অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় - ফাহমিদা রিআ

ড় গেটটা ঠেলে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো তুয়া। এক ঝলক দেখলো পিছন ফিরে। নিরব নিশ্চুপ অথচ করুণ চোখে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে পানকৌড়ি নামাঙ্কিত আকাশ রং তিনতলা বাড়িটা।
ঘুরে দাঁড়ালো তুয়া, দুচোখ ঝাপসা হওয়ার আগেই। হাত ইশারায় সামনের খালি রিকশাটাকে থামতে বলে উঠে বসলো। কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে রাখলো কোলের ওপর। 
এত ভোরে ছোট্ট শহরটা পুরো জেগে ওঠে নি। সাই সাই করে এগোচ্ছে রিকশা, দুপাশের বন্ধ দোকানপাট, স্কুল, কলেজ অতিক্রম করে। একে একে পিছনে রয়ে যাচ্ছে তুয়ার বেড়ে ওঠার এক একটা স্মৃতি। 
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে প্রায় ভরে আসা সুবর্ণপুর পরিবহনের লোকাল বাসটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গাড়ির হেলপার আর কন্ডাক্টরের অতি উৎসাহে শেষাবধি গাড়িতে উঠে বসতে হলো। 
কানে তালা ধরা শব্দে একাধারে হর্ণ বাজিয়ে চলেছে গাড়িটা। কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে এলে তুয়া রহিমপুরের পথটা আর একবার খোলাসা করে নিল। ঘন্টা তিনেক পর মিঠেপুরে নেমে ভ্যান যোগে সখিপুর। 
বাসটা বিকট হর্ণ বাজিয়ে এবার গড়াতে শুরু করলো। কিন্তু একটু পর পর আবার থামে, লোক উঠায়। যাত্রীরা চেঁচামেচি করে,----- কি হলো ড্রাইভার সাব, গাড়িতে আর জায়গা নাই অথচ লোক উঠিয়েই যাচ্ছেন
কন্ডাকটর আঙ্গুলের ফাঁকে অভিনব নকশায় টাকাগুলো এক এক করে সাজিয়ে দাঁড়ানো যাত্রীদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,---- জায়গা নাই তাই কি, আমরা লোক দেখি না, টাকা দেখি টাকা। টাকা হেঁটে হেঁটে গাড়িতে ওঠে আমরা পকেটে পুরি। হা হা হা
তুয়া অবাক হয় না শুনে,তবে মজা পায়। সবকিছু কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। এ পথেতো এর আগে কখনই আসে নি তুয়া। তবে কেন জানি চেনা জানা লাগছে। হুম মনে পড়েছে, খুব ছোট বেলায় বুবুকে আর তাকে মা এমন লোকাল বাসে করে নানী বাড়ি নিয়ে যেত। তুয়াতো গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তে ঘুমে কাদা হয়ে মায়ের কোলের মাঝে গুটিশুটি মেরে ঢুকে যেত। আর বুবু বেচারা ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে মাকে জড়িয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমে ঢলে পড়তো মায়ের গায়েই।
তারপর মা দুজনকেই জাগিয়ে দিয়ে বলতেন, টুনি তুয়া ওঠ ওঠ আমরা এসে গেছি। দু চোখ রগড়ে চারপাশ তাকাতেই ওদের ঘুম ছুটে যেত। আনন্দে চকচকে করে উঠতো দুজনের চোখ। আর হবে নাইবা কেন। নানী বাড়ি মানেইতো ছুটোছুটি, আদর আর মজার মজার খাবার দাবার।
