অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
আমাদের ময়নু ভাই – মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ

য়েকদিন ধরে ভাবছিলাম "আমার মুক্তিযুদ্ধ" বইয়ের লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখতের কথা যিনি আমাদের সবার কাছে ময়নু ভাই নামে পরিচিত। আমাদের অনেক প্রিয়জন ময়নু ভাই। ময়নু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটে বাঙলা কেরাভানের সুবাদে। একজন অতীব ভদ্র প্রিয়জন আমাদের এই ময়নু ভাই। যেদিন শুনলাম ময়নু ভাইয়ের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হওয়ার অনুষ্ঠান হবে সেদিন থেকেই ভাবছিলাম আচ্ছা আমার সাথে ময়নু ভাইয়ের মূল পার্থক্যটা কোথায়?

ময়নু ভাই যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তখন উনি ছিলেন একজন তারুণ্যে ভরপুর টগবগে তরুণ। আমার ভেতরেও ছিল তখন তারুণ্য আর যৌবনের ছোয়া। মুক্তিযুদ্ধের ডাক এসেছিল ময়নু ভাইয়ের কাছে, আমার কাছে সবার কাছে বিশেষ করে আমার মত ময়নু ভাইয়ের মত বয়সীদের কাছে বিশেষ ভাবে। স্বাধীনতার সেই ডাক মাতৃভূমির সেই ডাক ময়নু ভাই শুনতে পেরেছিলেন অনুভব করেছিলেন গভীর ভাবে। জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে বাবা মা ভাইবোন সবার আদর ভালবাসা ভুলে গিয়ে স্বাধীনতার সূর্যটাকে জয় করতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে। আমিও তো শুনেছিলাম মাতৃভূমির সেই ডাক "আমাকে উদ্ধার করো হে সন্তানেরা আমার"। কই, আমি তো হাতে তুলে নিলাম না অস্ত্র। কই জীবনের মায়া পিতা মাতা ভাইবোনদের মায়াকে পিছু ফেলে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার ডাকে আমি তো সাড়া দিলাম না। কিন্ত ময়নু ভাই সাড়া দিয়ে ছিলেন। এখানেই তার সাথে আমার পার্থক্য। যারা এই পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারেন জীবনে সমাজে তারাই প্রসিদ্ধতা লাভ করেন মহত প্রাণ হিসেবে বীর হিসেবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখা হয়ে থাকে এই মহত প্রাণ গুলোর। 
ময়নু ভাই, আপনি মহত আপনি আমাদের বাঙালীর গর্ব। আপনাকে আমাদের অভিবাদন।

ময়নু ভাইরা স্বাধীনতার সূর্যটাকে জয় করে নিয়ে এলেন। আমরা সেই সূর্যের আলোকছটায় আলোকিত হলাম। জীবন গড়লাম। সংসার পরিবার পরিজন হলো। জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবনকে বয়ে নিয়ে গেলাম। লাখো মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ফল ভোগ করলাম। কিন্ত ময়নু ভাই আমাদের মত গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবন বইয়ে নিলেন না। আমাদেরকে স্বাধীনতার সূর্যটাকে উপহার দিয়েই অস্ত্র জমা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। হাত থেকে অস্ত্র নামিয়ে হাতে তুলে নিলেন লেখনি। লিখলেন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। আমাকে আপনাকে নতুন প্রজন্মকে জানালেন কেমন ছিল রনাঙ্গনের সেই দিনগুলো। কেন যুদ্ধ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বদেশ ভূমির জন্য। ময়নু ভাই এক অনন্য উপহার "আমার মুক্তিযুদ্ধ" দিয়ে গেলেন জাতিকে। বলে গেলেন "স্বাধীনতা এক ডাকে আসে নি। স্বাধীনতা কেউ এসে হাতে তুলে দিয়ে যায় নি এ জাতিকে। স্বাধীনতা এসেছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে।

এখানেও দেখি ময়নু ভাইয়ের সাথে আমার পার্থক্য। আমি অস্ত্র হাতে তুলে নেইনি। কিন্ত আমি তো মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্ত কই? আমি তো আমার দিনগুলোর অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম না। স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলো কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতার কথা আগামি প্রজন্মকে জানানোর কথা কই আমি তো ভাবলাম না। ময়নু ভাই ঠিকই ভেবেছেন। তাই লিখে রেখে গেলেন "আমার মুক্তিযুদ্ধ"। এখানেই তফাৎ আবার আমার সাথে ময়নু ভাইদের মত ব্যাক্তিদের। তারা অনেকদূর দেখতে পান। আমি পাই না। তাই ময়নু ভাইরা লিখে যান এ জাতির জন্য সংগ্রামের ইতিহাস "আমার মুক্তিযুদ্ধ"। ময়নু ভাইরা বেঁচে থাকবেন এই জনপদে চিরদিন "যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী বহমান।"

