অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আশ্রম: একটি চেতনার নাম – তৃতীয় পর্ব

কবির চৌধুরী, অটোয়া, আশ্রম: একটি চেতনার নাম, লেখাটি একটি আত্মানুসন্ধানমূলক নিবন্ধের নাম। এখানে আমি, আমাদের কথা, আমার কথা, আশ্রমের কথা লিখতে চাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই প্রবাসে কিছু কিছু বাঙালি কেন নিজের সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করেন, আমি অধম অনেক কিছু থাকতে পত্রিকা কেন প্রকাশ করি? আশ্রম কি শুধুই একটি পত্রিকা? শনিবারের নিবন্ধে লেখাটির শুরু করেছি আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসবকে কেন্দ্র করে কিছুসংখ্যক আশ্রমহিতৈশীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাফল্যের কথা লিখতে। কারণ এই সাফল্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে আশ্রম প্রকাশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। কিন্তু লেখাটির কাহিনী এতটাই বিস্তৃত যে অল্প কথায় তা শেষ করা যাচ্ছে না। এ’পর্যন্ত দু’পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। এ’টা তিন নাম্বার। না চাইলেও ঘটনার পর ঘটনা এসে যাচ্ছে। আরও কয় পর্ব লাগবে তা জানি না। তবে এটা জানি, ঘটনার এই ঘূর্ণিপাক প্রবাসে আমাদের নতুন অভিবাসন তৈরিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। আপ্রাণ চেষ্টা করছি এই পর্বেই আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের কথাগুলো লিখে শেষ করবো, কিন্তু মনে হয় তা করা যাবে না। কারণ এই পর্বটি এমন এক সময়ে লিখছি যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা বাঙালিদেরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে। এই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সাধারণ মানুষ মারাটা এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন বাঙালিরা তার বিজয়ের ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপন করা শেষ করেছে মাত্র। আমি এক আবেগতাড়িত মানুষ। সেই আবেগের কারণেই এই পর্বে বাংলাদেশের নির্বাচন আর অটোয়ায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু লেখার প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করছি। লেখাটি পড়ে হয়তো অনেকে আমার উপর নাখোশ হবেন, অনেকে বাহবা দিবেন।

কানাডা এবং বাংলাদেশ। পৃথিবীর এপ্রান্ত আর ওপ্রান্ত। যোজন যোজন মাইলের ব্যবধান। এত দূরে বাস করে বাংলাদেশের কথা কি লিখবো? সেই জন্যে অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা নিয়ে লেখালেখি থেকে বিরত থাকি। কিন্তু গত কয়েকদিনে ট্রেন-গাড়ীতে আগুণ দিয়ে সাধারণ মানুষ মারার খবর দেখে আজকে কিছু লিখতে বাধ্য হলাম। আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের এইসব নিয়ে লেখার মানে হলো ক্ষমতার জন্য সাধারণ মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদ। আগামী ৭ জানুয়ারী ২০২৪ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নির্বাচন যখন বিভিন্ন দলের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই, অতীত কাজের ভাল-মন্দ বিচারের মাপকাটি, আর ক্ষমতা পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক উপায়, সেখানে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে তথাকথিত বিরোধীদল যাদের অধিকাংশেরই গণভিত্তি শুধু কাগজে-কলমে, বাঁকাপথে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে সেদলগুলো বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র কাঁধের উপর ভর করে ‘নির্বাচন বয়কট’ করার রাজনীতি শুরু করেছে। গত কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেনি, বা করেও শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, এমনকি সংসদ চলাকালীন সময়ে নির্বাচিত সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে বিএনপির এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চাকে দিনদিন কঠিন করে তুলছে। এই সুযোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী, সুপারপাওয়ায়ার নামদারী দেশ আমেরিকার সরকার ‘সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের’ দোহাই দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আধিপত্যবাদের নির্লজ্জতা প্রকাশ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কতিপয় বিরোধীদল শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে আমেরিকান সরকারের এই হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে এর প্রশংসা করে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো আশা করছে বিশ্বের বৃহৎ শক্তির এই দেশটি বর্তমান সরকারকে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহযোগিতা করবে। হয়ত সাম্রাজ্যবাদের লালনপালনকারী দেশটির সহযোগিতায় বিরোধীদলগুলো একসময় ক্ষমতায় চলে আসবে। এই যে বিদেশীদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়া এতে কি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উন্নতি হবে? আমরা যদি নিজেরা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক চর্চার ভীত তৈরি করতে না পারি তাহলে আর কতদিন বিদেশীদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার খেলা চালিয়ে যাব? তাই আমার মনে হয় বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বর্জন না করে, হরতাল আর অবরোধের নামে গাড়ী-বাড়ি না জ্বালিয়ে, সাধারণ মানুষ হত্যা না করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, সেন্টারে সেন্টারে ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিত, তাহলে এক সময় না এক সময় গণতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতায় যেতে পারত। তাই বলা যায় বৃহৎ শক্তির একটি দল হিসেবে বিএনপি’র নির্বাচন বর্জন করা ঠিক হয়নি। এই নির্বাচন বর্জনের খেসারত দল এবং দলের কর্মী এবং বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকেই দিতে হয় এবং দিচ্ছে- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ট্রেন, গাড়ীতে জ্বলে-পুড়ে মরে তার খেসারত দিচ্ছে!

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মাঝে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের মতো কানাডার রাজধানী অটোয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনেও গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫৩তম বিজয় দিবস পালন করা হয়। এই মহতী এবং আনন্দ উৎসবে আমি গিয়েছিলাম। হাইকমিশনের কোনো অনুষ্ঠানে আমার যাওয়াটা নতুন নয়। গত ৩৫বছরে অনেকবারই হাইকমিশন আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। হাইকমিশনের অনুষ্ঠান মানে, সামনে বসার প্রতিযোগিতা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বক্তার বক্তব্য প্রদান, মজার মজার খাবার-দাবার আর কিছু গান-বাজনা। যুগযুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। তবে বলতে দ্বিধা নেই এবারের অনুষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রম। অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন দিক দিয়েই প্রশংসার দাবী রাখে। বিশেষ করে অটোয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান কর্তৃক অটোয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসা দেখিয়ে তাঁদেরকে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার দৃশ্যটি ছিলো আন্তরিক আর বিরল। ড. রহমানের এই আন্তরিকতাটা একেবারে খাঁটি মনে হতো যদি হাইকমিশন উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামনের কাতারে বসাতে পারত।। ইচ্ছা-অনিচ্ছা, যেভাবেই হোক না কেন হাইকমিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামনের কাতারে বসাতে ব্যর্থ হয়েছে , যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।  আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই আমরা আজ স্বাধীন। এই একটিমাত্র ভুল ছাড়া বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর অপর্ণা রানী পালের উপস্থাপনা ও গ্রন্থনায় সাজানো অনুষ্ঠানটি সবদিক থেকেই ছিলো গোছানো। বলা যায় অটোয়ার সর্বস্তরের বাংলাদেশিদের কথা মনে রেখে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করলে এবারের অনুষ্ঠানটি এযাবতকালের সেরা অনুষ্ঠানের তকমা পেত নিঃসন্দেহে। যেমন, আমরা জানি অটোয়াতে পাঁচ হাজারের উপর বাংলাদেশিদের বসবাস এবং এদের মধ্যে কয়েক ডজন সাংস্কৃতিক কর্মী, কণ্ঠশিল্পী, আবৃত্তিকার বিদ্যমান। আমি মনে করি বাংলাদেশের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান এই পাঁচ হাজার বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যেই করা উচিত ছিল। যার জন্য প্রয়োজন ছিল অনুষ্ঠানটি বড় কোন কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা। কারণ, বাংলাদেশ হাইকমিশনের এই রুমটি খুবই ছোট। এই রুমে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরুতেই ভাবতে বাধ্য করে, অনুষ্ঠানটি তথাকথিত সমাজের তথাকথিত কিছু মানুষের জন্য। অটোয়ার সর্বস্তরের বাঙালিদের জন্য এই অনুষ্ঠান নয়, এই অনুষ্ঠানের আয়োজন সবার জন্য করা হয়নি। তবে হাইকমিশনকে শুধু শুধু দোষ দিয়ে লাভ নাই। ওরা তো সমাজের হাইফাই মানুষদের জন্যেই অনুষ্ঠান করবে। এটাই স্বাভাবিক। শহরের সবার জন্যে অনুষ্ঠান করার মতো ফান্ড নামক ফান্ড কি তাদের আছে? পাঁচ হাজারের অধিক বাংলাদেশী অধ্যুষিত শহর অটোয়া। আমরাই যখন আমাদের নিজেদের জন্য বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করি না, তখন হাইকমিশন করবে কেন? হায়রে বাঙালি? আমরা কি করি না? গান-বাজনা,ঈদ-পূজা-পার্বন, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, সবই করি। কিন্তু বাংলাদেশের অস্থিত্বের সাথে জড়িত অনেককিছুই করি না। করতে লজ্জা পাই। যাক আজ এসব থাক। অন্যদিন লিখবো। পরিশেষে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদেরকে সামান্য অনুরোধ করেই হাইকমিশনের অনুষ্ঠান নিয়ে আমার ভাবনার ইতি টানতে চাই। কারণ, আমাকে আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথা লিখতে হবে। অটোয়ার শিল্পীদের উদ্দেশ্যে বলবো, এধরনের ছোট হলে সাউন্ডসিস্টেম আর অসংখ্য মাইক ব্যবহার না করে গান পরিবেশন করলে উপস্থিত দর্শকরা খুব বেশি উপভোগ করবেন, আপনারাও গলা ছেড়ে গান গাইতে পারবেন। সাউন্ড পলিউশন বা শব্দ দূষণের কথা নাইবা লিখলাম!  

গত পর্বে লিখেছিলাম, কৈলাস মিতাল থিয়েটারে একটি অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েই আমি ‘আশ্রম সঙ্গীতানুষ্ঠান’ করার জন্যে হল বুকিং দেই। ইচ্ছে ছিল স্থানীয় শিল্পীদের কাউকে নিয়ে বরাবরের মত ‘আশ্রম একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের’ আয়োজন করবো। হুজুগের মাথায় হল বুকিং আর অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করলেও আমি বরাবরের মত আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবের সাথে অনুষ্ঠান নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দেই। তাদেরকে আমার অভিপ্রায়ের কথা বলি। আমার কথা শুনে অনেকেই বলেন, খুব চিন্তা করে ডিসিশান নিবেন। শহরের অবস্থা ভাল না। বিশেষ করে, কোভিডের পরে অধিকাংশ মানুষই আর আগের মত সামষ্টিকভাবে একত্রিত হতে আগ্রহবোধ করে না। কোভিডের সময় একাএকা থাকাটা এখন মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। স্মার্ট ফোনের সাথে মানুষের সম্পর্ক এতই রসালো যে এখন অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা রীল, টিকটক আর ইউটিউবে কাটিয়ে দিতে পারে।

তবে কথায় আছে না ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু বাদ দেওয়া যায় না। ঠিক সেভাবে আশ্রমের আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বাদ দেওয়া যায়নি। কোভিডের পর আশ্রম কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের শুরু মূলতঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু ভাইয়ের “আমার মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবকে কেন্দ্র করে। শাহেদ বখত ময়নু ভাই একাত্তরের রনাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে অটোয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত। সম্প্রতি ময়নু ভাই, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক "আমার মুক্তিযুদ্ধ" নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের তরুণ সাংবাদিক লেখক জাবেদ ভূঁইয়া'র অনুলেখন এবং লেখক মহসীন বখতের সম্পাদনায় বইটি "নাগরী" প্রকাশনা, সিলেট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। (গ্রন্থটি বাংলাদেশে এম. খছরু চৌধুরীর কাছে এবং অনলাইনে "রকমারি ডটকম" থেকে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।) বাংলাদেশে বইটি প্রকাশের পরই আমি এবং বইটির সম্পাদক লেখক মহসীন বখত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সময় সুযোগ করে আশ্রমের ব্যানারে অটোয়ায় গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব করবো। ঘটনাচক্রে মহসীন ভাইয়ের ছেলে অদিবের বিয়ের সময় আমি বাংলাদেশে। আমার মনে আছে বাংলাদেশে পৌঁছে মহসীন ভাইকে ফোন করার সাথে সাথে বলেছিলেন “কাল রাতে অদিবের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, আপনি আজই চলে আসুন”। আমি বললাম, মহসীন ভাই, দুই ঘন্টা হয় আমি বাড়িতে এসেছি। আজ না। কাল আসবো। পরের দিন আমি মহসীন ভাইয়ের বাড়িতে যাই এবং অদিবের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান অংশ নেই। সারারাত ধরে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, সেখানে আগত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মৌলভীবাজার, রাজনগর এলাকার কয়েকশ আওয়ামীলীগ কর্মী, নেতাদের উপস্থিতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়নু