বাবা যখন সংগে আসতেন তখন অবশ্য অন্যরকম। অফিসের গাড়িতে মহা আরামে। ঈদ পার্বন কিংবা স্বজনদের বিয়ের অনুষ্ঠান হলে এই সুবিধাটা ভোগ করতো ওরা। কিন্তু সমস্যা একটাই, বাবার অফিসেরতো ছুটি কম তাই ফেরার তাড়া থাকতো।
বুবুর স্কুল শুরু হবার পর থেকে এমন করে আসাটা আর হতো না। বছর দুই পর তুয়ারও স্কুল শুরু হয়ে গেল। ঈদ,পূজা, শীত গ্রীস্মের ছুটির জন্য ক্যালেন্ডারের পাতায় কত যে আঁকিবুকির হিসেব নিকেশ চলতো দু বোনের। 
আহ্ কি মজার ছিল সেদিনগুলি। ঘর লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনির গ্রীলে বসে চড়ুইগুলো কিচির মিচির করে ঘুম ভাঙ্গাতো ওদের। তবুও চোখ বুজে পাশ বালিশে মুখ গুজে মটকা মেরে পড়ে রইতো দুজনই মায়ের অপেক্ষায়।
মা তো সেই ভোরে ওঠে ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর আর ডাইনিং এ ত্রস্ত পদচারণায় রত। বাবাকে জাগিয়ে গসুলের তোয়ালে, কাপড়, গরম পানি রেডি দেয়া, অফিসের জামা জুতো টাই এর হ্যাংগার এগিয়ে রাখা, চা নাস্তা টেবিলে রেডি দিয়ে লাঞ্চের বক্স সাজিয়ে দেয়া কত যে হুটোপুটি।
ড্রয়িং রুমের দেয়াল ঘড়িতে যখন ঢং ঢং ঢং করে ঠিক সাতটা বাজতো মায়ের কন্ঠের ডাকও তখন থেকেই শুরু হতো।
দুজনের কপালে মমতা মাখা হাতটি ছুঁয়ে অগোছালো চুলগুলি সরিয়ে ডাকতেন,ও টুনটুনি, ও কাকাতুয়া চোখ মেলে দেখ্ কত্ত বেলা হয়ে গেছে। স্কুল যেতে হবে, মনে নেই? আমার বাবুই সোনা, মুনিয়া পাখি, পানকৌড়ি, হলদে পাখি, ময়না, টিয়া ওঠরে বাবা ওঠেÍা।
মা পাখি ভালো বাসতেন খুব।ওদেরকে আদর করে কত যে পাখির নামে ডাকতেন। আর তাইতো দুজনেরই ডাক নামগুলি মায়েরই দেয়া, পাখির নামে নাম। 
ওদের একতলা ছোট্ট বাড়িটা তিনতলা হলো, বাবা বললেন মাকে, এবার একটা নাম দরকার বাড়িটার।
মা হেসে বললেন, নামতো আমি ভেবেই রেখেছি।টুনটুনি, কাকাতুয়ার সাথে মিলিয়ে  পানকৌড়ি। মেয়েদের মত করেই একটু একটু করে বড় করলাম বাড়িটাকে বুকের মায়া মমতা মাখিয়ে।

আসলেও তাই, দাদীমা মারা যাবার পর গ্রামের পর্ব সবটুকু চুকিয়ে ফেললেন চাচারা। যে যার ভাগ টুকু নিয়ে নিজের মত করে আলাদা হলেন। মা সব বিক্রি করে বাড়িটায় হাত দিলেন। কাজ সম্পন্ন হয় না। নিজের বিয়ের গহনাগুলোও দিলেন বিক্রি করে। তারপরও থেমে থাকে। ঝক্কি পোহালেন অফিস লোনের ছুটোছুটিতে। অবশেষে পান কৌড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো।
কি ব্যস্ততার দিন তখন।
বাবা অফিস করে ফিরতেন দিন শেষে। স্কুলে দেয়া নেয়া, সপ্তাহে দুদিন আর্ট স্কুল, গানের স্কুল এসবের সবই করতেন মা। দিনান্তে বাবা ফিরে চায়ের টেবিলে বসে দিনপঞ্জি শুনতেন। কখনোবা নিজের অফিসের ঝামেলাগুলোও শেয়ার করতেন মায়ের সাথে।
ব্যতিক্রমও হতো। মা তার সুন্দর মুখটা মেঘে ঢেকে রাখতেন কোন কোন দিন। দুচোখে টলমল করা জল আড়ালও করতেন। ওরা নিজস্ব ক্ষমতায় সহজেই অনুমান করে নিতো বাবা মায়ের কুরুক্ষেত্রের বিষয়টা। মার মেজাজটা বাবার তুলনায় একটু কড়া থাকলেও খুব অল্পতেই আবার সমঝোতা করতেন। 
গড়াচ্ছিল দিন,বেড়ে ওঠছিল ওরা।
জে এস সিতে বুবু সবাইকে অবাক করে দেয়া রেজাল্ট করলো। বাবা মা খুব খুশি হলেন। মা তৎক্ষনাৎ বড় রকমের একটা স্বপ্ন এঁকে ফেললেন তাঁর মানসপটে। বাবাও সায় দিলেন, বেশতো তাই হবে।
তুয়াও বড় শহরের বড় স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলো। টুনিও আশানুরূপ ফলে পছন্দের প্রতিষ্ঠানে নিজের জায়গা করে নিলো। মাসে দুবার কখনো তিনবার বাবা আসেন বড় শহরের ছোট্ট বাড়িটায়।
এত এত বাজার করে ফ্রিজ ভরে দেন। বাইরে খেতে নিয়ে যান। কদিন ছুটি কাটিয়ে আবার চলে যান কর্মস্থলে। যাবার সময়  মা বক্সে বক্সে রেঁধে দেন কত পদের খাবার। বাবা ওভেনে গরম করে খান সেগুলো দীর্ঘ সময় একাকী।

ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে যায় টুনি পড়ার চাপে। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট নাস্তানাবুদ অবস্থা, সংগে মাও।
তুয়া একটু একটু করে খেয়াল করে বুবু আগের মত সবাইকে সময় দেয় না। একা থাকতেই পছন্দ করে। স্কুল ফাইনাল কটা মাস আর। অস্থির, উদভ্রান্ত থাকে।পড়ার চাপটা খুব বেশি ভার লাগে। মতের অমিল হয় মায়ের সাথে প্রায়ই। চেঁচামেচি করে একটুতেই। মান অভিমানটা মাত্রা ছাড়ায়।
তারপর একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে না বুবুর। মা চিৎকার করে ডাকতে থাকেন ছোট্টবেলার মত অনেক অনেক পাখির নামে। বুবু জাগে না। জাগেই না। 
সেসব মনে হলে তুয়ারও দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। মনে করতে চায় না তুয়া কিচ্ছু। 
যেন এক লহমায় তুয়ার পৃথিবীটা শুন্য হয়ে যায়। মা সেই যে নীরব হন, আর টু শব্দটিও করেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। 
বাবা ছুটে আসেন। 
কষ্টের সাগর সাঁতরে ফিরেও যান কর্মস্হলে।
যাবার বেলার বাবার কান্না ভেজা কথাগুলো তুয়ার কানে বাজে।
"তুয়া ----মাগো, তোর মায়ের ডাক্তার এখন তুই।পৃথিবীর কোন ডাক্তারের সাধ্য নাই তোকে ছাড়া তোর মায়ের চিকিৎসা করার।মাকে স্বাভাবিক করার একমাত্র দায়িত্ব এখন তোর।"
তুয়া বুবুর শুন্যতাগুলো মনের অনেক গহীনে পাথর চাপা দিয়ে রেখে মাকে ধীরে ধীরে চলতে শেখায়, বাঁচতে শেখায়। কিন্তু আগের মত পায় না। মা সবগুলো পাখির নাম ভুলে যান। একটা নামও আর উচ্চারণ করেন না। তবু আশার আলো জ্বালিয়ে এগোয় তুয়া।
কিছুদিন পরেই বুঝতে পারে আলোটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। টুনির হাতছানিটা উপেক্ষা করতে পারেন না মা শেষ পর্যন্ত। হারিয়ে যান মাও, শোকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিরবে নিঃশব্দে।
তুয়ার কলেজ ফাইনাল সবে শেষ হয়েছে তখন। অনুভুতিহীন, অসাড় হয়ে যেতে চায় ও,মনে প্রাণে প্রার্থনা জানায়, থেমে যাক ওর পৃথিবীটাও। 

না পৃথিবীটা থেমে যায় না তুয়ার। তাকে বুকে নিয়ে নিজেদের ছোট্ট শহরে ফিরে আসেন বাবা নিয়তির সবটুকু মেনে। বিধ্বস্ত বাবাকে অবলম্বন করে শেষ সলতেটুকু জ্বালায় তুয়া। উঠে দাঁড়ায় কুড়ানো শক্তিটুকুর সঞ্চয়ে বিচিত্র এক অমোঘ নিয়মে।
শোকের রেশ আকাশে বাতাসে না মিলাতেই তুয়া অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয় বাবার পরিকল্পনা জেনে। নিজের কানকে ক্ষনিকের জন্য অবিশ্বাস করে।
যে বাবা একার দায়িত্বেই  স্ত্রী সন্তান ছাড়া বছরের পর বছর পার করেছেন, সেই মানুষ এখন নিজের জীবনের সংশয় প্রকাশ করছেন স্ত্রীর সেবা যত্ন সহচার্য ছাড়া।  দেখভালের জন্য একান্ত আপন মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন তিনি নিতান্তই জীবন ধারনে অপারগ হয়ে। এবং ইতিমধ্যেই কিছু শুভাকাংখি সন্ধানও এনেছে তাদের কথিত ভাল ঘরের একটি মেয়ের।
তুয়ার কদিন আগের শোকে অবগাহন করা ছোট্ট কোমল কচি মনটায় হঠাৎ ধাক্কায় পায়ের নীচের মাটি সরে যাবার অনুভব অনুভুত হয়।
সামনের সোফায় নতমুখি বাবার মুখখানা বড্ড অচেনা লাগে।
মুখের পেশি শক্ত করে শুধু বলে, ---- 
"বাবা, আমার অনুমতির জন্য যদি সত্যি তোমার ইচ্ছে পুরনে বাধা হয়ে থাকে তবে বলি আমার কোন আপত্তি নেই। শুধু জানবে, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তুমি আনলেও আমি মায়ের জায়গা দিতে পারবো না। "

ব্যস, ঐ মুহুর্তে এটুকুই যথেষ্ট বাবার কাছে। চটজলদি উঠে দাঁড়ালেন, তুয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোর অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতাম না মা। 

এরপর তুয়ার জবাবের কোন সুযোগ না দিয়েই বের হয়ে গেলেন খানিকটা দ্রুত গতিতেই।

এবার তুয়ার দেখবার পালা।ধৈর্য্য পরীক্ষা আর সীমা অতিক্রমের সহনীয়তার শুরু।
সাজ সাজ রব পড়ে গেল পরদিন সকাল থেকেই। গ্রামের আত্মীয় স্বজনেরাও এলো কেউ কেউ। বাবাকে ঘিরে রইলো অতি উৎসাহী বন্ধু কজন। সন্ধ্যার আগে আগে তুয়াকে অবাক করে দিয়ে এলেন ছোট খালা। তুয়াকে জড়িয়ে কাঁদলেন ঘরের কোণে।
বাবার গোছানো পরিকল্পনায় আরও নতুন করে বাবাকে চিনতে শিখালো তুয়াকে। 

ছোট খালা সাধারণ জ্ঞান দিয়ে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝেছেন, তুয়াটা কোন আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছে।
শোকের বিলাপের সময় নয় এটা তুয়ার পাশে দাঁড়াতে তাইতো বুকে পাথর বেঁধে আগমন ছোট খালার সন্তান সংসার ফেলে রেখেই।

পরদিন সকালে দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই বাড়িটা কেমন অচেনা ঠেকলো তুয়ার। ফুলে ফুলে ছাওয়া গেট আর আলোকসজ্জায় ছাওয়া লাল নীল মরিচ বাতিতে কমাস আগের শোকের বাড়ি হঠাৎ করেই যেন ভোল পাল্টে আনন্দ বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে।
হঠাৎ কি মনে করে একছুটে বেরিয়ে গেল তুয়া দখিনে মার ঘরটার দিকে। ফ্যানের বাতাসে দোল খাওয়া পর্দার ফাঁক গলিয়ে বাবার ঘুমন্ত মুখটা দেখা যাচ্ছে একটু একটু। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে ভাবতে চাইলো বাবার পাশে মায়ের অস্তিত্বটাকে। খাটের একপাশে ওয়ার্ডরোবে তেমনি থরে থরে গোছানো আছে মার শাড়ি জামা কাপড়। ডানকোনে রাখা স্টীল আলমারিটায় মায়ের ব্যবহৃত দুগাছি চুড়ি, ফিরোজা পাথর বসানো কানের দুল, মুক্তা বসানো নাকফুল আর চিকন চেইনের সাথে লাগানো ছোট্ট লকেটটা সর্বক্ষন বুকের মাঝখানটায় দোল খেতো, মায়ের কাজের ব্যস্ততার তালে তালে। বাড়িটা সম্পন্ন হবার পর মা সংসার খরচ থেকে প্রতিমাসেই নিয়ম করে টাকা রাখতেন। অফিসের বোনাস বা ফান্ডে কিছু জমলে স্বর্ণকার কাকার আছে অর্ডার দিয়ে আসতেন এক একটা গহনার পদের। বলতেন, বিয়ের গহনার বাক্সতো মাথা গুজার ঠাঁই করতে গিয়ে খালি করেছি। এবার মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিতে গহনার বাক্সটা একটু একটু ভরতে থাকি। 
কয়েক পদের গহনায় মা সত্যি সত্যি একদিন ভরিয়ে ফেললেন লাল ভেলভেটের শুন্য বাক্সটা। সযতনে তুলে রাখলেন আলমারীর বাঁদিকের কোনের ছোট্ট সিন্দুকের চেম্বারটায়।
খাটের শিয়রের দিকে ঐতো ঢাউস আয়নার ড্রেসিং টেবিল। দু তিন রঙ এর লিপিস্টিক, আইভ্রু পেন্সিল, লিপ লাইনার, কাজল, ডে নাইট ক্রীম, গোলাপি আর আকাশি রঙা চিরুনি দুটো তেমনি সাজানো আছে।
এক্কেবারে কোনে রাখা পুরনো আলনায় পাট করে রাখা শাড়ি ক খানা। জলপাইরঙা কিংবা সমুদ্র নীল শাড়িটা, কিংবা মেরুন রং এর কারুকাজ খচিত শাড়ীর আঁচল মাথায় নিয়ে ফজরের নামাজ শেষে ছুটির দিনগুলিতে মা ব্যালকনির এক কোণে ধোয়া উঠা গরম চা এর মগটা রেখে টবের গাছগুলিকে পরম মমতায় পানি দিতেন, মুছে দিতেন পাতায় ঢেকে থাকা ধূলো বালি। মুহূর্তেই ঝা চকচক হয়ে উঠতো কচকচে সবুজ পাতাগুলি।
------ তুয়া, এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে কেন রে মা?
হাতে তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা।
তুয়া প্রথমটায় একটু চমকে উঠলেও সামলে নিল নিজেকে।
-----এমনি বাবা। খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো তো তাই গাছগুলোয় পানি দিতে এলাম।
------কিন্তু গাছতো সব ছাদে দিতে বললাম নুরীকে। ঘর সাজাবার ছেলেগুলো চলে আসবে নয়টা নাগাদ।
হঠাৎ কি যে হলো তুয়ার। সবটুকু শক্তি কন্ঠে ঢেলে চেঁচিয়ে ওঠলো
------ না, কিচ্ছু সরবে না এখান থেকে। যেমন ছিল তেমনি থাকবে। তুমি ওদের নিষেধ করে দাও বাবা এ ঘর আমি সাজাতে দিবো না, কক্ষনো না, কখনোই না।
ধরে আসা গলায় ছুটে চলে এলো তুয়া নিজের ঘরে। গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দু হাতে চোখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অঝোরে।
অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,মাগো--- বুবু নরম মনে কঠিন কিছু নিতে পারত না বলে তুমি যে আমাকে এতটা শক্ত হতে শেখালে,কিন্তু আমি যে আর পারছি না মা।
----- পারতে তোকে হবেই তুয়া, নাহলে আমি যে শান্তি পাবোনা।
মায়ের কন্ঠে, মায়ের পরশে অনুভবে চমকে তাকায় তুয়া। ফুলের পসরা সাজিয়ে জনা চারেক ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে এগিয়ে যায় ওদিকে। ঠিক তখুনি বুকের মাঝখানে চিনচিনে ব্যাথাটা কেমন অস্থির করে তোলে।
মায়ের পছন্দের নীল রঙা টয়োটাটা সাদা বেলীতে ঢেকে ফেলেছে ওরা।
না আর কিচ্ছু দেখতে চায় না তুয়া, দেখবেই না।
কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছিল। ছোট খালার ডাকে চোখ মেললো। 
সামনে লাল কাতানের আধো ঘোমটা, কপালে মস্ত টিকলি। তবে অপরিচিত মহিলার গায়ের গয়নাগুলো বড্ড চেনা। বকুল ফুল কারুকাজের বালা জোড়াতো মা অনেক নকশা খুঁজে খুঁজে পছন্দ করেছিলেন। মিনা করা কানের ঝুমকা, গলার হার সবগুলোই মায়ের বড্ড সখের। মাঝে মাঝেই নেড়ে চেড়ে দেখে আবার তুলে রাখতেন।
পাশে শেরওয়ানি পরিহিত বাবার কথায় সম্বিৎ ফিরে তুয়ার। কিছুটা ভীত বিহ্বল ভঙ্গিতে বললেন,
----- তুয়া, তোর ছোট মা।
তুয়া খুব স্বাভাবিক গলায় বললো,
------ এক বাড়িতে থাকতে হবে যখন সম্মোধনতো জরুরী, উনি আন্টি। 

না, বাহুল্যতা দেখায়নি ওরা। চলে গেছে তখনি। শুধু নতুন কন্ঠে উচ্চারিত কথাগুলো তুয়ার কানে এসে লেগেছে দূর থেকে ।
"আমিও চ্যালেন্জ দিলাম, মা বলিয়েই ছাড়বো।"
শত দুঃখেও বাঁকা হাসি দিল তুয়া, চ্যালেন্জ? নতুন বৌ সেজে মা হবার চ্যালেন্জ? অদ্ভুততো!
এরপর শুরু হলো তুয়ার ধৈর্য্য পরীক্ষার পালা বদল। 

কদিন আগের বাবার আদরের ছোট্ট মেয়ে তুয়া আজ বাবার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে কত নিপুনভাবে।
মায়ের ঘরে অবশ্য প্রবেশাধিকার নেই কারো, নতুন বৌ এবং স্বাভবিক কারনে বাবারও।
তবে কতদিন এটা বজায় রাখতে পারবে তাতে যথেস্ট সন্দিহান তুয়া। বন্যার পানি যেমন আভাস দিতে দিতে হঠৎ করেই ঢুকে পড়ে প্রবল বেগে। তুয়া এমনি আভাস পাচ্ছিলো প্রতিদিনই, ছক উল্টে যাবার।
নতুন বৌ এত দ্রুত প্রভাবিত করে ফেলছিল বাবাকে যে তুয়ার অজান্তে বাড়িটার রং বদলালো, নতুন নতুন ফার্নিচার এলো, ঘর দোরের পর্দা বদল হলো। এমন কি আত্মীয় স্বজনদের আচার অনুষ্ঠানে কখন কোথায় যেতে হবে, তুয়াকে তার বিন্দু বিসর্গও জানতে দেয়া হয় না। নিজেকে শামুকের মত গুটানো প্রাণী, মনে হতে থাকে তুয়ার।
কবছরের ব্যবধানে বড় বোন আর মাকে হারানোর পর পরই একমাত্র অবলম্বন বাবার দূরে সরে যাওয়ার প্রবনতার প্রচন্ড মানসিক চাপে সে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়লো। ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে টিকতে পারলো না মেধা যুদ্ধে।
বিশাল টাকার অংকের বিনিময়ে বিদেশে ভর্তির সুযোগটা বাবা ফিরিয়ে দিলে নতুন বৌ তা লুফে নিয়ে নিজ সঞ্চয়ের একাংশ দেবার ঘোষনাও দিলেন। যে অংকটা নেহাৎ কম নয়।
স্তম্ভিত হয়ে গেল তুয়া। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হলেন তুয়ার বাবা।
তুয়ার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়,  কদিন পরেই যখন  উকিল কাকুর ফোন আসে। তুয়ার কাছে সব খোলাসা হয়ে যায়।
নতুন বৌয়ের চ্যালেন্জটা এবার হাড়ে হাড়ে টের পায় তুয়া। মায়ের রুম দখলের পরাজয় সুদে আসলে আদায় করার লড়াইটা উকিল কাকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। মায়ের প্রথম জীবনের অনেক সাধ্য সাধনার আর কত শত দিন দিনান্তের পরিশ্রমের ফল এই পানকৌড়ি র মালিকানার প্রাথমিক উইল করেছেন বাবা নতুন বৌ এর নামে।
কারন নতুন বৌএর যুক্তিটা বাবার কাছে অকাট্য মনে হয়েছে। বাবার অকস্মাৎ অনুপস্থিতিতে নিঃসন্তান নতুন বৌ তুয়াকে কন্যাসম আগলে রাখলেও তুয়া কখনোই বিমাতাকে তার কাছে ঠাঁই দিবে না। তার যথেষ্ট উদাহরনও তুয়া এরই মধ্যে নতুন বৌকে দেখিয়ে দিয়েছে।
তাছাড়া তুয়ার বয়স কম। আর নতুন বৌএর উদারতার আলোকে এই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত। বাবার সরল স্বীকারোক্তি 
উকিল কাকু বাবার পুরনো বন্ধু সুবাদে মায়ের সযত্ন আপ্যায়নে বিবেকের কাছে নিজেকে ঋনি ভাবেন। সেই দায় বোধ থেকেই বিষয়টা তুয়ার কানে দিলেন, ফাইনাল হবার আগেই কিছু করা দরকার।
তুয়া প্রথমটায় বাকরুদ্ধ হয়ে সব শুনলো। একবার ভাবলো খালাকে জানাবে। পরক্ষনেই মত পরিবর্তন করলো। কি ই বা করার আছে , কষ্ট পাওয়া ছাড়া।
মায়ের প্রিয় পানকৌড়ি আর মায়ের থাকবে না। 
অন্যের দখলের পানকৌড়িতে কি করে থাকবে তুয়া বাবার বর্তমানে এবং অবর্তমানে?
হঠাৎই সিদ্ধান্ত নেয় তুয়া,না আর এক মুহূর্তও নয়। কিছুদিন আগে ডাকে আসা এনজিওর চাকুরীর নিয়োগ পত্র। সিদ্ধান্ত ফাইনাল।
আগামী কাল ভোরেই সখীপুর যাবে। ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়। নইলে আগামী সপ্তাহে নতুন বৌ এর চ্যালেন্জটাকে স্বাগত জানিয়ে বাবা ফ্লাইটে তুলে দিবেন তুয়াকে। 
একটা এন জি ও তে পত্রিকা দেখে আবেদন করেছিল, ইন্টাভিউ দিয়েছিল তুয়া গত মাসে। কিছুদিন আগে জবাবও এসেছে। দূর গাঁয়ে পোষ্টিং জেনে আগ্রহটা মিইয়েও গিয়েছিল। 
কিন্তু আজ উকিল কাকুর কথার প্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, এক সেকেন্ডও আর এখানে নয়।
খামটা খুলে ঠিকানাটা বেশ কবার আউড়ে নেয় আপন মনে।
সুবর্ণপুর পরিবহনে রহিমপুর মিঠেপুর, এবং সবশেষে গন্তব্য সখীপুর।
কিন্তু........
মুহূর্তেই অর্থহীন হয়ে যায় বেঁচে থাকা, নিরর্থক লাগে জীবন, পানসে লাগে আাগামী। জয়েনিং তারিখটা  যে পার হয়ে গেছে তিনদিন আগেই।
তার সংগে নিয়তি বারে বারে এমনটাই কেন করে। মানসিক চাপটা নিতে পারে না আর। এতটুকুও ভরসা নেই এত বড় পৃথিবীর কোথাও।
এমন কি নিয়তির উপর আর নির্ভরশীলতাটুকুও হারিয়ে ফেলে তুয়া। গন্তব্য কি এসে গেছে? 
নাহ্ তুয়ার ঘোর কাটে না।   তলিয়ে যাচ্ছে অচেনায়। মিঠেপুরে স্বপ্নটা শুধই স্বপ্নই ছিলো, এতক্ষনে বোধ জানান দেয়। দূর থেকে আসা একটা চাপা কোলাহল। বড়বু চলে যাবার দিনটির মতই। মা চলে যাবার মতও।  ক্রমেই অস্পষ্ট হতে থাকে। 
কারা যেন একসাথে কথা বলছে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন তুয়া। চোখ জুড়ে নামছে ঘুম। ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে তুয়া অতল থেকে অতলে।
শত চেষ্টাতেও আর কেউ মেলতে পারবে না তুয়ার অভিমানী কান্নায় ভরা বন্ধ দুচোখ। 
ওর বাবা তখন সকালে তড়িঘড়ি করে  নাস্তা সেরে অফিসমুখো হচ্ছিলেন, তুয়ার ঘর থেকে নুরীর ভেসে আসা চিৎকারে ছুটে গিয়ে দেখেন তার জীবনাংশের প্রথম  অধ্যায়ের  সমাপ্তি ঘটে গেছে বাকি চিহ্নটুকুরও। 
দ্বিতীয় জীবন সাজাতে আর বাঁধ সাধবে না ফেলে আসা অতীতের কোন টুকরো অংশও।

আর তুয়া অজানায় হারিয়ে যেতে যেতে হয়তোবা অনুভব করছে মাথার উপরে খোলা আকাশ, বিশাল প্রান্তর কি অপরূপ সবুজে ঘেরা। কিংবা কিছুই নয়। অজানাতো অজানাই।
সুদূর থেকে ভেসে আসা রবি ঠাকুরের সুরের আচ্ছন্নতায় ভাসছে পানকৌড়ি নামের তিনতলা আকাশ রঙা একসময়ের কিচির মিচির সরগম ময়  বাড়িটা......

বিশ্ব ধাতার যজ্ঞশালা
আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা
জীবন যেন দেই আহুতি মুক্তি আশে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে----।

ফাহমিদা রিআ
ঢাকা, বাংলাদেশ