ময়নু ভাই, আবারও সশ্রদ্ধ অভিবাদন আমার আপনাকে। সেই সাথে অভিবাদন জানাই আমার পরিচিত ফারুক ভাই, নূরুল হক ও সব মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যারা বেঁচে আছেন বা প্রাণ দিয়েছেন রণ ক্ষেত্রে বা চলে গেছেন পরপারে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করে।

এ ছিল আমার ময়নু ভাইকে নিয়ে সাম্প্রতিক ভাবনার কথা। আরেক ভাবনা আমাকে তাড়িত করছে অনেকগুলো বছর ধরে। সে ভাবনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিয়ে। আমি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস জানি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যেটুকু অবলোকন করেছি ও জানি তার প্রতিফলন কেন নেই ইতিহাসের পাতায়? কেন স্বাধীনতার ইতিহাস খন্ডিত আজ? এটা কারা করেছে বা করছে? কি তাদের উদ্দেশ্য? এই বাঙলার বুকে বিশ্বাসঘাতকদের আবির্ভাব ঘটেছে যুগে যুগে। তাই সিরাজদৌলার মত স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর পুরুষকে নেতৃত্বের শীর্ষে যারা ছিলেন তাদেরকে প্রাণ হারাতে হলো সেই মীরজাফরদের হাতে। স্বাধীনতার সূর্য যেন আবার অস্তমিত হওয়ার প্রান্তে এসে দাড়ালো। প্রাণ হারালো মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এই ঘাতকদের হাতে। বিভক্ত করা হলো জাতিকে স্বাধীনতার ইতিহাস খন্ডিত করার মাধ্যমে। বড় দুঃখ লাগে যখন দেখি আজ বিভক্ত মুক্তিযোদ্ধারাও এই ইতিহাস নিয়ে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতিরাও। আজকের প্রজন্ম জানে না কোনটা সঠিক ইতিহাস।

তাই ময়নু ভাই আপনি থেমে থাকবেন না। যুগ যুগ ধরে বাঙালীর মুক্তির রাজনীতি কারা করেছেন কার এবং কাদের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনারা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন সেই ইতিহাস লিখে জাতিকে বিভক্তির মহা অভিশাপ থেকে বাচিয়ে নিযে আসুন। আপনারাই পারবেন এই স্বাধীনতার ইতিহাস খন্ডিত করার অপচেষ্টা রহিত করতে। 
আমরা কেমন যেন এক জাতি। "অনেক দাম দিয়ে কিনেছি বাঙলা কারোর দানে পাওয়া নয়"। অথচ সেই বাঙলার স্বাধীনতা আমাদের ভাল লাগে না। আমরা তাকে দ্বিখন্ডিত করতে দ্বিধা বোধ করি না। অনেক রক্ত দিয়ে এনেছি একুশ। অথচ ভীন ভাষায় বলতে লিখতে গর্ব আমাদের। আজ বাঙলা আর বাঙলা নেই। সব বাঙলিশ পারলে পুরোপুরি ইংলীশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে এ জাতি। বাঙালিত্ব ঝেড়ে মুছে দূর করতে এক পায়ে খাড়া আজ এ জাতি। বাঙলা ছেড়ে পরদেশের অধিবাসী হওয়ার গর্বে বিভোর আমরা। এটা যে জাতি হিসেবে কতটুকু লজ্জার তা আমরা অনুধাবন করি না। আমরা যে ময়নু ভাইদের লাখো মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে ব্যর্থ হয়েছি তা কেন জানি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না। আমরা পরবাসী হওয়ার আত্মপ্রসাদে ভুগি।

তাই বলি। হায় সেলুকাস! বড়ই অদ্ভূত এ জাতি।

আরেকটা বিষয় যা আমার বিবেককে বেশ নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার রুপকার। তার ও তার পরিবারের আত্মত্যাগ অতুলনীয়। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম কিম্বা শেখ হাসিনার নাম বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর নাম আজ যেখানে সেখানে যা কিছুতেই জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা কাম্য নয়। আমার মত অনেকের মনে আঘাত করছে ও বিতর্কের সৃষ্টি করছে। এতে বঙ্গবন্ধুর সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এদিকে আশা করব নজর দিবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী দলটি। এই তোষামোদকারী ও সুযোগ সন্ধানীরাই ছিল বঙ্গবন্ধুর বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। তা যেন না ঘটে আবার। তাই সাবধান এই সুযোগ সন্ধানীদের থেকে। তা ছাড়া আওয়ামীলীগ নাম বদলিয়ে খাঁটি  বাঙলায় দলটির নাম করণ এখন সময়ের দাবী। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম বাঙলায়। এছাড়া দেশ এবং বিদেশে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান নাম করণ করা হউক যাতে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখা থাকে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে। 
পরিশেষে বলবো, ময়নু ভাই, আপনি থেমে থাকবেন না। আপনার লেখনি দিয়ে জাগ্রত করুন এ জাতিকে। লিখে যান আপনি আরও। আপনার সফলতা কামনা করি।
ময়নু ভাই, আপনাকে আবারও আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
জয় বাংলা। 

মোহাম্মমদ হারুনুর রশীদ
অটোয়া, কানাডা