অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
রবিনের বন্ধু - মহিদুর রহমান

“কোন জনমের পাপের ফল আমার”- রাগের মাথায় উচ্চস্বরে কথাটা বলেই মা একটা ভাঙা হুইল চেয়ারে বসিয়ে রাখে রবিনকে। বাড়ির সামনে পথের পাশে একটা মাটির দেওয়াল ঘেরা দোকান ঘর। আর দোকান ঘরের পাশেই একটা কদম গাছ। সেই কদম গাছের তলায় ভাঙা হুইল চেয়ারটায় দিনমান বসে থাকে রবিন। সে হাঁটতে পারে না। তার পা দুটি প্যারালাইজড।

গাছটি দীর্ঘ ও ছায়াঘন। পাতাগুলোতে কে যেন তেল মাখিয়ে রেখেছে। সবুজাভ আর চকচকে। কত পাখি কদম ডালে বসে, কত পাখি উড়ে যায় তার হিশাব কেবা কষে? রবিন কদমের ছায়ায় বসে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা হেলেদোলে তার পাশ ঘেঁষে দোকানটাতে আসে। কেউ আসে বাবার আঙুল ধরে নাচতে নাচতে। কেউ আসে মাকে জড়িয়ে। দোকানের এক কোণে একটা রসিতে  ঝোলে আছে চিপস্, চানাচুর, আলুজ, ডালমুঠ কতকিছু। ক্যাশ চেয়ারের সামনে একটা ডেস্ক। সেই ডেক্সে রং-বেরঙের কত্তগুলো বৈয়াম। সারি সারি সাজানো। বৈয়ামের ভেতর সেন্টার ফ্রুট, ওয়েফার রোল, কিন্ডারজয়, কিট ক্যাট, মেনটস, চুইংগাম যে কারও নজর কাড়ে। ভেতর দিকে একটা রিফ্রিজারেটরও আছে। ওটার ভেতরে না জানি কতকিছু। পেপসি, কোকাকোলা, ফানটা, স্প্রাইট, মেঙ্গো জুস এইসব। ছোলেমেয়েরা জটলা পাকিয়ে এটা সেটা কিনছে। বাবার আঙুল ধরে কেউ কেউ খুশিতে নাচতে নাচতে ফিরেও যাচ্ছে। রবিন শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তার খুব ইচ্ছে করছে সেও একটা সেন্টার ফ্রুট কিনবে অথবা একটা চিপস কিংবা এক বোতল ফানটা। কিন্তু রবিনের তো টাকা নেই! সে কিভাবে কিনবে? তাছাড়া সে হাঁটতেও তো পারে না। তার দুটো পা-ই অবশ। কথা বলতে গেলে মুখের ভেতর কথাগুলো কেমন জড়িয়ে যায়। রবিন শুধু বসে বসে ছেলেমেয়েদের কেনাকাটা দেখে। তখন তার খুব মন খারাপ হয়। 

রবিনের মনে অনেক কষ্ট। কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। পথচারী অনেকেই তার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। হঠাৎ কারো দয়া হলে একটাকা দুটাকা তার হাতে গুঁজে দেয়। এভাবে সারা দিনে দশ-বিশ টাকা জমা হয়। কিন্তু সেই টাকা খরচের অনুমতি নেই। মা নিষেধ করেছে। রবিনের কাছে টাকার কোনো মূল্য নেই। টাকাপয়সা নিয়ে সে ভাবেও না। তার একটাই দুঃখ সে আরও দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। মাকে জড়িয়ে কিংবা বাবার আঙুল চেপে হন হন করে হেঁটে যেতে পারে না। দোকানে কত জিনিস কিন্তু নিজের পছন্দমতো কিছু কিনতেও পারে না। এছাড়া তার কোনো বন্ধুও নেই। কেউ এগিয়ে এসে তার সাথে দু দণ্ড কথা পর্যন্ত বলে না। 

রবিন রোজই কদম গাছটার নিচে বসে থাকে। মা-ই বসিয়ে রেখে পরের বাড়িতে কাজে চলে যায়। বাসন ধোয়া, কাপড়কাঁচা, ঘরমুচা- এসব কাজ করতে করতে বেলা পড়ে যায়। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে রবিনের মন বেজায় খারাপ হয়। 

একদিন এক কাণ্ড ঘটলো! মনখারাপ করা এক রোদেলা দুপুরের বেলায় হঠাৎ সে মাথা তুলে উপর দিকে তাকাতেই দেখে একটা পাখি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাখিটির গায়ে যেন হলুদ মাখানো। ঠোঁট লাল। গোল গোল চোখের তারায় লাল রঙ মেশানো। খুব নজরকাড়া একটা পাখি। হঠাৎ পাখিটা বলে উঠলো, 
- মন খারাপ করিসনে ভাই। আমি তোমার বন্ধু হবো। গল্প করবো। তখন তোমার সব দুঃখ ঘুচে যাবে, বুঝছো?    

রবিন বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বপ্ন দেখছে না তো? নিজের শরীরে একটা চিমটি কাটে। চিমটিটা কাটে পায়ে। কিন্তু কিছু টের পায় না। তার দুখানা পা-ই তো অবশ, কিভাবে টের পাবে? তারপর সে নিজের হাতে একটি চিমটি কাটে। না সব ঠিক আছে। এটা স্বপ্ন নয়। সত্যি সত্যি পাখিটি তার সাথে কথা বলছে। পাখির কথায় রবিনের মন আনন্দে নেচে উঠে। পাখিটির মনেও অনেক আনন্দ হলো। সে এ ডাল থেকে ও ডালে লাফাতে লাগলো। একের পর এক দোল খেতে লাগলো। রবিন ভাবে তার যদি পাখির মতো ডানা থাকতো তাহলে উড়তে পারতো। তখন কত মজা হতো!

