সম্পর্ক - সুজিত বসাক
পঞ্চান্ন বছর বয়সে এসে যে সুবিমল মিশ্র পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবেন সেকথা কেউ ভাবতে পারেনি। তিনি নিজেও কি ভাবতে পেরেছিলেন? একটা সময় তিনি নিজেই ভেবে নিয়েছিলেন বিয়েটা সবার জন্য নয়। তাছাড়া বিয়ে করতেই হবে সবাইকে এমন কোনও মানে আছে? এই পৃথিবীতে বহু মানুষ বিয়ে না করেও সুন্দর জীবন যাপন করে কাটিয়ে গেছে। বাবা মারা যান ছোট থাকতেই। কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ত্রিশের আগেই। মা যথাসময়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। বোনের বিয়ে দেওয়ার অজুহাতে সুবিমল পিছিয়ে দিয়েছিলেন সে চেষ্টা। বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ার পর কিছুকাল বিবাগী জীবন কাটালেন। দিদি, জামাইবাবু, বোন, বোনের জামাই সবাই মিলে চেষ্টা করলেও সুবিমল কিছুতেই রাজি হলেন না। আবার সাধু সন্ন্যাসী হলেন তাও নয়, একরকম গৃহী সন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটাতে লাগলেন। হাল ছেড়ে দিয়ে সবাই যে যার জীবন প্রবাহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
পঁয়ষট্টি বছরের ক্রিকেট পাগল জামাইবাবু শুনে বললেন, “ ব্রেভো… এতদিনে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট দেখাতে পারলে তাহলে। আমি খুব খুশি হয়েছি ব্রাদার। পিচটা একটু টাফ হবে…বাট ডোন্ট ওয়ারি… ব্যাটিং করতে নেমে পড়… আমি অ্যাম্পায়ার হয়ে আসছি খুব শিগগির।”
বোনের বর তন্ময় বলল, “কনগ্রাচুলেশনস দাদা। প্রথমে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যাইহোক দারুন ডিসিশন। একা একা আর কতদিন কাটাবেন… একজন সঙ্গী খুব দরকার।”
বন্ধুদের প্রথমেই জানালেন না। ভাগ্নে অলোককে নিয়ে প্রাথমিক পর্বটা গুছিয়ে নিয়ে একদিন কার্ড হাতে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমেই ঢুকলেন স্বপ্নময়ের বাড়িতে। স্বপ্নময়ের হাতে সুদৃশ্য কার্ডটি ধরিয়ে বললেন, “আমার বিয়ে। তোদের নেমতন্ন। সবাই মিলে আসতে হবে কিন্তু।”
স্বপ্নময় ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় নিল, তারপর আচমকা চিৎকার করে বলে উঠল, “কই গো কোথায় গেলে… একবার এদিকে এসো তাড়াতাড়ি।”
কথাগুলো স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলা। ভিতর থেকে স্বপ্নময়ের স্ত্রী মল্লিকা উঁচু গলায় বললেন, “আসছি বাবা আসছি… এদিকে চায়ের জল শুকোচ্ছে তো…”
“আরে রাখ তোমার চা… সামনে বড়সড় ভোজ… একবার এসেই দ্যাখ…”
চায়ের গ্যাস নিভিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মল্লিকা। মুখে একরাশ বিরক্তি, কিন্তু সুবিমলের সামনে কিছু বলতেও পারলেন না। কষ্ট করে হেসে বললেন, “সুবিমলদার গলা পেয়ে চায়ের জল বসিয়েছিলাম। কতদিন পর এলেন সুবিমলদা। এভাবে ডাকার কারণটা কী?”
স্বপ্নময় কার্ডটা মল্লিকার হাতে দিয়ে বললেন, “নিজেই পড়ে দ্যাখো।”
মল্লিকা পড়তে লাগলেন। স্বপ্নময় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মল্লিকার মুখের দিকে। পাত্র পাত্রীর নাম পড়েই লাফিয়ে উঠলেন মল্লিকা, “সুবিমলদা আপনি…? স্বপ্ন দেখছি না তো? যাক শেষ পর্যন্ত আপনার সুমতি হয়েছে দেখে ভাল লাগল। তা পাত্রীটি কে? কোথায় থাকে?”
সুবিমল মৃদু হেসে বললেন, “হঠাৎ করেই হয়ে গেল ঠিকঠাক। আমার অফিসের এক কলিগের মাধ্যমে সম্বন্ধটা এসেছিল। ডিভোর্সি… একাই থাকে। যাদবপুরে একটা ভাড়া বাড়িতে। বারুইপুরের একটা স্কুলে চাকরি করে।”
নিমেষে পাল্টে গেল মল্লিকার অভিব্যক্তি। বিড়বিড় করে বললেন, “ডিভোর্সি! ভাল করে খোঁজখবর নিয়েছেন তো? না মানে, ডিভোর্সটা কেন হয়েছিল এইসব আরকি। একটা কারণ ছাড়া তো ডিভোর্স হয়নি!”
স্বপ্নময় বিরক্ত গলায় বললেন, “খুঁত ধরায় তোমাদের জুড়ি নেই। আরে বাবা ডিভোর্সি হলেই কি মেয়েরা খারাপ হয়ে যায় নাকি? আত্মসন্মানবোধ সম্পন্ন মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ওপর হওয়া অন্যায় মেনে নিতে পারে না… প্রতিবাদ করে… ডিভোর্স ছাড়া উপায় থাকে না।”
মল্লিকা ভাবলেশহীন মুখে বললেন, “তাই হবে হয়তো। যাকগে ওসব কথা, আপনার বউ দেখতে শুনতে কেমন সুবিমলদা?”
সুবিমল লাজুক হেসে বললেন, “আমি কী বলব… নিজের চোখেই দেখবে। সত্যি কথা বলতে, ডিসিশন নিতে আমি অনেক বিড়ম্বনা ভোগ করেছি। বয়সটা তো একটা বড় ফ্যাক্টর! এই বয়সে এরকম একটা ডিসিশন নেওয়া কতটা বিড়ম্বনার, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তবুও পেরেছি, সেটা ভাবলে অন্যের চেয়ে নিজেই অবাক হচ্ছি বেশি। ভাল মন্দ এখন আমার কপাল। তাই না?”
অজানা এক অভিঘাতে সামান্য কেঁপে গেল সুবিমলের গলা। মল্লিকা না বুঝলেও স্বপ্নময় টের পেলেন। মৃদু হেসে নরম গলায় বললেন, “অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? সবকিছু ভালই হবে দেখো। অনিশ্চিতের মধ্যে ভাল মন্দ দুটোই থাকে, তাই বলে থেমে গেলে চলবে কেন? বি পজেটিভ…।”
দুই
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে যেখানেই গেছেন সেখানেই ‘ডিভোর্সি’ শব্দটার নানা ব্যঞ্জনা শুনেই চলেছেন সুবিমল। সুবিমল বাদে আর সবার কাছেই যেন শব্দটি কাঁটার মতো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের কাছে। ওই শব্দটা দিয়েই যেন একটা মেয়েকে অনায়াসে জাজমেন্ট করে করে দেওয়া যায়! ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লেগেছে সুবিমলের কাছে। একটা শব্দ একটা মেয়েকে জাজমেন্ট করার ক্ষমতা রাখে? অবশ্য কৈলাশদা প্রথম সম্বন্ধটা দেওয়ার পর সুবিমলেরও একটা প্রাথমিক ঝটকা লেগেছিল। অবচেতন মনে গেঁথে থাকা চিরাচরিত সংস্কার একটুখানি দুলে উঠেছিল। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তির মতো মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল একটা পোস্টার ‘ডিভোর্সি মেয়ে হইতে সাবধান’। সেই জায়গা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছিলেন না। কৈলাশদা একরকম জোর করেই একদিন ওদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে দিয়েছিলেন একটি পরিচিত কফি শপে। প্রথম দর্শনে পুলকিত হননি, বরং অবাক হয়েছিলেন। একজন হাইস্কুলের দিদিমণি অথচ দেখে মনে হয়েছিল মধ্যবিত্ত ঘরের আটপৌরে বউ। চোখে মুখে স্বাধীনচেতা তেজী মনোভাবের কোনও লক্ষ্মণ নেই।
সুবিমল সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ডিভোর্সটা কেন হয়েছিল?”
নামটা কৈলাশদার মুখেই শুনেছিলেন সুবিমল। মনামী… মনামী রায়চৌধুরী। ভাল লেগেছিল।
মনামী অদ্ভুত ভাবে একটু হেসে বললেন, “আমার এক্স স্বামীর নাম অনুপম বোস। বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট। নামটা হয়তো শুনে থাকবেন। ওঁর বাবা আমাকে নিজে পছন্দ করে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। জানি না উনি আমার মধ্যে কী দেখেছিলেন। ব্যাপারটা একটু একতরফা হয়েছিল, আমি পরে বুঝেছিলাম। ওঁর ছেলে আমাকে আদৌ পছন্দ করেননি। শ্বশুরমশাইয়ের ঠিক উল্টো মানসিকতার মানুষ ছিলেন আমার হাজব্যান্ড। নৈতিকতা বর্জিত একজন ডাক্তার জল্লাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর, আমি নিজের জীবন দিয়ে সেটা অনুভব করেছি। আমি প্রতিবাদ করতাম বলে শুরু হয়েছিল অত্যাচার। আমার শাশুড়ি, ননদ সাপোর্ট করতেন আমার হাজব্যান্ডকে। একসময় নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য খুব আক্ষেপ করতেন শ্বশুরমশাই। আমার জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছেন বলে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করে মানসিক কষ্টে ভুগতেন। একদিন তিনি চলে গেলেন সময়ের আগেই। আমি একা হয়ে গেলাম। ডিভোর্স ছাড়া আমার উপায় ছিল না। শুনেছি উনি আর একটা বিয়ে করেছেন। ব্যস, এইটুকুই আমার ডিভোর্সের নেপথ্য কাহিনী।”
সুবিমল অন্যমনস্কভাবে বলেছিলেন, “তারপর?”
“আমি মায়ের কাছে গিয়ে উঠলাম। আইনি মারপ্যাঁচ বেশি বুঝি না বলে পাওনা গন্ডার ক্ষেত্রেও ঠকালো। চেষ্টা করলে পারতাম, কিন্তু আমার মনই সায় দেয় নি। যে মানুষ নিজেই মনে ভিখিরি, তাঁর কাছে কী নেব! তাছাড়া আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল যার পয়সায় মানুষের হাহাকার মিশে আছে সেটা আমি নিতে পারব না। তবে জীবন সব পরিস্থিতিতেই কিছু না কিছু শিখিয়ে যায়। ওই কয়েক বছর ওই জটিল পরিস্থিতিতে একটা জিনিস শিখেছিলাম বাঁচার জন্যেও একটা মিনিমাম যোগ্যতা লাগে এবং সেটা নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয়। শুরু করলাম পড়াশোনা। চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতে লাগলাম। লেগে গেল একটা।”
“ডিভোর্স তো অনেক দিন আগে হয়েছিল। বিয়ের সিদ্ধান্ত এতদিন পরে কেন?”
“ভেবেছিলাম আর বিয়ে টিয়ে করব না। মাকে নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল। দু’বছর আগে মা মারা গেল। এক বছর কিছু মনে হয়নি। হঠাৎ একদিন অজানা একটা ভয় চেপে বসল। এত বড় একটা পৃথিবীতে আমি সম্পূর্ণ একা!”
“আপনার নিজের আর কেউ নেই?”
“ছোট থাকতেই বাবা মারা যান। দাদা ছিল আধ্যাত্মিক টাইপের, আমার বিয়ের পর পর সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, আজও তার সন্ধান নেই। দূর সম্পর্কের এক মাসি আছে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। কৈলাশদা আমার নিজের দাদা না হলেও খুব কাছের। আগে আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। আমার জীবন বৃত্তান্ত সবই জানতেন। হঠাৎ একদিন এসে বললেন, এতবড় পৃথিবীতে তোর মনের মতো কেউ নেই এটা হতেই পারে না। তারপর আপনার কথা বললেন। আপনার কথা শোনার পর কেন যেন মনে হয়েছিল, একবার দেখা করা যেতেই পারে… কিছুটা কৌতূহলও বলতে পারেন।”
“কৌতূহল! নিশ্চয়ই কৈলাশদা বানিয়ে বুনিয়ে অনেক গল্প ফেঁদেছিল আমার নামে…”
“একদমই না। তবে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। মানুষের মন নাকি চোখে থাকে, একবার শুধু আপনার চোখের ভাষা পড়ার অনুরোধ করেছিলেন। কথাটা মনে দাগ কেটেছিল। তাই চলে এসেছি।”
“অদ্ভুত তো! কৈলাশদা আমাকেও এরকম একটা অদ্ভুত কথা শুনিয়েই এখানে এনেছেন। সত্যি কথা বলতে আমারও এখানে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না।”
“কী কথা?”
“আপনার মধ্যে নাকি একটা খোলা আকাশ আছে। যে আকাশে সাদা মেঘের দল, মুক্ত পাখির দল অনায়াস বিচরণ করে। কৈলাশদা কবিতা টবিতা লেখেন জানি। সত্যি কী এমন কেউ থাকে! কবির কল্পনা সত্যি কী কোনও বাস্তবতা বহন করে? আমিও কৌতূহল এড়াতে পারিনি, চলে এসেছি।”
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ। ডানদিকের টেবিলে কয়েকটি অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে সুবিমল বলেছিলেন, “তা কী দেখলেন? ঘটকালি করতে গিয়ে কৈলাশদা বোধহয় একটু বেশিই কবিতা বানিয়ে ফেলেছেন, তাই না?”
“আমি জানি না। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার একটু সময় লাগে। ভাবতে হয়। এ আমার এক দোষ। আপনিই প্রথমে বলুন।”
সুবিমল বুঝতে পেরেছিলেন মনামী সুকৌশলে বলটা তাঁর কোর্টে ঠেলে দিয়েছিল। মনে মনে হেসেছিলেন। উত্তর দিতে পারেননি তিনি নিজেও। এসব প্রশ্নের বোধহয় তাৎক্ষণিক উত্তর হয় না। এরপরে দেখা হয়েছিল আরও বেশ কয়েকবার। অনেক ভেবে চিন্তে দু’জনেই ফাইনাল ডিসিশন নিয়েছিলেন।
তিন
নির্দিষ্ট দিনক্ষণে বিয়ে সুসম্পন্ন হল। অনেকে এল অনেকে এল না। বিয়ের পর সুবিমল মনামী ক’দিন বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর জীবন আবার চেনা ছন্দে বইতে লাগল। সুবিমলের অফিস, মনামীর স্কুল। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই মনামী নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিলেন।
সুবিমলের বড়দির ছেলে অলোক সুবিমলের বাড়িতেই থাকে। হায়ার সেকেন্ডারিতে ভাল রেজাল্ট করেছিল। কিন্তু জেলা শহরে পড়াশোনার সেরকম ভাল সুযোগ না থাকায় বড়দি ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। নীচ তলায় একটা ঘর ফাঁকা পড়েছিল, তাই সুবিমলও না করেননি। তখন একা মানুষ তিনি, ও থাকাতে সুবিধাই হয়েছিল। বাড়ি পাহাড়াও হত আবার টুকটাক জরুরি কাজকর্মগুলিও ওকে দিয়ে করানো যেত।
এক রাতে মনামী বললেন, “তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করতে পারবে না। অনেক ভেবে দেখলাম কথাটা তোমাকে বলা উচিত। কথাটা অলোককে নিয়ে। আমাকে পাশের বাড়ির মনিকাদি বলেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু পরে প্রমাণ পেয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।”
সুবিমল অবাক হয়ে বললেন, “কী কথা? কী করেছে অলোক?”
মনামী একটু ইতঃস্তত করে বললেন, “অলোক একটা মেয়েকে মাঝেই ওর ঘরে নিয়ে আসে। ঘরবন্ধ করে গল্প গুজব করে। আমিও দেখেছি। শ্যামলা মতো, কিন্তু মুখশ্রী খুব সুন্দর। ওরা যদি একে অপরকে ভালবাসে বলার কিছু নেই। কিন্তু এভাবে মেলামেশাটা তোমার সন্মানের পক্ষে ভাল না। মনিকাদি যখন যেচে বলল তখন ধরে নেওয়া যায় আরও দুচারজন অবশ্যই জানে। এমন মেয়েমানুষের পেটে কথা কথা থাকে না। ক’দিন এসেই বুঝেছি এ পাড়াতে তোমার আলাদা সন্মান রয়েছে।”
সুবিমল গম্ভীর মুখে বললেন, “আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অলোক এসব করেছে? আমি তো বুঝতে পারিনি… আমাকে তো কেউ বলেনি?”
মনামী হেসে বললেন, “তুমিও যেমন… মনিকাদি এসে তোমাকে বলবে? আজকাল অন্যের ঝামেলায় কে জড়াতে চায়?”
“আমি বড়দির সাথে কথা বলব?”
“আমি কী বলব? তুমি যেটা ভাল বোঝ তাই করো।”
পরের দিনই বড়দিকে ফোন করলেন সুবিমল। সব শুনে বড়দি বললেন, “বলিস কি রে, অলোক এই সব করে বেড়াচ্ছে! তুই কী করে জানলি? তোর জামাইবাবুকে আগেই কিছু বলিস না। হাই প্রেসারের রুগি। আমি দেখছি কি করা যায়…”
বড়দি বোধহয় অলোককে ফোন করেছিলেন পরে। রাতে উপরে খেতে এসে অলোক ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “বাড়িতে আর রাখতে চাও না ঠিক আছে, কিন্তু এরকম একটা আপত্তিকর অভিযোগ মায়ের কানে দিতে পারলে মামা? কবে কোন বন্ধু বান্ধবী এসেছে… যাইহোক আমি ঠিক করেছি সামনের মাসে আমার এক বন্ধুর মেসে চলে যাব।”
অলোক খেয়ে দেয়ে নীচে নেমে গেলে সুবিমল বড়দিকে ফোন করলেন, “তুই অলোককে কী বলেছিস? ও আর এখানে থাকবে না বলছে। আমি জাস্ট একটু বুঝিয়ে বলতে বলেছিলাম ওকে। উঠতি বয়স, একটা কিছু ঘটে গেলে না তোর ভাল লাগবে না আমার। আমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছি?”
বড়দি কটাক্ষ করে বললেন, “কিছু মনে করিস না বাবু, এতকাল ধরে ছেলেটা তোর ওখানে রয়েছে, কই আগে তো কেউ কিছু বলেনি? হঠাৎ করে ও খারাপ হয়ে গেল? সব শুনে তোর জামাইবাবুও খুব আপসেট। আলোকের বোধহয় ওখানে আর না থাকাই ভাল।”
বড়দির কথার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হল না সুবিমলের। কেমন জানি অসহায় বোধ হল। একটুবাদে ফোন করলেন ছোটবোন চিত্রাকে। ওকে সবটা খুলে বললেন। সব শুনে চিত্রা বলল, “এতে তোর কোনও দোষ হয়েছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। তুই অলোকের লোকাল গার্জিয়ান। সেই দায়িত্ব থেকে সতর্ক করেছিস। এতদিন তুই একা থাকতিস, এসব দেখার লোক ছিল না, এখন বৌদি এসেছে সে দেখছে। দেখা তো উচিতও। আমার কী মনে হয় জানিস দাদা… অবশ্য এসব বলা বোধহয় ঠিক হবে না…। নিজেদের মধ্যে শুধু শুধু অশান্তি বাড়বে।”
“মনে যখন এসেছে বলেই ফেল।” সুবিমল জোর দিয়ে বললেন।
“এত করে যখন বলছিস … আমার মনে হয় বড়দি তোর বিয়েতে খুশি হতে পারেনি বুঝলি। বিশেষ করে জামাইবাবু। ঝিমলির বাবা বলছিল ওঁর একটা অন্য অভিসন্ধি আছে। তোর সম্পত্তির উপর লোভ… সেজন্য অলোককে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তোর ওখানে। কিন্তু তোর বিয়ে সব হিসাব… নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা।”
হঠাৎ করে মাথার মধ্যে ঝটকা লাগল সুবিমলের। ঝিমঝিম করতে লাগল। খুব কাছের মানুষকে নিয়ে কেউ এমন ভাবতে পারে!
চিত্রা আবার বলল, “ভগবান যা করে ভালোর জন্যই করে। তোর চোখটা খুলে গেল তো? দ্যাখ এরপরে বড়দিরা আর সম্পর্ক রাখে কিনা। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে আপন পর হয়ে যায়… এ আর নতুন কি! ভাবিস না, আমি তো আছি… চিরকাল তোদের পাশে থাকব।”
সুবিমল মনে মনে ব্যথিত হলেন। বড়দির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক এভাবে এক ঝটকায় ছিন্ন হয়ে যাবে? সেকথা ভাবতেই বেদনায় ভরে গেল মন। এত ঠুনকো একটা সম্পর্ক! আবার চিত্রার কথা যদি ঠিক হয় তবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাও তো সম্ভব নয়। সম্পর্ক দু’জনকে নিয়ে হয়, একতরফা টিকিয়ে রাখা যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস জোর করে চেপে গেলেন সুবিমল। ঠিক তার পরে পরেই আর একটা প্রশ্ন উঁকি দিল মনে, এসব মনামীর কোনও চাল নয় তো?
চার
দু’মাস পরেই অলোক জিনিস পত্র নিয়ে মেসে গিয়ে উঠল। মাঝে সুবিমল ও মনামী দু’জনেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু ওদের কথায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি অলোক। তাই যাবার সময় আর বিশেষ কিছু বললেন না সুবিমল। ভিতরে ভিতরে একটা অপমান বোধও কাজ করেছে তাঁর। মামা হিসাবে সুবিমলকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে অলোক? খুব নাবালক তো এখন আর ওকে বলা চলে না। মামা কেন বলল, এসব বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। নিজের জেদটাই বড় হয়ে গেল?
কয়েক মাস পর চিত্রা এল দুর্গাপুর থেকে। সুবিমল খুশি হলেন। মনামীও। একজন হিতাকাঙ্খী অন্তত ওদের সঙ্গে আছে। চিত্রা বৌদির হাত ধরে বলল, “তোমাদের সংসার দেখতে চলে এলাম। কবে থেকে আসব আসব করছি, কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। এবার ঝিমলির বাবা জোর করেই পাঠিয়ে দিল। তাঁর বক্তব্য, আসা যাওয়া না থাকলে সম্পর্ক টিকবে কেমন করে?”
মনামী হেসে বললেন, “ঠিকই তো বলেছে তন্ময়।”
চিত্রাও হাসল, “এরপরে তোমাদের পালা। দুটিতে মিলে কবে আমার বাড়িতে পা রাখবে বলো? নইলে কিন্তু আসা বন্ধ করে দেব।”
পরের দিন রাতে চিত্রা একান্তে সুবিমলকে বলল, “তোর সংসার দেখে খুব ভাল লাগল রে। ভাগ্য করে এমন বউ পেয়েছিস। যেমন মিশুকে তেমনি কাজের। মা যদি এসব দেখে যেতে পারত।”
সুবিমল অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন শুধু, কোনও উত্তর দিলেন না। একটু পরে বললেন, “তন্ময়, ঝিমলি, তনিমা ওদের আনলি না কেন? দুটো দিন ঘুরে যেত।”
“কী করে হবে বল? তনিমার সামনে মাধ্যমিক। ঝিমলির ভর্তির ব্যাপারে একটু ঝামেলা চলছে। তোর সঙ্গে একটু পরামর্শ করব সে বিষয়ে। তুই তো জানিস ঝিমলির স্বপ্ন ডাক্তারি পড়ার। ওর বাবারও খুব ইচ্ছে। কিন্তু সরকারি কলেজে তো হল না। ওর বাবা ঠিক করেছে মেয়ের এতই যখন ইচ্ছে তখন বেসরকারি কলেজেই ভর্তি করিয়ে দেবে। কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েও গেছে। সবমিলিয়ে সত্তর লাখের মতো লাগবে। বেশিরভাগটাই জোগাড় হয়ে গেছে। আর পাঁচ ছয় লাখ হলেই হয়ে যায়। যদি ওই টাকাটা ধার হিসেবে দিতিস তাহলে খুব উপকার হত দাদা। ওর একটা এল আই সি ম্যাচিওর করার কথা কয়েক মাস পরেই, সেটা পেলে সবার আগে তোর টাকা শোধ করে দেব। তুই বড় চাকরি করিস, বউদিও হাইস্কুলের দিদিমণি, মনে হয় না তোদের খুব অসুবিধা হবে।”
চিত্রা থামল। সুবিমল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চিত্রা আবার বলল, “বৌদিকে বলেছি। সে বলল, তোমার দাদার সঙ্গে কথা বলো, তাঁর ডিসিশনই ফাইনাল। বৌদি খুব ভাল মানুষ।”
সুবিমল মনে মনে হাসলেন। অদ্ভুত মেয়ে তো মনামী! এখানেও বলটা তাঁর কোর্টেই ঠেলে দিল? স্বার্থের প্রশ্নে বেশিরভাগ মেয়েই খুব কমই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। চিত্রা নিশ্চয়ই এসব কথা মনামীকে কাল রাতে বলেছে। আজ বিশেষ একটা প্রোগ্রাম থাকায় খুব সকালে উঠে স্কুলে চলে গিয়েছিল মনামী। ক্লান্ত হয়ে ফিরল সন্ধ্যা নাগাদ। বেশিরভাগ মেয়ে এতক্ষণে কথাটা স্বামীর কানে তুলে দিত হয়তো। কিন্তু মনামী সেটা করেনি। অথচ অলোকের ব্যাপারে বলেছিল। সেটা কি ওর ভুল ছিল? নাকি কৈলাশদার কথা অনুযায়ী মনামীর মধ্যে সত্যি সত্যি একটা খোলা আকাশ আছে? সেই আকাশে রোদ-মেঘ-বৃষ্টি সব একাকার হয়ে থাকে? মনামীকে ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি সুবিমল। সেটা তাঁর অক্ষমতা নাকি মনামীর রহস্যময়তা, বুঝতে পারেন না।
তবে চিত্রার পিছনের মস্তিষ্কটাকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। এর আগেও চিত্রা বেশ কয়েকবার নানা অজুহাতে টাকা নিয়ে গেছে। প্রতিবারই নেবার সময় বলেছে শোধ করে দেবে। কিন্তু শোধ করা তো দূরের কথা, কিছুদিন পর ওই টাকার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। এবারেও তাই হবে। এবার টাকার অঙ্কটা অনেক বেশি। হয়তো ভেবেছে দাদার বিয়ে হয়ে গেছে সুতরাং এটাই শেষ সুযোগ বড় দাও মারার। আশ্চর্যের বিষয় এতদিন কখনোই এসব কথা সুবিমলের মাথায় আসেনি, কিন্তু আজ এল।
সবশেষে সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে চিত্রা বলল, “দ্যাখ দাদা, বাবা মারা যাওয়ার পর তুই আমাকে মানুষ করেছিস, লেখাপড়া শিখিয়েছিস, বিয়ে দিয়েছিস। তোর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোদের জামাইও তোকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। সবসময় বলে, ভাগ্য করে এমন দাদা পেয়েছ। আমাদের ওপর থেকে তোদের আশির্বাদের হাতটা তুলে নিস না কোনদিন।”
সুবিমল গম্ভীর মুখে বললেন, “আমাকে একটু সময় দে।”
চিত্রা বলল, “নিশ্চয়ই। মাসখানেকের মধ্যে দিলেও চলবে।”
পাঁচ
রাতে সুবিমল মনামীকে বললেন, “তুমি ঠিক কী চাও বলো তো?”
মনামী মুচকি হেসে বললেন, “এ আবার কেমন প্রশ্ন? আমি আবার কী চাইব?”
“চিত্রাকে ওসব কথা বলতে গেলে কেন?”
“অলোকের ব্যাপারে আমার একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল। মনে হয়েছিল আমার জন্যেই বোধহয় তোমার বড়দির সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেল। তাই চিত্রার ব্যাপারে আমি কোনও কথাই বলতে চাইনা। যা বলার তুমি বলবে, যাই ডিসিশন নেবে আমি তাই মেনে নেব। দাদাকে হারিয়েছি, কিন্তু বুঝতে পারি এই সব সম্পর্ক অমূল্য। তাই ভবিষ্যতে আমার কারণে তোমাদের মধ্যে কোনও বিচ্ছেদ হলে সেটা আমি মেনে নিতে পারব না। ব্যস, এইটুকুই আমি চাই।”
হাই পাওয়ারের লেন্সের মধ্য দিয়ে মনামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন মাপজোক করে নিলেন সুবিমল। তারপর বিড়বিড় করে আপন মনে কী যেন বললেন।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুবিমল বললেন, “ফাইনালি চিত্রাকে না করে দিলাম।”
মনামী উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “এর মানেটা কি জানো?”
বিষন্ন হেসে সুবিমল বললেন, “জানি। এরপরে চিত্রাও আর সম্পর্ক রাখবে না, তাই তো?
“তুমি এমন কথা এত সহজে বলতে পারছ? কষ্ট হচ্ছে না?”
“না। বিশ্বাস করো, হচ্ছে না। বরং অনেক হালকা লাগছে। একটা ডিসিশন তো নিতেই হত। অনেক ভেবে দেখেছি, এভাবে কোনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। সম্পর্ক আর ভালবাসা একই জিনিস। জোর করে হয় না। ওদের মনে যদি আমার প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে একদিন ঠিক ফিরে আসবে, নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। ভালবাসা কিছু দিয়ে পাওয়া যায় না। অন্তরের টান না থাকলে কীসের সম্পর্ক? বাইয়োলজিক্যাল সম্পর্ক আসলে হাওয়ার উপর ঘর, নইলে ওরা এত অনায়াসে আমাকে, আমাদের সম্পর্কটা অস্বীকার করতে পারে? শুধু ওদের স্বার্থপূরণ হল না বলে… তাহলে রক্তের মূল্য কোথায় মনামী?”
“ওরা আমাকে ভুল বুঝবে। ভাববে আমাদের ভাইটা আগে ভাল ছিল, বউ আসার পরেই বিগড়ে গেল।”
“ভাবুক। লোকে না দেখে না শুনে কতকিছুই তো ভেবে নেয়! কিন্তু ওসব ভাবনায় কোনও জোর থাকে না। একসময় আপনা আপনি মিলিয়ে যায়। সত্যিটা তো আমি জানি। সেই জানাটুকু নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। তবে ওরা পরিশুদ্ধ মন নিয়ে ফিরে আসবে সে প্রত্যাশা অবশ্যই করে যাব। জীবনভর।”
রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন সুবিমল। মনামী চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। মনে হল, শুধু এইটুকু পাওয়ার জন্য এক নারী বারবার জন্ম নিতে পারে এ পৃথিবীতে!
সুজিত বসাক
দিনহাটা, গোপাল নগর
কোচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
18-12-2023
-
-