অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
বর্তমান সময় ও তরুণ প্রজন্ম - মোঃ আইনাল হক

ক যুবক ঢাকা থেকে রাজশাহী গামী বাসে উঠে সীটে বসেই ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, "ওস্তাদ একটা হিন্দি লাগান তো।" ড্রাইভার সাহেব কথা মত চালু করলেন, "পাস ওহ্ আনে লাগে যারা যারা, যারা যারা।" যুবকের পাশের সীটে বসা এক হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, "হে যুবক, যারা যারা কি বুঝলা; কিছু কি বুঝলা?" যুবকটি প্রতিত্তোরে বলল, "না বুঝলে কি হবে হুজুর, তবুও যে ভালো লাগে।"
আধুনিকতাকে ছাড়িয়ে বর্তমানে আমরা অত্যাধুনিক সময়ে বসবাস করছি। যা আমাদের কৃষ্টি, কালচার, বিহেভিয়ার, পোশাক এমনকি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। কোন সভ্যতার অবস্থান বুঝতে সাধারণত প্যারামিটার হিসেবে ব্যবহৃত পোশাক, ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং উপস্থাপিত সংস্কৃতিকে ধরা হয়। সেদিক দিয়ে বর্তমানে আমাদের আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, তরুণদের প্রদর্শিত আচরণ, ব্যবহৃত পোশাক এবং ভাবের আদান-প্রদানে প্রয়োগকৃত ভাষা থেকে এ কথা হলফ করে বলতে পারি। চারদিকে প্রযুক্তির ছড়াছড়িও তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। 

অবস্থান যা-ই হোক, সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তার উপাদানকে নিরাপত্তার সাথে সঠিক ব্যবস্থাপনা করা। সে বিচারে সময়ের সবচেয়ে বড় উপাদান মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ মানুষকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ হিসেবে রেখে যেতে পারা-ই বর্তমান সময়ের প্রধান দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুখ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইদ বলেছেন, "তরুণরা কেমন হবে সেটা নির্ভর করে যাঁরা প্রবীন, যাঁরা অভিভাবক তাদের উপর; আর তরুণদের উপর নির্ভর করে একটা দেশের ভবিষ্যত"।
এ প্রসঙ্গে কথাপ্রকাশ জীবনী গ্রন্থমালা প্রকল্প পরিচালক ড. মিজান রহমান বলেন, "আজকের দিনে নতুন প্রজন্মের প্রতি, বিশেষ করে শিশুদের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ আগামী দিনে তারাই জাতীয় উন্নয়নের অগ্রদূত। জাতি শুধু বাইরের ঐশ্বর্য সম্ভার, দালান-কোঠার সংখ্যা বৃদ্ধি করে বড় হয় না, বড় হয় অন্তরের শক্তিতে, নৈতিক চেতনায় আর জীবন পণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতায়। আত্মিক মূল্যবোধ ছাড়া জাতীয় সত্তার ভীত কখনও মজবুত হয় না। নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধ জীবনাশ্রয়ী হয়ে জাতির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে তবেই জাতি অর্জন করে মহত্ত্ব আর মহৎ কাজের যোগ্যতা"

হয়তো সময়ের চাহিদা মেটাতে নতুবা আকাশ সংস্কৃতির কু-প্রভাবে অথবা রুচির দুর্ভিক্ষে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে; কিংবা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বললে বোধ করি খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ ব্যবহৃত পোশাক, মাথায় প্রদর্শিত হেয়ার স্টাইল, এন্ড্রয়েড আসক্তি, প্রয়োগকৃত ভাষা, প্রদর্শিত আচরণ, প্রভূত নেশায় আসক্তি, ইভটিজিং প্রবণতা, সামাজিক অবস্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক অবনতি তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। যা বিবেকবান নাগরিক ও দূরদর্শী মানুষের কাছে একটা নেগেটিভ মেসেজ প্রদান করছে। এই পথভ্রান্ত, জাতিসত্তা বিবর্জিত, বেখেয়ালি, দায়িত্বহীন, বেয়াড়া,  ভবিষ্যতহীন তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আমরা আসলে কোন আলোর পথে হাঁটছি?

একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলেছেন, "যে জাতি তার ইতিহাসকে ভুলে সে তার অস্তিত্ব কে হারায়"।
তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা সাধনায় উদাসীনতা রীতিমতো ভীতি প্রদর্শন করছে। শিক্ষার প্রতি প্রজন্মের এ অনীহার দায়ভার কে নেবে? শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে দেশময় বিল্ডিংয়ের যে পসরা সাজানো তা কি কেবলই লোক দেখানো? তাহলে প্রকৃত শিক্ষার অবস্থান কোথায়? তবে কি দায়িত্বহীনতার দরুন অচিরেই আমরা আমাদের জাতিসত্তা তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিতে চলেছি?

নিজস্ব সংস্কৃতিক ঐতিহ্য যথা জারি গান, সারি গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, হাসন রাজা, লালন সংগীত আদৌ কি তরুণদের টানে? কিংবা এসব নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে-ই বা তারা কতটা ওয়াকিবহাল? বিদেশি অপসংস্কৃতির প্রভাবে এরা  তো বাংলায় কথা বলাকে পর্যন্ত আনস্মার্ট হিসেবে মনে করে। আর নিজেদের ঐতিহ্য! সে তো আস্তা কুঁড়ে জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত।
এখন হিন্দির লেটেস্ট ভার্সন ডিজে গান ছাড়া বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যাদের পথ পানে চেয়ে একটি জাতির ভবিষ্যৎ সেই নতুন প্রজন্মের নাকি ডিজে ছাড়া নাচের তাল উঠে না। সিনেমাটিক জীবন যাপন করতে গিয়ে পরকীয়া, লিভ টুগেদার, প্রতারণা, ছলনা, সহিংসতা, বহুবিবাহ, অনৈতিক সম্পর্ক, একক পরিবার ও বহুমুখী অশান্তিতে ভরে উঠেছে সামাজিক জীবন। পিতা-মাতার দাম্পতিক কোলাহ শিশু মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে নিজের অজান্তেই শিশুটির সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠা হচ্ছে না। পারিবারিক কলহ, তীব্র হতাশা, সামাজিক অব্যবস্থাপনা এর সামষ্টিক ফল হিসেবে নিরবে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। সামাজিক নানান অব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠা এসব অপরাধী চক্রের জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কে? 
শিক্ষা ক্ষেত্রে অহরহ সিলেবাস পরিবর্তন থেকে সৃষ্ট অনাস্থাও তাদের অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ী নয় কি? শিক্ষার নানান রকম অভাব, ত্রুটি-বিচ্যুতি, জাতি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম, আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করা ইত্যাদি বহু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সরকার শিক্ষার উন্নয়নে কমিটি গঠন করেন। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা সংস্কারের নামে এখন পর্যন্ত নয়টি শিক্ষানীতি কমিশন গঠিত হয়েছে। 
এতদ কিছুর পরও শিক্ষা ও তদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে  আদৌও কি বৈপ্লবিক কোন পরিবর্তন চোখে পড়েছে?
পারিবারিক, ধর্মীয় কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা; সকল ক্ষেত্রে অনুশাসন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জানি; পারিবারিক শাসনহীনতা-ছন্নছাড়া করে, ধর্মীয় শাসনের অভাব-অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়, আর প্রতিষ্ঠানিক শাসন না থাকলে-শিক্ষার্থীরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। ফলে তাদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হন, নারীরা ইভটিজিংয়ের স্বীকার হন, সম্মানহানি হয় বয়ঃজ্যোষ্ঠদের। এরই হাত ধরে ক্রমেই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে বৃদ্ধাশ্রমের। দিনের পর দিন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জাতিকে অতিবাহিত করতে হয়। 

সহনশীলতা ব্যক্তি জীবনের অন্যতম প্রধান ভালো গুণগুলোর একটি। যা ব্যক্তিকে অনন্য সুন্দর করে তুলে, মানুষ হিসেবে সমাজে উচ্চাসন লাভ করতে সাহায্য করে। আর এই সহনশীলতার শিক্ষা ছোটকাল থেকে শুরু করতে হয়। অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যাদের মুখপানে চেয়ে পুরো বাংলাদেশ; তারা বর্তমান প্রযুক্তির অযাচিত ব্যবহারে নিজেদের মধ্যে অস্থিরতা  তৈরি করছে। শর্ট ভিডিও, টিকটক, রিল ইত্যাদির সংক্ষিপ্তকরণ রূপে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলছে। ফলে যে কোন কাজে তাদের একাগ্রতা কমছে, ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে এবং সামগ্রিক আউটপুটে নেগেটিভিটি দেখা যাচ্ছে। মানুষের আচরনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে করা এক গবেষণার ফলাফল বলছে, "শর্ট ভিডিও মানুষের ধৈর্য কমায়"। 

বর্তমানের এ অস্থির সময়ের পায়ে সহনশীলতার বেড়ি পরিয়ে বাস্তবতার নিরিখে দিনযাপনের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তরুন প্রজন্মকে অতি সন্তর্পণে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে তাদের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুল একটা জাতিকে অনায়াসে ধ্বংসের দ্বার প্রান্ত পৌঁছে দিতে পারে। কাজেই বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্বশীল হয়ে সঠিক ও বেঠিক এর পার্থক্য নিরূপণ করার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে জাতির সার্বিক কল্যাণে সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় ধীর পায়ে বিরতিহীন হাঁটতে থাকবে সোনার বাংলাদেশ। 

মোঃ আইনাল হক 
রাজশাহী বাংলাদেশ