টি রেলওয়ে লাইন, ৯০টি ইলেকট্রিক স্টেশন ধ্বংস ও অসংখ্য আক্রমণ চালানো হয়। 

আমরা শাহেদ বখত ময়নুর নির্মোহভাষ্যে পাই গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে তিনি এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধরনের ডিনামাইট, গ্রেনেড, মানি বিস্ফোরণ করতেন গেরিলা যুদ্ধে। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা আক্রমণের সময় তাঁর দল রাজাকারের হাতে ধরা পড়েন। রাজনগর থানা থেকে তাদের পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সেলিমের অফিস মৌলভীবাজার কলেজের প্রফেসর কোয়ার্টারের নিচতলাতে। এখানেই ক্যাম্প বসায়। এখানে রাজনগরের সনামধন্য ব্যক্তি এবং অন্যান্য মানুষকে এনে দেয় শান্তিবাহিনির লোকজন ও রাজাকারেরা। রাজনগরের কিছু মেয়েকেও পাকিস্তানি ক্যাম্পে তুলে দেয় রাজাকাররা। এমনকি গুলি করেও মারা হয় অনেককে। কিন্তু মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ বিমান তাদের বন্দিদশার কয়েকদিন পর থেকে সেলিং করতে থাকে। পাকিস্তানিরা ভড়কে যায়। শাহেদ বখত ময়নুর লেখায়- বন্দি ক্যাম্পের চতুর্দশ দিনে বিকেল বেলা থেকে ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের দেখা যাচ্ছে না। যে কয়েকজন দেখা যাচ্ছে, তাঁরা বড়োজোর চার-পাঁচজন হবে। আমাদের কি হবে এখন, তুমুল যুদ্ধ চলছে। বিকেলে আমি হান্নান, বাছন, বদরউদ্দিন ও হবিগঞ্জের একজন রেডিয়ো ম্যাকানিকসহ পাঁচজনকে রুম থেকে বের করে আমাদের অর্ডার করে- 'এক লাইনে দাঁড়াও।’ ময়নুদের চোখ বাঁধতে বলে পাকিস্তানি সৈন্য। তারা তাঁদের মতোন করে চোখ বাঁধে। এরপর সবাইকে একসাথে একটি তারে  বেঁধে টিলার উপর দিয়ে হাটাতে থাকে। হঠাৎ মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের সেলিং শুরু হলে পাকিস্তানি সৈন্য লাফ দিয়ে বাংকারে পড়ে যায়। তখন তারা পালিয়ে যান। এই ছিল শাহেদ বখত ময়নুদের পাকিস্তানিদের হাত তেকে বেঁচে যাওয়ার দৃশ্য। রাজনগর মুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু, বীর মুক্তিযোদ্ধা আছকির খানসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাজনগরে এস মিলিত হন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কিন্তু রাজাকার, শান্তিবাহিনীর লোক পাখি রাজাকারসহ অন্য রাজাকারদের ধরার জন্য অভিযান চালানো হয়। অবশেষে এদের এনে ইচ্ছেমতোন পিটানো হয়। রাজনগরের সুনীতি ধরের বাড়ি দুদু রাজাকারের সহায়তায় ঘরাবাড়িতে আগুন, সম্পদ লুট এবং নারী নির্যাতন করানো হয় পাকিস্তানিতের দিয়ে। এসময় ১৬ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি। পাঁচগাঁও-এ গণহত্যা করে প্রায় একশত নিরপরাধ বিশজন মানুষকে হত্যা করে পাকবাহিনী। উত্তরভাগের নিরপরাধ ব্যক্তি বৈদ্যরূপে ভগবান ডাক্তার যামিনীমোহন দেবকে হত্যা করে পাকসৈন্য। এই সবকিছুই সংঘটিত হয়েছে স্থানীয় রাজাকার সহযোগে পাকিস্তানি সৈন্যকর্তৃক। 

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী এবং রাজাকারের মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ, হিন্দু এবং প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ। পরিশেষে তারা আর এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। নির্বিচারে হত্যা নির্যাতন শুরু করে। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় ও আহার যুগিয়েছে তাঁদের সবাইকে হত্যা নির্যাতন করতে পিছপা হয়নি। উল্লেখ্য স্বাধীনতা পূর্বাপর প্রতিক্রিয়াগোষ্ঠী সরব। দুঃখের বিষয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. জি.সি দেবের ঢাকার বাড়িটি  বেদখল। শাহেদ বখত ময়নু লিখেছেন আমি -'তখন আমার চাচার ভাড়া বাসায় ঢাকা শহরের ধানমন্ডির ১৩/২ বসবাস করে আসছি। বাসাটি ছিল আমার চাচার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. জি.সি দেবের। এই কিছুদিন আগে  খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাড়িটি এখন কোথাকার হাক্কানি পিরের খানকা শরিফ।’ এটা প্রথম জানলাম এই গেরিলা যোদ্ধার প্রত্যক্ষ দর্শন থেকে। আরও জানলাম জি.সি দেব বর্তমানের নামকরা লেখক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে দত্তক নিয়ে নিয়েছিলেন। জি.সি দেবের মতোন অনেক উদার-মানবতাবাদি দার্শনিক বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানি হত্যা করেছে। 

গেরিলা যোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়কে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে আমাদের প্রজন্মের মাঝে উপস্থাপন করে আমাদের সত্তাকে জাগরূক করেছেন । একজন মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, এরচেয়ে বড়ো ইতিহাস আর কি হতে পারে। ধন্য মাগো ধন্য, ধন্য তোমার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধার মহাকাব্যিক ইতিবৃত্ত একজীবন লিখলেও শেষ হবে না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের কথামাত্র তুলে ধরেছি। 


বিজিৎ দেব, কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। এম.ফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।