অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
স্বপ্ন এবং সত্যি - সুলতানা শিরীন সাজি

মানুষের কত স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের হাত ধরে সত্যি আসে। কখনোবা সত্যি হয়না স্বপ্ন, কিন্তু তাই বলে স্বপ্ন দেখা তো থেমে থাকেনা। বা থামা উচিতও না।
একদিন স্বপ্নে মাচুপিচুর পাহাড়ের চূড়ায় আমরা। তোমাকে বলেছিলাম এখানে আসতে পেরে আমার কেমন লাগছে জানো? মনে হচ্ছে, আমি আরব্য উপন্যাসে পড়া কোন রাজকন্যা। মাচুপিচু নয়, আমাকে নিয়ে তুমি শুধু পৃথিবীর যে কোন কোথাও, এমনকি পৃথিবীর বাইরে ও যত গ্রহ আছে, চলে যেতে পারো অনায়াসে। অনেক কঠিন সময়কে তুমি এভাবে সহজ করতে জানো তোমার সাবলীল কথামালায়।

আমি হাসছিলাম। একবার হাইওয়েতে তুমি গাড়ি চালাচ্ছিল, রাতের অন্ধকার আকাশ! গহঠাৎ তুষারপাত শুরু হলো। আশেপাশে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। গাড়ির হেডলাইট ধরে আমরা সামনে এদিয়ে চলছি। তুমি বললে, এই হলো অ্যানড্রোমিডা!  আমি অবাক হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম! তুমি বুঝে ফেললে। বললে, সত্যিই অ্যানড্রোমিডা । আরো বললে, তুমি হলে সেই কৃষ্ণচূড়া, যে ফুটেছো কোনকালে। কোন এক মন্ত্রবলে তেমনি থেকে গেছো।যেমন দেখেছি প্রথমদিন। তোমার জন্য আমি সব পারি। 

"ভালোবাসা গো ভালোবাসা" আমি বলেছি তোমাকে। মুখে বলতে পারিনি।  চোখে চোখে বলেছি। এত বছর এক সাথে আছি। সব কথা বলতে হয়না আর মুখে। যদিও মাঝে মাঝে এই শব্দটা শোনার জন্য তুমি এমন ছেলেমানুষ হয়ে যাও। জানতে চাও কত ভালোবাসি। আমি আমার হাতের আঙ্গুল দিয়ে একটুখানি দেখাই। সারাজীবন এই একটু ভালোবাসার জন্যই তুমি আকুল হয়ে থাকো।
আমি কোনদিন হাত দু'টো মেলে যদি বলি, এতো ভালোবাসি! হাসতে থাকো। বলো, ”মোটেই না। আমার ঐ আঙ্গুল এর মাপের ভালোবাসাতেই আমার হয়ে যাবে। এই আকাশ জোড়া ভালোবাসা তুমি পৃথিবীর আর সবাইকে দাও।”

আমি অবাক হয়ে যাই।
ভালোবাসায় ঈর্ষা নাই তোমার? তুমি বলো, ছিল। অনেক ছিল। দিনেদিনে সেই ঈর্ষা হারিয়ে গেছে। মানুষ যে একা কারো নয়। হতে পারেনা। প্রেম, ভালোবাসা অনুভব গুলো এত বিশাল! 

আমার সাথে পরিচয়ের পর তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছো। আমার চেয়ে বেশীই পড়েছো। আমি তো গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা নিয়েই থেকেছি। তুমি গল্পগুচ্ছের এক একটা গল্প পড়েছো আর বিস্মিত হয়েছো!
বলেছো, তিনি পারলে আমরা পারবো না কেনো?
আমাকে কতবার যে বলেছো, তোমার রবীন্দ্রনাথ আমাকে পাল্টে দিয়েছে।
তুমি আমাকে প্রায়ই বলো, "জোনাকী কি সুখে ঐ ডানা দু'টি মেলেছো" গানটা তোমাকে পুরো অন্য মানুষ করে দিয়েছে। একটা ছোট্ট জোনাকী নিয়ে এত সুন্দর গান শুধু তাঁরই লেখা সম্ভব।

আর শুভমিতার গাওয়া সেই গানটা, "প্রতিবার প্রেমে নতুন জীবন, জীবন কি করে একটাই।"
আমি তো প্রেমে পড়ি বারবার। আমি কবিতার প্রেমে পড়ি, কবিতার কবির প্রেমে পড়ি। যেই কবিকে কোনদিনো দেখিনি, তার কবিতা পড়ে তার জন্য আমি প্রতিদিন শুভ অনুভব রেখে দেই। শুধু রবি ঠাকুর না। পৃথিবীর সব কবিদের জন্য আমার অনেক ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা এতই গভীর। আমি প্রিয় সব কবিতা আত্মস্ত করে ফেলি, মুগ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াই আর ভাবি কি করে পারেন তারা? কি করে এমন শব্দের সাথে শব্দ জোড়া দিয়ে কবিতা লেখেন তারা?

তুমিও তো প্রেমে পড়ো। পড়োনা? সেবার আন্দামান এ বেড়াতে গিয়ে তুমি এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলে। কি কারণে আমি তোমার সাথে বের হইনি। কোন জংগলে এক সিংহলী মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তোমার। পথ হারিয়েছিলে দু'জনই। কয়েকটা ঘন্টা। এখনো তার কথা মনে হলে তুমি উদাস বাউল হও। আর আমি তোমার সেই অদ্ভুত  প্রণয়ের কথা জেনেও তোমাকে আরো বেশি বেশি ভালোবাসি। তোমাকে কেউ ভালোবাসছে এই অনুভবটুকু আমাকে ঈর্ষার বদলে আনন্দ দেয়। এই আমি! তোমার আমি!

পথ সবাই হাঁটে। পথ না হাঁটলে পথিক হওয়া যায় না। আর পথিকের স্বভাবই হলো পথ হারানো। আর তোমার মত অদ্ভুত মানুষ,যার স্বভাব হলো বাঁচা। প্রতিক্ষন বাঁচতে শিখিয়েছো তুমি আমাকে।আর একবার মিশরের সেই তপ্ত মরুভূমিতে গিয়ে আমাদর দেখা হয়েছিল ইংলিশ এক গাইড এর সংগে। এর আগে সিনেমা ছাড়া এত লম্বা আর সুন্দরী মেয়ে আমিও দেখিনি। মিশর থেকে ফেরার পথে তোমার লেখাতে কতবার মার্গারেট ঘুরে ফিরে এসেছে। আমি তোমার গোপন প্রণয় কাছে থেকে দেখেছি বলেই কি আমার এতটুকু ঈর্ষা হয়নি?
নাকি সেই যে প্রিয় বোধ, ভালোবাসা, যা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে। বুঝতে শিখিয়েছে, ভালোবাসা হলো সমুদ্রের মতন। ভালোবাসতে শিখলে কোন দুঃখই ছুঁতে পারেনা মানুষকে। ভালোবাসা হলো পরশ পাথর। ভালোবাসতে সবাই  জানেনা। ভালোবাসতে যারা পারে তারে জানে এতে কত আনন্দ।
“মেঘে মেঘে সোনা ও ভাই যায়না মানিক গোনা। পাতা পাতায় হাসি ও ভাই পুলক রাশি রাশি।"
পাতায় পাতায় এ হাসি দেখতে পারি বলেই তো ভালোবাসায় এত আনন্দ পাই। আমরাতো ঈশ্বরের প্রেমেও পড়ি।পড়িনা? মানুষকে ভালোবাসলে বোধহয় সবচেয়ে খুশি হন তিনি।

তুমি আমাকে বলেছো ,ভালোবাসতে হলে শুধু কাছে থাকতে হয়না। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। তুমি আরো বলেছো,পৃথিবীর যত সুখি মানুষ দেখো,তারা সবাই এভাবেই খন্ড খন্ড ভালোবাসা একসাথে করে বাঁচে। নাহলে একজন সুখি মানুষও করে গাইতে পারে,"আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ।"

আমরা এ ভাবেই কত স্বপ্ন কাহনের মধ্যে দিয়ে বাঁচি।
ভালোবাসার পরম শক্তিতে।কখনো ছুঁয়ে কখনো না ছুঁয়ে। হৃদয়ের পরম বিশ্বাসে।

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা