অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
কখন অন্য মনে - সুনির্মল বসু

সুচরিতাসু,

আজ বহুদিন বাদে তোমাকে চিঠি লিখছি। নাহ, কথাটা ভুল বললাম। চিঠি তোমার উদ্দেশ্যে আমি অনেক লিখেছি। কিন্তু সেই চিঠি তোমাকে পাঠানো হয়নি। আমার বালিশের নিচে অথবা তোষকের তলায় সেই চিঠি রয়ে গেছে।
আজ বিকেলে আকাশে খুব মেঘ করেছিল। সন্ধ্যে থেকে প্রবল ঝড় শুরু হয়েছে। আমার জানালা দিয়ে দেখছি, ঝড়ে তাল সুপুরি গাছের মাথাগুলো দুলছে।
বাঁশবনে বোধহয় একটা সাপে ব্যাঙ ধরেছে। ঘরে বসে ব্যাঙটার আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছি।
রবি ঠাকুরের কবিতা মনে পড়ছে, আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা, নিশীথ বেলা। এই বাদল ধারা আমাকে কেমন স্মৃতিমেদুর করে তুলেছে। 
মনে পড়ে অনুরাধা, তুমি যখন দুপুরের রোদে কলেজ থেকে ফিরতে, তখন দূরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আমি আনমনে সিগারেট টানতাম। এভাবেই একদিন আলাপ।

আপনি এভাবে প্রতিদিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন,
আমার মুখে কোনো কথা নেই।
বুঝেছি,
কি,
আপনি আমাকে ভালোবাসেন,
বাসি তো,
জানি, আপনি তো বঙ্গবাসী কলেজে বাংলায় অনার্স
পড়েন, পত্রিকায় কবিতা লেখেন,
হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে,
জানতে হয় মশাই, আমাকে আপনার কবিতা পড়াবেন তো,
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আপনি পড়তে চাইলে, অবশ্যই দেবো।
আমাকে আর আপনি বলা যাবে না,
মানে,
এখন থেকে তুমি বলতে হবে, এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না, যোগ্য হতে হবে।
তুমিও তাহলে আমাকে আর আপনি বলোনা,
ঠিক আছে, সপ্তাহে দুই দিন দেখা করলেই চলবে,
তাই,
হ্যাঁ, আমি ফোনে কথা বলে নেবো, আজ চলি।

সেই প্রথম আলাপ দুজনের। অনার্স পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ছি তখন, চাকরির চেষ্টা করছি। তুমি বললে, বাড়ি থেকে তোমার জন্য পাত্র দেখা চলছে। 
তারপর বহরমপুরের সম্ভাবনাময় ডাক্তার অনুভব মুখার্জির সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়েতে তুমি আমাকে নেমন্তন্ন করেছিলে, আমি তোমার বিয়েতে গিয়েছিলাম। শুভদৃষ্টি মালা বদলের মধ্যে দিয়ে তুমি পর হয়ে গেলে অনুরাধা। যেহেতু তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, তাই আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি কখনো।
সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা আমার বড় প্রিয়। সুনীলদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ ছিল। আমি আবৃত্তি করতাম,
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ, আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি, এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে ভালোবাসি, এই ওষ্ঠে এত মিথ্যা কি মানায়,
এরপর স্কুলে চাকরি পেলাম। আমার প্রথম উপন্যাস
শিকড়ে বৃষ্টির শব্দ বের হোল। সিনেমা তৈরি হলো।
প্রথম কবিতার বই বের হলো, ভালোবাসার কবিতা মালা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমার গল্প কবিতা প্রকাশিত হতে থাকলো।
আর, আজ সন্ধ্যায় খবরে ঘোষণা হল, সাহিত্যে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের কথা।
অনু, অনুরাধা, আমার ভাগ্যটা যেন কেমন। একসময় যা গভীর করে পেতে চেয়েছিলাম, সেদিন ঈশ্বর শূন্য হাতে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ, এতসব তো আমি চাইনি। আমি তো অল্পে খুশি একটা জীবন চেয়েছিলাম। না চাইতে আজ সব হাতের মুঠোয়। সকাল থেকে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে লোকজন এসেছিল সাক্ষাৎকার নিতে।
জিজ্ঞেস করছিল, লেখার প্রেরণা কে, আমি বলেছি, আমার দুর্ভাগ্য। জীবনে যা যা পাইনি, অথচ পেতে চেয়েছিলাম, সেগুলোই আমার লেখায় বারবার ফিরে ফিরে আসে। জীবনের সার্বিক পরাজয়, এত হার,এত কান্না, আমার লেখার প্রেরণা। হয়তো কখনো কখনো আমার লেখায় তুমিও এসেছো, তবে সেটা তুমি নও, অবিকল হয়তো তোমার ছায়া, জানো অনুরাধা, আমি একটা ছায়া জীবনের ঘোরের মধ্যে বেঁচে আছি। কারো জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবন কখনো মেলে না জানি, কিন্তু আমার জীবনটা যেন কেমন। গুছিয়ে লিখি বটে, কিন্তু জীবন আমার একেবারেই আগোছালো। তবু আজ এই সুখের দিনে, এই মেঘমেদুর স্মৃতিময় দিনে একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি আমায় ভুলতে পেরেছো, গড়িয়া হাটের বিকেল সন্ধে গুলোর কথা কি মনে পড়ে তোমার, মনে পড়ে, বসুশ্রী হলে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা, পথে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া, লেকের পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় বসে জলের ঢেউ গোনা, ঘনঘন বই পাল্টানোর নাম করে লাইব্রেরীর মাঠে' দেখা করা,
অনুরাধা, আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে। বাইরে বৃষ্টির দাপট আরও বেড়েছে। বাঁশবনে মর্মর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঝড়ে মনে হয়, বাবলা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো।
অনুরাধা, এত সাফল্য আমি তো কোনোদিন চাইনি, আমি শুধু তোমাকে পেতে  চেয়েছিলাম। মির্জা গালিবের কবিতা মনে পড়ছে,

তুম না আওগে তো মরনে‌ কিও শ ও তদবীরে,
ম ওৎ কুছ তুম তো নেহি হো কি বুলা ভি না সকু।

মানে কি জানো, তুমি না এলে একশো ভাবে মরণকে ডাকতে পারি, মৃত্যু তো তোমার মত কঠিন হৃদয় নয়, যে ডাকলেও সে আসবে না।
অনু, এখন অনেক রাত। দূরের গীর্জার ঢং ঢং ঘন্টা বাজল, শেষ প্রহরের। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। এবার শুতে যাবো। আজ আর তোমাকে ভালোবাসা জানাবার অধিকার আমার নেই, তাই প্রীতির পরশ জানিয়ে আমার বক্তব্যের বিরতির রেখাকে ইতির সময়সীমায় বেঁধে দিচ্ছি।
তুমি ভালো থেকো অনু, আমাকে ভুলে যেও অনুরাধা। ইতি,

সুনির্মল বসু
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত