আমার দেখা আশ্রম - সুপ্তা বড়ুয়া
সুপ্তা বড়ুয়া: কোন সৃষ্টির পেছনে থাকে নিরলস শ্রম, প্রয়াস, প্রজ্ঞা আর অদম্য ইচ্ছা। চাইলেই আমরা কিছু সৃষ্টি করতে পারি না, আর তা যদি হয় বৈরী পরিবেশে তাহলে তো বলা চলে অসাধ্য সাধন। প্রবাসে, ভিন্ন ভাষাভাষীদের ভীড়ে, একটা বাংলা পত্রিকা চালু করা এবং সেটা ১৫ বছর ধরে টিকিয়ে রাখা, শুধু কি দূরহই, সেটা করতে নিষ্ঠা, অর্থনৈতিক যোগান কিংবা পর্যাপ্ত লোকবল অভাব সবমিলিয়ে যেন স্রোতের প্রতিকূলে প্রতিনিয়ত দাঁড় বেয়ে যাওয়া। 'আশ্রম' আজ ১৫ বছর ধরে কানাডার রাজধানী অটোয়ায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সামনে যেন এক সংগ্রামের নাম, যেটিকে 'আশ্রম'এর কর্ণধার নাম দিয়েছেন খামখেয়ালীপণা। অথচ আমরা সবাই জানি, উনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো করে 'আধমরাদের ঘাঁ মেরে' বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এই যে প্রতিদিনের আটপৌরে জীবন আমাদের, তার কোন বিশেষত্ব নেই যদি সেখানে খামখেয়ালী না থাকে। আর কোন সমাজেই আমাদের মতো তথাকথিত স্থবির জীবনযাপনে অভ্যস্তরা কখনো পরিবর্তন আনতে পারে নি। এনেছে সব ভিন্ন চিন্তাভাবনা ধারণ করা মানুষেরা। আমরা কেবল তার সুফলটা ভোগ করে গেছি, যুগ যুগ ধরে।
২০১০ সালে প্রায় আড়াই বছর কুইবেক সিটির মতো নির্জন শহরে জীবনযাপন করে সদ্য উটাওয়ে এলাকায় স্থানান্তরিত হয়ে এলাম। কুইবেক সিটিতে এই দু-আড়াই বছরে বেশ খানিক সম্পৃক্ততা গড়ে উঠেছিলো ছোট্ট এক বাঙালী কমিউনিটিতে। তবে, এত কম লোকবলময় নির্জন শহরে বাঙালী অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা বলতে সপ্তাহান্তে প্রতিজনের বাড়িতে একটা গেট-টুগেদারই ছিলো আমাদের একমাত্র ভরসা। সেখানে না হয়েছে বাংলা সংস্কৃতির লালন, না বাঙালীদের ঐতিহ্যময় কোন উৎসব সমাবেশ। তাই গ্যাতিনো-অটোয়া এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। এখানে স্থানান্তরিত হওয়ার পরেই অটোয়ার একটি বাংলা দোকানে একটি স্থানীয় মাসিক পত্রিকা দেখলাম, নাম 'আশ্রম'। নামটা দেখেই এত ভালো লাগলো। আমি বাংলা শব্দময় নামে ভীষণ উচ্ছ্বসিত বোধ করি। ভাবলাম, বাহ কি সুন্দর নাম, 'আশ্রম'। যেখানে আমরা আশ্রয় নিতে পারি, সেটাই তো আশ্রম। প্রবাসে বাংলা ভাষা লালনের 'আশ্রম'। মোটামুটি তারপর থেকে যখনই ওই বাংলা দোকানে যেতাম, প্রতি মাসেরই কপি সংগ্রহ করতে থাকলাম। নিজের ভাষার ছাপাক্ষর এ প্রবাসে, কি অসাধারণ ব্যাপারটা। বলা বাহুল্য লিখাগুলো বেশ ভালোই লাগতো এবং নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি।
তারপর বহু কাজে, কর্মজীবন কিংবা সাংসারিক, নিমজ্জিত আমি একদিন হঠাৎ দেখলাম একটি একক সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন হচ্ছে এপ্রিল ২০১৪-তে, যার পৃষ্ঠপোষক আশ্রম। আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, শুধু ভাষা নয় সংস্কৃতি চর্চাকেও এ প্রবাসে একটি উৎসবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর আশ্রমের কর্ণধার। তারপর তো আশ্রমের এই আইকনিক অনুষ্ঠানটি অটোয়ার অন্যতম পরিচয় হয়ে উঠলো সর্বত্র। একে একে অটোয়ার স্থায়ী অভিবাসী বাঙালী শিল্পীরা এই একক সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের গায়কী এবং পারদর্শীতার সুনিপুণ পরিচয় দিতে লাগলো। অটোয়ায় বসবাসকারী বাঙালী শিল্পীরা যে ঘন্টার পর ঘন্টা দর্শকদের বিমোহিত করে রাখতে পারে, আশ্রম যদি এই একক সংগীতানুষ্ঠানের ভাবনাটা তৈরি না করতো, তবে কি সাধারণ মানুষ জানতো? স্থানীয় শিল্পীদের প্রাধান্য দিয়ে যে দৃষ্টান্ত আশ্রম সারা উত্তর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত করলো, তা এককথায় অতুলনীয় এবং অপ্রতিরোধ্য।
