অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আশ্রম: একটি চেতনার নাম - প্রথম পর্ব

কবির চৌধুরী, প্রকাশক, আশ্রমবিডিডটকম, অটোয়া, কানাডা, ০৯/১২/২০২৩: 

“খুবই সুন্দর আয়োজন”, “গতকালকের অনুষ্ঠান এই পর্যন্ত আশ্রম আয়োজিত সব অনুষ্ঠানের চেয়ে সেরা অনুষ্ঠান”, “সাজি ভাবীর উপস্থাপনা ছিল, আনন্দ আর বেদনার এক অপূর্ব ঐকতান”, “অটোয়ার অধিকাংশ কণ্ঠশিল্পী ও আবৃত্তিকারদের এক মঞ্চে নিয়ে আসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ”, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর থেকে এভাবেই অটোয়ার অনেক সঙ্গীতপ্রিয় সুহৃদ বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন, আমাদেরকে ফোন করছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আশ্রমের শুভানুধ্যায়ীদের এই ভালবাসা আর আন্তরিকতায় আমি এতটাই আবেগাপ্লুত যে, আপনাদের মতো করে আমাদেরকে অভিনন্দিত ও উৎসাহিত করা, অটোয়া ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন তরুণ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন এবং অটোয়া ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী  স্টুডেন্টস  এসোসিয়েশনের সদস্য শিয়েতা আহমদের কথার সূত্র ধরেই আমি,আশ্রম: একটি চেতনার নাম,  নামে আমার লেখা নতুন ধারাবাহিক শনিবারের নিবন্ধের শুরু করতে চাই। লেখাটি আমাদের চারিদিকে সংঘটিত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিচ্ছবি। এই চারিদিকের মাঝে আমিও একজন। স্বাভাবিকভাবে তাই লেখার মাঝে আমার এবংআশ্রম পত্রিকার উপস্থিতি হবে উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্যণীয়। শনিবারের নিবন্ধটিতে রঙিন আর মলিন আবরণে ঢাকা অনেক সত্যের অবতারণা হবে, যেখানে আমরা খুঁজে পাবো নিজেকে… 

আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আমার বক্তব্যের পরই বিরতী। আমার অগোছালো বক্তব্য শেষ করে স্টেজ থেকে নীচে নামার সময়ই দেখতে পাই আবদুল্লাহ আল মামুন স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টেজ থেকে নামতে না নামতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, “অনুষ্ঠান খুবই ভাল হচ্ছে, আপনার বক্তব্যের কথাগুলো হৃদয় নিংড়ানো, কোন ভনিতা নেই। আমিও আশ্রমের জন্য কাজ করতে চাই, যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবেন, আমি আশ্রমকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।” আবদুল্লাহ আল মামুনের এই কথাগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় আশ্রমের নিয়মিত লেখক, কার্লটন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস  অধ্যাপক, লেখক ড. মীজান রহমানের কথা। স্যারও আমাকে এভাবে বলতেন, “বাপু যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ডাকো।” আশ্রমের এই লম্বা চলার পথে প্রয়াত লেখক ড. মীজান রহমানসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় লেখা এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে আশ্রমকে সমৃদ্ধ করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন। বয়সে আমার অনেক ছোট, টগবগে তরুণ অধ্যাপক মামুনের কথা শুনে মনে হলো বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অধ্যাপক মামুন, তাঁর মেধা, মনন আর স্বদিচ্ছার সমন্বয় করে আশ্রমকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

এখন শিয়েতা আহমদের কথায় আসা যাক, শিয়েতা আহমদ অটোয়া ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী। কৈলাস মিতাল থিয়েটারের লবিতে তার ইংরেজি এবং বাংলা কথা শুনে মনে হলো কানাডাতেই  জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আগে তাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শিয়েতার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হলো, ৩ ডিসেম্বর ২০২৩, আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হঠাৎ করেই মনে পড়ে অটোয়া শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের কথা। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা এবং এদেশে জন্ম নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী অটোয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত। ওদেরকে আমাদের অনুষ্ঠানের কথা জানানো উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। সাথে সাথেই অটোয়ার বিভিন্ন কলেজ- ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের ইমেইল এড্রেস সংগ্রহ করে তাদেরকে অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানাই। অটোয়া ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষে শিয়েতার কাছ থেকে ইমেইলের উত্তর পাই, সে লিখে, 
“Hello,
Thank you so much for the invitation! We have 5 members from our team who would love to attend the event. We were wondering how to buy tickets for those members. We look forward to seeing Bangladeshi arts and culture celebrated.” 

৩ তারিখে এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মাঝেও শিয়েতা, আমাদের খুবই পরিচিত গোলাম কিবরিয়া টিটুর ছেলে দীপুসহ তার আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিল। অনুষ্ঠানের পরের দিন সকালে ঘুম থেকেই উঠেই আমি আমার মেইলের ইনবক্সে শিয়েতার নতুন একটি ইমেইল দেখতে পাই, সে লিখেছে, 
“The program last Sunday was wonderful and beautifully done. We would like to thank you for inviting us and offering us time on stage to speak about our group, the University of Ottawa Bangladeshi Students Association (UOBSA). It means a lot to us to be able to be involved in our Bangladeshi community. We look forward to any upcoming Ashram events and would love to take part again.” 

শিয়েতার এই ইমেইলগুলো এবং আশ্রমের অনুষ্ঠানে তাদের স্বশরীরে উপস্থিতি, আমার বহুদিনের লালিত একটি স্বপ্নকে নতুনভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমার মনে পড়ে কয়েক বছর আগে অটোয়ার সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় ডেইলি ইংরেজি পত্রিকা  অটোয়া সিটিজেনের সাংবাদিক লুইস টেলর,  অটোয়া-গ্যাতিনো এরিয়াতে বসবাসকারী অভিবাসীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনের প্রয়োজনে সাংবাদিক টেলর আমার একটা ইন্টারভিউ নেন। সেখানে তিনি আশ্রম এবং আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করেন। তখন লুইস টেলরের করা একটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম “আশ্রমের মূল উদ্দেশ্য প্রবাসে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি, এদেশে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করা, আমরা আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশি-কানাডিয়ান ছেলেমেয়েদের সাথে নাড়ীর সংযোগ স্থাপন করতে চাই”! কে জানে হয়ত শিয়েতা আর দীপুই আমাদের সেই ভাবনার যোগসূত্র। যে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আবদুল্লাহ আল মামুন এবং শিয়েতার প্রসঙ্গের অবতারণা, সেই অনুষ্ঠানের কারণ এবং পরিকল্পনার আংশিক লিখেই আজকের মত বিদায় নেব। ৩ ডিসেম্বর ছিলো আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। আমাদের এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো আনন্দ করা। শুধু আনন্দ। শুধু গান। শুধু কবিতা। গান আর কবিতা দিয়েই পুরো অনুষ্ঠানটিকে সাজানো হবে। 

আমাদের জীবনে সংঘটিত সবকিছুর পিছনে কোন না কোন কারণ লুকিয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠান করার পিছনেও কিছু কারণ আছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পত্রিকা তার প্রকাশের ১৫ বছরে পা দিবে তাই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। না, আসলে এই ধারণাটি অনেকাংশে ঠিক নয়। আশ্রমের ১৫তম জন্মদিন উদযাপনের বিষয়টি হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে। হঠাৎ করে একারণেই লিখলাম যে, কৈলাস মিতাল থিয়েটার অনেক আগ থেকেই “আশ্রম একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের” জন্য বুকিং দেওয়া ছিল। আমার মনে আছে ২০২০ সালে কণ্ঠশিল্পী ডালিয়া ইয়াসমিনের একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের পরই আমি আশ্রমের পরের অনুষ্ঠানের জন্য কৈলাস মিতাল থিয়েটার বুকিং দিয়েছিলাম। এটাই আমার বিশেষত্ব, অনেকের মতে ‘পাগলামী’।  আমি একটি অনুষ্ঠান শেষ করেই পরের অনুষ্ঠানের জন্য কৈলাস মিতাল থিয়েটার বুকিং দিয়ে দেই। যার জন্যে দেখবেন আশ্রমের প্রতিটি গানের অনুষ্ঠানই কৈলাস মিতাল থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইচ্ছা ছিলো কণ্ঠশিল্পী ডালিয়া ইয়াসমিনের একক অনুষ্ঠানের পর আশ্রমের লেখক ও সৌখিন কণ্ঠশিল্পী সুপ্তা বড়ুয়াকে নিয়ে “আশ্রম একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের” আয়োজন করবো। সুপ্তা বড়ুয়াকে দিয়ে গান করার কারণ, “বাকাওভ” আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সুপ্তা বড়ুয়ার কণ্ঠে ফোক গান শুনে মনে হয়েছিল, তাকে দিয়ে একটি একক অনুষ্ঠান করা যায়। আমার এই ভাবনার কথা আমি আশ্রমে ও ‘বাকাওভের’ অনুষ্ঠান নিয়ে লেখা সংবাদে উল্লেখ করেছিলাম, লিখেছিলাম যে, আমি সুপ্তা বড়ুয়াকে নিয়ে 'আশ্রম একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের' আয়োজন করতে চাই। আমার লেখাটিতে তার অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা দেখে সুপ্তা বড়ুয়া পারিবারিক কারণে অনুষ্ঠান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এখন না, আগামীতে করবো। তবে যখনই আশ্রমের স্টেইজে আমার একক অনুষ্ঠান করি না কেন, তা আমার মেয়ে অরুণিমার স্মরণে করতে হবে এবং অনুষ্ঠানের সংগৃহিত ফান্ড অটোয়া চিলড্রেন হসপিটালের ‘রজার নেলসন হাউজে’ দিতে হবে”। ‘ফান্ড’ ‘রজার নেলসন হাউজে’ দেওয়ার কথা শুনেই বলি ঠিক আছে। আপনি শুধু বলবেন, কবে করতে চান। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাকে নিয়ে এই “ফান্ড রেইজিং” অনুষ্ঠানটি করবো। এর মধ্যে চলে আসে মহামারী কোভিড – লন্ডভন্ড করে দেয় মানুষের চিরাচেনা জীবনযাত্রা। যেহেতু জয় করা আর টিকে থাকাই  মানুষের শক্তিশালী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাই মানুষ কোভিডকে জয় করে নেয়। কোভিড যেমন আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, তেমনি আগামী পৃথিবীর মানুষের জন্য অনেক কিছু দিয়ে গেছে, যার সুফল ইতিমধ্যে মানুষ ভোগ করতে শুরু করেছে। আমিও তার মধ্যে একজন। কোভিডের সুফল ভোগকারীদের একজন। (চলবে…)

কবির চৌধুরী
প্রকাশক, আশ্রম
অটোয়া, কানাডা
০৯/১২/২০২৩