অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
ওমর খৈয়াম এর রুবাইয়াৎ-র অনুবাদ ও সঙ্কলন - কামাল রাহমান


জাগো! অমারাতের আধার হতে নতুন এক প্রত্যুষের 
জন্য! নক্ষত্রগুলোর উড্ডয়নে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে ঐ প্রস্তর
এবং দেখো! পুবের এক শিকারী আলোর ফাঁদে ধরেছে
সুলতানের ঐ প্রাসাদ-শৃঙ্গ। জাগাও হে তোমার অন্তর!


ছিলেম স্বপ্নঘোরে যখন ভোরের বাঁ-কাঁধ ছুঁয়েছিল আকাশ
সরাইখানার ভেতর হতে শুনেছিলাম এক মধুর আহ্বান, 
‘জাগো হে ছোট্ট সোনামণিরা, জীবনসুধায় দ্রুত ভরে নাও 
পেয়ালা তোমার, এখুনি ফুরিয়ে যাবে মধুভাণ্ডের ঐ প্রতিদান।’


ডেকে উঠেছিল যখন ভোরের কাক ঐ আকাশে, সরাইখানার 
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো চেঁচিয়ে বলেছিল তখন, ‘আর
তো বেশি সময় নেই এখানে তোমার থাকার, দরোজা খোলো
এখুনি, এবং জেনো, ছেড়ে গেলে কখনো ফেরা হবে না আর।’  


নতুন বছর আবার ফিরিয়ে আনে পুরোনো সব প্রত্যাশা,
ভাবনা-প্রবণ আত্মারা আবার ফিরে পায় নিঃসঙ্গ মগ্নতা,
এবং যেখানে মূসার সাদা হাত বৃক্ষশাখা হতে দূরে সরিয়ে 
রাখে, এবং ধূসর মাটি থেকে শ্বাস নিয়ে যীশু পায় পূর্ণতা।


ইরম কানন ওর সব গোলাপ সহ হয়েছে বটে উধাও, রাজা
জামশিদের সাতচাকতি পেয়ালা কোথায় কেউ তা জানে না
এখন, তবুও এক লাল চুনি জন্মায় এখনো ঐ আঙুর বাগিচায়,
এবং এখনো ঐ বাগান ফুলে ভরে তোলে জলের ঐ কিনারা।


দাউদের ঠোঁটে ঝোলানো হয়েছে তালা: অথচ ঐ দেবরাজ্যে
এখনো পেহলভি সুরে ডেকে বলে বুলবুল গোলাপের কানে 
‘এনে দাও পেয়ালা ভরে পবিত্র সুরা ও লাল মদিরা!’ যেন
ক্ষয়ে যাওয়া রঙের ঐ ঝরনা প্রমূর্ত হয়ে ওঠে মুগ্ধ আবেশে।


এসো, পূর্ণ কর পেয়ালা তোমার, বসন্তের মধু-দহনে
দূরে ছুঁড়ে ফেলো অনুতাপের শীত-পোশাক। আকাশে
দেখো: সময়ের পাখি দূরে সরে গেছে এখন কোথায়,
পাখার উল্লাসে সে ভেসে রয়েছে ঐ ঘন নীল নিবিড়ে।


নিশাপুর অথবা ব্যাবিলন, হোক না সে যে-কোনো দেশ,
হোক না ওটা তেতো বা মিষ্টি, পেয়ালা তোমার হবে শেষ,
জীবনের সুধাপাত্র চুঁইয়ে ফোটায় ফোটায় জমবে নেশা, অতঃপর
জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া পাতাগুলো একে একে হয়ে রবে নিরুদ্দেশ।


হাজারটা গোলাপ নিয়ে আসে তোমার প্রতিটা সকাল, তখন তুমি বলো:
‘হ্যাঁ’। কিন্তু ভেবে বলো দেখি, গেছে কোথায় গতকালের গোলাপগুলো?
গ্রীষ্মের ঐ মাসগুলো নিয়ে আসে যে-সব গোলাপ তার সবই যে দূরে
সরিয়ে নেয় রাজা জামশিদ ও কায়কোবাদ, করে রাখে সব এলোমেলো!

১০
ঠিক আছে, নিয়ে যেতে দাও ওটা, কীই বা করার আছে আমাদের
সম্রাট কায়কোবাদ অথবা মহান কায়খসরুর সঙ্গে? ঐ ধ্বজা ওদের
বরং জুল অথবা রুস্তমই উড়িয়ে দেবে, যেমনটি করে থাকে ওরা,
অথবা চিৎকার করে বলবে হাতিম তাই, ‘শোনো না কথা ওদের’।

১১
তৃণগুল্মের খোসার মতো অনাদরে দূরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আমাকে,
যেমন করে একটা শস্যপ্রান্তরকে বিভক্ত করা হয়েছে মরুভূমি হতে
যেখানে মানুষ ভুলে গেছে দাস ও তার সুলতানকে, এবং মাহমুদকে
তাঁর ঐ স্বর্ণসিংহাসনে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও গভীর প্রশান্তি জানাতে!

১২
ছায়ানিবিড় গাছের নিচে একটা কবিতার বই, এক পাত্র সুরা,
এক টুকরো রুটি ও প্রিয় তুমি, ও তোমার সুরের ঝরনা ধারা
ছড়িয়ে পড়েছে যেমন গাইছো তুমি এই মধুমোহন বনপ্রান্তরে;
মধুকুঞ্জের এই প্রান্তরই যেনো থাকে আমার স্বর্গ জুড়ে, আহা!


১৩
কেউ বা কাঙাল এ পৃথিবীর খ্যাতি ও যশের 
আর কেউ বা ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঐ স্বর্গ-সুখের; 
নাও হে তুমি নগদটুকু, থেকোনা আর ধারের 
ধ্যানে, কান দিওনা গর্জনে ঐ দূরের ঢাকের!

১৪
তাকাও: আমাদের জন্য ফোটা ঐ গোলাপগুলোর দিকে;
দেখো হাসছে ওরা! তুমি বল, ‘যখনই আমি গোলাপ হয়ে
ফুটি এ পৃথিবীতে, ঠিক তখুনি আমার সিল্কের বটুয়াটি
ছিঁড়ে যায় ও মণিমুক্তোগুলো ছড়িয়ে পড়ে বাগানের ঘাসে!’

১৫
এবং, এ জীবনে যারা পেয়ে এসেছে শুধু স্বর্ণ-রেণু,
সুর হয়ে ভেসে বেরিয়েছে বাতাসে, যেমন বৃষ্টির বেণু
জেনো: ওভাবে কখনো আসেনি ওসব এ পৃথিবীতে; 
সমাধিস্থ কারো চোখে কখনো ভাসেনা কোনো রংধনু।

১৬
জাগতিক প্রাপ্তি-প্রত্যাশী মানুষগুলো ছুটে বেড়ায় কুহকী আশার পেছনে,
প্রাপ্তিযোগ হয়তো ঘটে কখনো ওদের, নয়তো ওরা পরিণত হয় ভস্মে; 
সাদা নকুলদানার মতো প্রাপ্তি ওদের তুষার হয়ে ঝরে মরুর ধূলিধূসরিত 
বুকে; মুহূর্ত মাত্র আয়ু নিয়ে এসেছিল ওরা কাদা ও জলের এ পৃথিবীতে।

১৭
দুদিনের এই জীর্ণ কুটির তোমার, দিনে ও রাতে
এর দরোজাটি দেখায় দুরকম, এমনকি রাজা আসে
ও রাজা যায় ঐ একই পথে; সবার নিয়তি নির্ধারিত 
সময়ের শেষে সব পথ অবশেষে এক হয়ে মিশে।

১৮
সিংহ ও সরিসৃপেরা ঘুরে বেড়ায় যেখানে এখন, একদা বিজয়
ও পানোল্লাসে মত্ত ছিল ডাকাবুকো রাজা জামশিদ; এবং ঐ দুর্জয়
শিকারী বাহরাম, সমাধিতে যার বুনো গাধার পদাঘাতও পারেনি
ভাঙ্গাতে ওর চিরঘুম, ওরা এখন কোথায়, কেন এতো অসহায়?

১৯
এত রঙিন হয়ে কখনো ফুটতে পারে না বুনো গোলাপ 
যেখানে ঝরেছিল কোনো এক সম্রাটের হৃদয় হতে লাল
রক্ত! হয়তো ওখানে কোনো সুকন্যার খোঁপামঞ্জরী হতে
তপ্ত কফোটা অশ্রু মুক্তো হয়ে ঝরে করেছিল আকুল বিলাপ।

২০
এই চির-সবুজ গুল্মগুলোর কোমল শরীর ফুটে উঠেছে এখন
নদীর কোমল ঠোঁটে; আয়েস করে আমরা ওখানে বসি যখন,
ওরা বলে, ‘আহা, হাল্কা হয়ে বসো! চাপ দিও না বেশি, জানিনে 
ওরা অচেনা কার সবুজ ঠোঁট হতে পল্লবিত হয়েছিল কখন!’ 

২১
প্রিয় আমার: পূর্ণ করো আজ সকালের এ পেয়ালাটি, ওটা মুছে দেবে
তোমার ভবিষ্যতের শঙ্কা ও অতীতের দুঃখস্মৃতিগুলো, এবং আগামীদিনে
নিঃশেষে ভুলে যেও ওটা, আমিও হয়তো থাকবো সেখানে, গত শতকের
অনুপম বিস্মৃতিগুলো নিয়ে। একান্তই একা, এবং কেবলি নিজেরি সঙ্গে।

২২
কারো কারো জন্য, হে প্রিয়, আমরা ভালোবেসেছি
সুন্দর, কখনো ওদের অমূল্য সময়ে ফিরিয়ে দিয়েছি
তৃষ্ণা, অথচ ওরা পান করেছে এক কি দু-পেয়ালা,
অতঃপর নীরবে সরে গেছে দূরে, একান্তে, ও একাকী।

২৩
এবং আমরা, এখনো আনন্দোৎসব করে চলেছি এখানে,
অন্যেরা চলে গেছে এবং গ্রীষ্ম এসেছে নতুন পোশাকে;
সাঙ্গ হলে প্রেমের মধুমেলা, অবরোহণে ছেড়ে যেতে হবে 
আমাদেরও এ পৃথিবীর পান্থশালা ও দুদণ্ডের খেলা ফেলে।

২৪
ভোগ করে নাও এখুনি, ধুলোর এ ধরা গড়িয়ে যায় ক্লান্তিহীন।
বুঝে নাও ত্বরা, যার যেটুকু এখনও রয়েছে বাকি। ধুলোমলিন
এ পৃথিবীতে তুমি, আমি ও সবাই মিশে যাবো একদিন কালের 
ঐ ধুলোয়: অমিয় সুধা, সাকি ও সংগীত, এবং সমাপ্তি-বিহীন।

২৫
নিজেদের প্রস্তুত করেছে যারা আজকের জন্য, এবং যারা
তাকিয়ে রয়েছে আগামীদিনের জন্য, আঁধারচুড়ো হতে অচেনা
এক পুরোহিত চেঁচিয়ে ডাকে ওদের, ‘বোকারা, কোনো পুরস্কার
নেই তোমাদের জন্য: এখানে অথবা ওখানে; বেরিয়ে আসো ত্বরা।’

২৬
বুঝি না কেন ঐ প্রাজ্ঞ ঋষিরা দুই পৃথিবীর অর্থহীন তর্কে 
আত্মহারা হয়ে থাকে, বোকার মতো ওরা সামনে ঠেলে 
দেয় প্রেরিত পুরুষদের, ধুলো ভরা মুখে ওদের ঝুলে থাকে
অবজ্ঞা, অতঃপর নিক্ষিপ্ত হয় ওগুলো আবর্জনা ঝুড়িতে।

২৭
তরুণ বয়সে ঐসব গুণীজনের অনেক তর্ক শুনেছি,
শুনেছি ওদের মনগড়া সব কাহিনী, অথচ জানিনি
সত্য কিছু ওসব অলীকে। নিজেকে এখন ফিরে দেখি:
যেখানে ছিলাম এখনও সেখানেই রয়ে গেছি আমি!

২৮
জ্ঞানবৃক্ষের বীজগুলো রোপণ করেছিলাম আমি।
যত্ন দিয়ে ফসল ফলিয়েছি ওদের সঙ্গে, তুলেছি 
ওসব নিজ হাতে, বাতাসে ভেসে এখানে এসেছি 
আমি, এবং জলের স্রোতের সঙ্গে গড়িয়ে গেছি। 

২৯
জানিনে কেন আমি এসেছি এ পৃথিবীতে 
অথবা কখন জলের মতো গড়িয়ে যেতে
হবে, আবর্জনার মতো অনিচ্ছায় বাতাসে 
কখন ভেসে যাবো কোথায়: তাও জানিনে!

৩০
কে জানে কখন এখানে এলাম আমি, কোথা হতে?
এবং জানি না ফিরে যাবো কোথায় এখান থেকে। 
নিষিদ্ধ সুধায় কখন লুপ্ত হল জীবন-পেয়ালা! স্মৃতি ও
বিস্মৃতির দম্ভ হল কখন কালের ধূলিখেলা: কে জানে!

৩১
এ পৃথিবীর যাত্রাপথে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বাধা,
শনিরাজের লাল চোখ এড়িয়ে পেরোতে হয়েছে সাতটা
দরজা, অনেক কিছুই হয়েছে জানা, তবু রয়ে গেছে এখনো
অজানা এ জীবন ও মরণের অনিশ্চিত ঐ রহস্য-ধাঁধা।

৩২ 
ঐ দরোজাটির চাবি কখনো খুঁজে পাইনি আমি;
ঘোমটা তুলে দেখা হয়নি তোমার গোপন মাধুরি
কিছু কথা হয়েছিল তবু তোমাতে ও আমাতে,
ক্ষণিক পরে গেছে সেসব ঐ অধরা বাতাসে মিশি।

৩৩
দিতে পারেনি কোনো উত্তর এ পৃথিবী, অথবা
রোরুদ্যমান সমুদ্রের সবুজ ঐ ঢেউগুলো, অথবা
স্বর্গের ঐ অসহায় প্রভু। দিন ও রাতের আড়ালে 
লুকোয় দিবসের আলো ও রাতের ঘন তমসা।

৩৪
তিমির-ভাঙ্গা আলো হাতে লুকিয়ে থাকে পেছনে
আমার আমিটি। গোপন আড়াল সরিয়ে সে খুঁজে 
দেখে নিজেকে। চুপিচুপি শুনি আমি: আকাশের কানে 
বলে বাতিটি, ‘এই আমি অন্ধ যে আমারই ভেতরে!’

৩৫
ঠোঁট ছোঁয়াই আমি মাটির ঐ মোহন পেয়ালায়, কানে 
কানে শুধাই ওকে জীবনের রহস্য-গভীর ঐ গোপন; ঠোঁটে
ঠোঁট রেখে বলে সে, ‘পান করে যাও এই নিরালায়,
এ জীবন ফুরোলে আর এ মধুক্ষণ কখনো আসবে না ফিরে। 

৩৬
এই যে মাটির পানপাত্রটি, পলাতকা ধ্বনি তুলে বলে চুপিচুপি,
বাঁচো একবারই, এবং পান করো; এবং আহা! পরোক্ষে দিয়েছি
কত চুমো ঐ ঠোঁটে তোমার! এখন ভাবি, কত আর নিতে পারে 
ওটা, কতই বা পারে দিতে! সব জীবনই যে ফুরোয়, আসে ক্লান্তি!

৩৭
যেতে যেতে সেদিন দেখি এক কুম্ভকার ওর কঠিন দুটি
হাত দিয়ে প্রাণপণে চেপে চলেছে ভেজা কাদামাটি।
নরম তুলতুলে ঐ মাটি কেঁদে বলে তখন, ‘ভাইটি আমার,
একটু ধীরে, তোমার শরীরও যে একদিন হবে এই মাটি।’

৩৮
অতীত হতে জানিনি এমন কোনো অদ্ভুতুরে
কাহিনী যে কেমন করে ঈশ্বর এই ঝুরঝুরে
নরম মাটি হতে গড়েছিলেন জটিল এই মানুষ,
যে-কিনা টিকে আছে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে!

৩৯
তোমার হৃদয়-গভীরে লুকোনো মনস্তাপ নেভাতে
পেয়ালা শূন্য করে ঢেলে ফেলি যে মদিরা তা সঙ্গে 
সঙ্গে শুষে নেবে ঐ মাতাল মাটি। আমার জন্য
ছোট্ট একটা ফোটাও ফেলে রাখবে না সে সেখানে!

৪০
সদ্য ফোটা এক টিউলিপ যেমন ওর সকালের স্বর্গীয় সুরাটির 
জন্য অপলক তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে তেমন করে তোমার
অন্তর দিয়ে চেয়ো তুমি, নাহয় স্বর্গ উল্টে দেবে ওটা সহসা;
শূন্য এক পেয়ালা হাতে তখন অপূর্ণ রয়ে যাবে তৃষ্ণা তোমার।

৪১
অলীক ভাবনা, অথবা মানুষের ভেতর অকারণে ঠেঁসে
দেয়া জটিল সব ধাঁধা আর নেই কোথাও, পুরোনো বাতাসে
ছড়ানো জটাজাল ছিন্ন আজ, সাইপ্রাস বনে এখুনি চলে
আসো প্রিয়, হাতে নিয়ে সুধার পেয়ালা, ও মদির নয়নে।

৪২
যে সুধাটি পান কর তুমি, এবং চেপে ধর ঠোঁট যেভাবে, প্রিয় আমার,
ওগুলোর সবই শেষ হয়, ঠিক যেভাবে শুরু হয়েছিল গতকাল তোমার!
বল দেখি কোথায় তুমি আজ ঐ চক্রে, এবং কেমন ছিল গতকালটি?
এবং ঐ আগামীকালটি এখনও রয়েছে বাকি তোমার দেখা ও জানার।

৪৩
আঁধার কালের দেবতা যখন অমিয় সুধা-পাত্র হাতে খুঁজে
পাবে তোমাকে নদীর ঢালে, তখন তুমি ফিরিও না ওকে।
তুলে নিও ঠোঁটে তোমার ঐ মধু-মদিরা, উষ্ণ আলিঙ্গনে
চুমটি দিও ওর মিষ্টিমধুর ঠোঁটে, এক স্বর্গ রয়েছে ওখানে! 

৪৪
কারো আত্মা যদি ধুলো ঝেড়ে ফেলতে পারে কখনো
নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে স্বর্গের বাতাসে, জেনো
তবে: অসহায় এক পঙ্গুর মতো ঐ কাদামাটির খোলসে 
অবশেষে ওটা মেনে নিতে তোমার লজ্জা নেই কোনো।

৪৫
পরোয়ানা এলে এক সুলতানও ওর একদিনের তাঁবুটি ছেড়ে সুরসুরিয়ে বেরিয়ে
আসে; মৃত্যুরাজের প্রহরী এসে আবার সাজায় ওটা। নিয়মের ঐ চাকাটা ঘুরিয়ে
দেয় সে তখন নতুন কোনো অতিথির জন্য। ভয় পেয়ো না, এ চক্রে তোমার ও
আমার ও সবার নিবাস ঐ একটাই: হোক না সে এক আমির অথবা ভবঘুরে।

৪৬
তোমার ও আমার জীবনখাতার হিসেবটি মুছে দিতে
আমাদের অন্তরদহন কম ক্রিয়াশীল নয় কোনোভাবে;
সনাতন ঐ সাকি পৃথিবীর পেয়ালাটিতে ঢেলে দিয়েছে
সহস্র বুদবুদ, এবং ঢালবে আরো, আমাদের বিস্মরণে।

৪৭
তুমি ও আমি নিশ্চয় অতীত হয়ে যাবো অন্ধকারের আড়ালে,
এবং তার পরেও, আহা, আরো কত শত যুগ ধরে রয়ে যাবে
এই পৃথিবী, আমাদের এই আসা যাওয়ার তরে কে কবে করে
পরোয়া, সমুদ্র কী ভাবে কখনো তীরে তার এক নুড়ি নিক্ষেপে!

৪৮
মুহূর্তটির থেমে যাওয়া, এক নিমেষের আস্বাদন এ জীবন,
থাকা ও না থাকার মাঝখানে আমাদের শুধু একটি পলক!
এবং দেখো: দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছে পালকি, কী ভাবছো
এখনও! কিছুই যাবে না সঙ্গে তোমার, যখন আসবে ঐ ক্ষণ। 

৪৯
ভাবো দেখি, ঐ নিভৃত গোপন যে-কালটি কাটালে তুমি,
তা কী শুধুই এক চমক, নিশিথ রাতের ঐ উষ্ণ চুমোটি!
সত্য ও মিথ্যের বিভেদ যে কেবল একখানি চুল পরিমান, 
এবং ওখানেই রয়েছে ঝুলে তোমার ঐ জীবন-প্রদীপটি।

৫০
সত্য ও মিথ্যের ব্যবধান সম্ভবত এক চুল পরিমাণ
এবং একটা মাত্র আলেফ হয়তো বা ওটার গোপন
সূত্র কোনো। কখনো খুঁজে পাবে কী ওটা এক সমুদ্র
হতে? পারবে কী জেনে নিতে ওটার গোপন কৌশল!

কামাল রাহমান
সুইন্ডন, ইংল্যান্ড