অটোয়ার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে আশ্রম একটি স্বকীয় স্বত্বা। অটোয়ায় বাঙালীদের ইতিহাস যদি কখনো লেখা হয়, তাহলে সেখানে আশ্রমের নাম অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হবে। অটোয়ায় বাংলাদেশী কমিউনিটির সাফল্য বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক, একটি সাফল্য অবশ্যই কবির চৌধুরীর দৃঢ় চেতনার যিনি 'আশ্রম'কে লালন করছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও। সেই আশ্রম যুগের হাওয়ায় ডিজিটাল রূপ ধারণ করলো এবং অটোয়া ছাড়িয়ে এটি এখন অন্তর্জালের বদৌলতে বাংলাদেশ-ভারত কিংবা যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আছে তাদের হাতের মুঠোর স্পর্শেই পৌঁছে যাচ্ছে তাদের চিন্তার জগতে, বাঙালীদের এই প্লাটফর্মটি ব্যবহার করে লিখতে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। আরো মজার ব্যাপার আজ আশ্রম ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে অটোয়ায় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি দুটো লালনপালনে ওতোপ্রোতোভাবেই হাল ধরে আছে। কে জানতো একদিন আশ্রমের এক "একনিষ্ঠ পাঠক" এই ডিজিটাল রূপের যুগে পাবে লেখার সুযোগ কিংবা ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় 'রংধনু' ব্যান্ডের একজন শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ।
এবার আসি আশ্রমের সাথে আমার সম্পৃক্ততা নিয়ে কথা বলি। আশ্রমে আমি প্রথম লিখতে শুরু করি সম্ভবত ২০১৭ সাল থেকে। একটি ভারতীয় অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় আশ্রমের কর্ণধার কবির চৌধুরীর সাথে। প্রথমদিন পরিচয়েই উনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি লিখতে পছন্দ করি কি'না। বললাম, হ্যাঁ তবে সেটা আপাতত ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ। এটুকু জানার পর থেকেই তিনি আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। দেশ-সমাজ-রাজনীতি নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা কিংবা বির্তকগুলো উনি সাদরেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন উনার পত্রিকায়। কখনো কুন্ঠাবোধ করেন নি ডিজিটাল রূপ দিতে। বর্তমান যে প্রেক্ষিত তাতে সত্য সুন্দর কিংবা ন্যায়ের পক্ষে মত দেওয়া সর্বদা সম্ভব হয় না, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এই প্রবাসেও। কিন্তু তিনি সবসময়ই বলেছেন, "অপ্রিয় সত্যটা, ভুলটা, অন্যায্যটা তো কাউকে না কাউকে বলতেই হবে। আপনি যদি না বলেন কিংবা আমি যদি না প্রকাশ করি 'আশ্রমে' তাহলে কি সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে? আমরা কি বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে পারবো?" যেদিন সব পুড়ছিলো, সেদিন আমরা নিরোরা বাঁশি বাজাচ্ছিলাম। এই যে বন্ধ্যা সময়ে আমরা সবাই যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত, সেসময় একজন তো কেউ বলছেন সত্যটা বলার অধিকার আমাদের আছে। ডঃ মীজান রহমানের মতো একজন ক্ষণজন্মা, উদার, আধুনিক, বৈশ্বিক লেখক কিংবা এককথায় আলোকিত মানুষ আমাদের এ শহরে বাস করতেন, যার উদাহরণ টেনে আনতেন বার বার আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করতে। এই সময়ের বিপরীতে চলে আশ্রম কিন্তু গতানুগতিকতার বাইরে নিজের একটি সুন্দর এবং সমুন্নত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, সমাজে তথা বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিতে তৈরি করেছে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
আশ্রম এক কথায় শুভ আর সুন্দরের পাশে থেকেছে সর্বদা। এই আশ্রমের ব্যানারেই শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদা নওয়াজ'এর কর্মময় জীবনকে জানার-জানানোর কিংবা শাহ বাহাউদ্দীন'এর স্থানীয় সরকার পর্যায়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাঙালীদের সামনে আরো বিশদ আকারে জানার-জানানোর বিরল সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে উনাদের সান্নিধ্যে এসে এই প্রবাসে আমাদের মতো অভিবাসীদের অবদানগুলি সম্পর্কে জানার এবং কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের এই সুযোগকে আমার পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি। উনাদের অর্জনগুলোই অন্যান্য বাঙালীদেরও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় উদ্বুদ্ধ করে যাবে। এমনকি আমরা যখন একটি ব্যান্ড গঠনে উদ্যোগ নেই, তখনো কবির চৌধুরী সে প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বাঙালী হিসেবে আমাদের কিছু বৈশিষ্ট্য অতুলনীয়, সেটা হলো কোন কিছু সৃষ্টি করতে গেলে চারপাশ থেকে এত বিরূপ মন্তব্য, কুটুক্তি শুনতে হয়, তখন মনোবল ধরে রাখাটাই হয়ে যায় বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। সেখানে, আশ্রম আমাদের ব্যান্ডকে শুভকামনা কিংবা ব্যান্ডের অনুষ্ঠানের প্রচার প্রসারে উদ্যোগী হতে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখে নি।
আশ্রম এই প্রবাসে আমাদের পরিচিতি দিয়েছে, আমাদেরও যে গর্বিত হওয়ার মতো নিজস্বতা আছে তা মাথা উচু করে বলার সাহস দিয়েছে। আমরাও আরো যুগ যুগ ধরে আশ্রমের ছত্রছায়ায় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে এই প্রবাসে লালনের প্রয়াসকে সুসংহত করতে উদ্যোগী হই। আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদেরও অনেক কিছু দেবার আছে এই পাশ্চাত্য সমাজে। আমাদের সন্তানরা জানুক, কেবল এ প্রবাসে আমরা একটি নিরিবিলি নিরুত্তাপ সহজলভ্য জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে আসি নি। এ সমাজকেও আমরা দিতে পারি আমাদের উৎকৃষ্ট সম্পদটুকু, আমাদের সংস্কৃতি এবং সংগ্রামের ইতিহাস। আশ্রম প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে হলেও পাশ্চাত্যে সাংস্কৃতিক তদুপরি ভাষার মেলবন্ধনে প্রকৃষ্ট ভূমিকা রাখুক, এইটুকুই প্রার্থনা।
সুপ্তা বড়ুয়া
অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
15-12-2023
-
-