এসব ভাবনার ডানায় ভর করে উড়তে উড়তে কখন যে বেল পড়ে গেলো খেয়াল করেনি রবিন। হঠাৎ দেখে বিষন্ন মনে মা তার সমানে খাড়া। মায়ের পরনে রঙ জ্বলা একখানা তাঁতের শাড়ি-কাপড়। মাকে দেখে সে ফিক্ করে হেসে ফেলে। আজ রবিন খুব খুশি। মা অন্যান্য দিনের মতো আজও একটা বাটিতে ভাত-তরকারি এনেছে। কিন্তু ভাত খেতে মন নেই রবিনের। সে মাকে বলে, 

- জা... জা... জানো মা? আ... আ... আমি একটি ব... ব... বন্ধু ঝুটিয়েছি।

- কেমন বন্ধু তা শুনি? 

- পা.. পা... পাখি বন্ধু। হ... হ...  হলদে পাখি। 

রবিন মুখ তুলে কদম গাছটার দিকে তাকায়। হলদে পাখিটা তখন পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মাকে পাখিটা দেখাতে গিয়ে সে কিছুটা হতাশ হয়। বিমর্ষ মুখে মাকে বলে,

- পা... পা... পাখিটা তো ঐ ক... ক... কদম ডালেই ছিল? বি... বি... বিশ্বাস করো মা। পা... পা... পাখিটার গায়ে হ... হ...  হলুদ মাখানো। 

- ঠিক আছে। বুঝেছি। এটা কুটুম পাখি। হয়তো পাতার আড়ালে কোথাও আছে। এবার খাবারটা খেয়ে নাও। ঘরে যেতে হবে না? কত কাজ বাকি এখনও। আমার কপালটাই পোড়া বুঝলে?  

- আ... আ... আমাকে নিয়ে তোমার খুব ক... ক... কষ্ট তাই না মা?  

রবিনের চোখে ছল ছল জল। মায়ের চোখেও তখন জলের রেখা। এক অনিশ্চিত বভিষ্যতের দিকে রবিনকে নিয়েই মায়ের যাত্রা। রবিন বলে,

- আ... আ... আচ্চা মা, বাবা তোমাকে ছেড়ে চ... চ... চলে গেলো কেনো?

একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মা নিঃশব্দে ভাত তুলে দেয় রবিনের মুখে। রোজ ঠাণ্ডা ভাত খেতে মন চায় না রবিনের। তবু কয়েক কামড় খেয়ে মাকে বলে,

- আর না মা। ভা... ভা... ভাল্লাগছে না। পা... পা... পাখিটা তো ঐ ক... ক... কদম ডালেই ছিল?

মা কোলে করে রবিনকে বাড়ি নিয়ে যায়। রাবিন সারা রাত হলদে পাখিটাকে নিয়ে ভাবে। সকাল হলেই সে কদম গাছের তলায় গিয়ে ভাঙা হুইল চেয়ারটায় বসবে। কুটুম পাখির সাথে অনেক গল্প করবে। কুটুম পাখিকে বলবে তার বাবাকে এনে দিতে। বাবা আসলে অনেক মজা হবে। বাবার সাথে কুটুম পাখির গল্প করবে। আর বাবাকে একটা ভালো হুইল চেয়ার কিনে দিতে বলবে। 

পরদিন সকালে সেই পথেরই পাশে কদম গাছের তলায় ভাঙা হুইল চেয়ারটায় রবিনকে বসিয়ে মা চলে যাবার খানিক বাদে কুটুম পাখিটা কোত্থেকে এসেই মিষ্টি সুরে ডাক দেয়, 
- রবিন!

রবিনের চমক ভাঙে। খুশিতে তার মন নেচে উঠে। তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। সে ভাবে, ভাগ্যিস মা কাছে থাকলে পাখিটা মাকে দেখাতে পারতো। কুটুম পাখি রবিনকে বলে,

- তোমার মনে অনেক দুঃখ তাই না? তোমার নিজের জন্য দুঃখ, মায়ের জন্য দুঃখ, বাবার জন্য দুঃখ। আরও অনেক দুঃখ,  তাই না?

রবিন ছল ছল চোখে চেয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না। চুপ হয়ে কুটুম পাখির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। কুটুম পাখি আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,

- তোমার জন্য আমি কি করতে পারি বন্ধু?

রবিন চুপ মেরে বসে থাকে। একটা কিছু ভাবে। তারপর বলে, 

- আ... আ...  আমার বা... বা... বাবাকে এনে দিতে পারবে?

পাখি রবিনের কথা শুনে তাকে বলে,

- ধৈর্য ধরো। ধৈর্যের ফল মধুময় হয়। আমি এখনই যাচ্ছি।

কুটুম পাখি দেরি না করে রবিনের বাবার খোঁজে দূর আকাশে উড়াল দিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।

রাতে রবিন মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, -
 মা মা তুমি দেখো, বাবা শীঘ্রই ফিরে আসবে। কুটুম পাখিটা বাবাকেই আনতে গেছে, বুঝলে? 

মহিদুর রহমান
গল্পকার ও শিশুতোষ লেখক
মৌলভীবাজার, বাংলাদেশ