অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
কাবুলের চিঠি - ১

আবদুল্লাহ আল মামুন

মি গ্রীষ্মের যে মুহূর্তে তোমাকে এই চিঠিখানি লিখছি, তুমি হয়তো তখন বাংলাদেশের গরমে দরদর করে ঘামছ। অথচ দেখ, প্রায় একই রকম বা তার চেয়ে বেশি গরমে থেকেও আমি আমার উঠোনের গাছের ছায়ায় বসে তোমাকে লিখছি, পরম স্বস্তির সাথে। এরকমই আনন্দের কাবুলের আবহাওয়া। বাতাসে আদ্রতা এখানে খুবই কম। অনেক গরম হলেও বাতাস শরিরের ঘাম মুহূর্তেই টেনেনেয় বলে একটা চনমনে ভাব কাজ করে। কাবুলে বছরের বেশিরভাগ সময়টাই এইরকম চনমনে ভাবটা বজায় থাকে। কিন্তু দেখ, এই দেশটার, আফগানিস্তানের নাম শুনলেই মানুষ কেমন আঁতকে উঠে!

একবার কি হয়েছে শুন, আমার বাগানে খুব বড় জাতের একটা গোলাপ ফুটেছে। বাংলাদেশের এক বন্ধুকে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে কথা প্রসঙ্গে বললাম সে কথা। সে তো সাথে সাথে আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে কবে হয়েছে এই ঘটনা, কেও মারা গেল কিনা, এইসব প্রশ্ন। আমি বুঝলাম যে, আমার “গোলাপ ফুটেছে” কথাটা তার কানে “গোলা ফুটেছে” বেজেছে। মনে মনে বলি, “এই সেরেছে!” এ যেন সুকুমার রায়ের ছড়ার এক অবিকল প্রেক্ষাপট, “ঠাস ঠাস, দ্রিম দ্রাম, শুনে লাগে খটকা, ফুল ফোঁটে! তাই বল, আমি ভাবি পটকা।” আসলে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আফগানিস্তান নামটা এতটাই “বোমা ফোটা” শব্দের সাথে শুনতে হয় যে, মনেই হয় না, ওখানেও মানুষ থাকে যারা গান গায়, কবিতা করে, ভালবাসে, ভালবেসে প্রাণও দেয়। সেখানে ফুল ফুটে, ফল ধরে। বরফগলা নদী যখন তরতর করে এগিয়ে যায়, চলার পথে থাকা পাথরের সাথে খুনসুটি করে ছলকে চলে ঘন সবুজ তুঁত-বাগানের পাশ ঘেঁষে, তখন বিমুগ্ধ কোন পথিক যেন মরনের পরও এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়, নিজের অজান্তেই বলে উঠে, “আমারে কবর দিও এই মাটিতে”। যেমনটা বলেছিলেন পরাক্রমশালী মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, সম্রাট জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর।

তুমি হয়তো পাঠ্যবইয়ের কল্ল্যাণে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস জান। ছোটবেলায় মোঘল সম্রাটদের নাম আর পরম্পরা, কার পরে কে এলেন, মনে রাখা বড় বেকায়দার বিষয় ছিল। কৌশল হিসেবে একটা লাইন মনে রাখতাম, “বাবার (বাবুর) হল (হুমায়ুন) আরেকবার (আকবর) জ্বর (জাহাঙ্গীর), সারিবে (শাহ্‌জাহান) ঔষধে (আওরঙ্গজেব)।“ এসব বিষয়ে বাড়তি কিছু লিখছি না, শুধু বাবরের কাবুলপ্রীতির অংশটুকু বলছি।

বাবর যত জায়গায় থেকেছের তার জীবনে, সেসবের মাঝে কাবুলকে রেখেছিলেন সর্বোত্তম স্থানে। তার জীবনের লেখা স্মৃতি কথা “বাবরনামা” থেকে জানা যায় যে কাবুলকে নিয়ে তিনি কতটা স্মৃতিকাতরতায় ভুগতেন। তিনি আগ্রায় থাকলেও তার মন পরে থাকতো কাবুলে। তিনি স্মরণ করতেন কাবুলের ফুল, ফল, জল, রুটি, মাংস ইত্যাদিসহ আরও আনেককিছু। ফলের মাঝে আঙ্গুরের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আর আঙ্গুরের সাথে সাথে আঙ্গুর-সুধার (Wine) কথাও তার বিবরনী থেকে বাদ যায় নি, উল্লেখ করেছেন ফার্সী ছত্রে! দাঁড়াও, অনুবাদ করে বলছি,

“কাবুলি-সুধার ঘ্রাণে কি যে আনন্দ ভারী!
সে মজা বুঝিবে কি, যে নিতান্তই আনাড়ি?” (পৃ. ২০৪)

বাবর কাবুলের মানুষের আচার-ব্যবহার ও ভদ্রতা জ্ঞানও মনে-প্রাণে উপলব্ধি করতেন। প্রসঙ্গত বলি, কাবুলে বা আফগানিস্তানে মানুষ একে অপরের সাথে দেখা হলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দুজনেই একসঙ্গে সোৎসাহে পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে থাকে। যেমন, দুজনেই বলতে থাকে, তুমি কেমন আছ, ভাল আছতো, সুস্থ আছতো, তোমার শরির কেমন আছে ইত্যাদিসহ আরও আনেক বাক্য। এখানে বলে যাওয়াটাই রীতি, শুনা বা উত্তর দেয়া নয়। যাইহোক, বাবরের শেষ ইচ্ছা ছিল কাবুলেই যেন তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তার মনের সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। বাবর ১৫৩০ সনে আগ্রাতে মারা যান, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে। প্রথমে তিনি আগ্রাতেই সমাধিস্থ হন। অতঃপর ১৫৪০ সনে কাবুলে তার সমাধি স্থানান্তরিত হয়। (চলবে…)

ছবিতে বাবরের সমাধি এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রদত্ত স্মৃতিফলক, বাবরের সমাধির বাইরের দেয়াল ঘেঁষে মসজিদ, মসজিদের ভিতরের দেয়াল, দেয়ালে দাঁড়ানো কাবুলী পোশাকে আমি (!), মসজিদের বাইরের দৃশ্য এবং কাবুলী আঙ্গুর।

আবদুল্লাহ আল মামুন
প্লানিং অ্যান্ড পলিসি এনালিস্ট, গভর্নমেন্ট অফ কানাডা
খন্ডকালীন অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়া

[এখানে উল্লেখ্য যে, লেখক আফগানিস্থানে একসময় একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। এই চিঠিটি সেসময় (ইংরেজি সন ২০১২ ) লেখা।]

অটোয়া, কানাডা