ভাইয়ের বর্ণনায় লিখিত “আমার মুক্তিযুদ্ধ” বইটির প্রথম মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলাদেশ একাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ। প্রথম মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারা এবং মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব আর বিদগ্ধজনের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা আমাকে ময়নু ভাইয়ের বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করতে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশ থেকে ফেরত এসে আবার আমি এবং মহসীন ভাই একসাথে বসি। তবে এবার আমাদের সঙ্গে আশ্রম সম্পাদক সুলতানা শিরীন সাজি এবং মহসীন ভাইয়ের স্ত্রী ইউটিউবার গুলজাহান রুমি। আমরা চারজন বসেই “আমার মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেই এবং গ্রন্থটির মূললেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু ভাইকে আমাদের আগ্রহের কথা জানাই। ময়নু ভাই আমাদের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হন। এই আয়োজনে আরও দু’জন মানুষের অবদানের কথা না লিখলে আমার এই কাহন পূর্ণতা পাবে না। একজন আমাদের সবার প্রিয় ড. মনজুর চৌধুরী এবং অন্যজন বন্ধুবর, সামাজিক-সাংস্কৃতিককর্মী সৌরভ বড়ুয়া। উনারা দু’জনই হল ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ে সুপরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এভাবেই শুরু। অনুষ্ঠানকে কিভাবে সুন্দর করা যায় তা নিয়ে প্রতিদিনই ডোনাল্ড টিমহরটন্স বা অন্য কোথাও আমাদের বসা হয় - আলোচনা হয়। 

২০ আগস্ট, ২০২৩ “আমার মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিপূর্ণতার দিক দিয়ে কোনো কমতি ছিল না। সুলতানা শিরীন সাজি এবং গুলজাহান রুমি তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে প্রকাশনা উৎসবটিকে সুন্দর করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কথায় আছে না, “যার সাতে হয় না, তার সাতাইশেও হয় না” হাজার চেষ্টা করেও অনেক গল্পের হ্যাপী এন্ডিং করা যায় না। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু ভাইয়ের “আমার মুক্তিযুদ্ধ” প্রকাশনা উৎসবের শেষটাও আমরা আমাদের মতো করে শেষ করতে পারি নি। আমাদের ইচ্ছা ছিলো, ৩ ঘন্টার এই অনুষ্ঠানে আমরা ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত গ্রন্থটির ভিতরের কথা জানবো এবং শুনবো। সেই উদ্দেশ্যে আমরা অটোয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা, কানাডার মন্ট্রিয়েলে বসবাসকারী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গবেষকসহ অটোয়ার অনেক সুধীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি। আয়োজনের দিক দিয়ে শ’র মধ্যে শ’ প্রাপ্ত অনুষ্ঠানটি দু’য়েকজন আলোচকদের অধিক সময় নিয়ে আলোচনা করার কারণে ঐদিন অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপবিষ্ট অনেকেই আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি। কিছু আলোচক তাদের জন্য নির্ধারিত ১৫/২০ মিনিটের জায়গায় ৪৫/৫০ মিনিট আলোচনার সময় নেন। একজনের আলোচনায় তো মনে হচ্ছিল তিনি সবজান্তা, তাঁরমতো করে আর কেউ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের ইতিহাস জানে না। তাঁরমতো সজ্জন আর জ্ঞানী মানুষের মনে রাখা উচিত ছিল, এটা তাঁর ঘরের ড্রয়িংরুম না। এটা একটা বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। তিনি একবারও ভাবেননি যে, তার আলোচনার পরে আরও কিছু গুণিজন বইটি নিয়ে আলোচনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। দু’য়েকজন আলোচকের কারণে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু ভাইয়ের “আমার মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থটি নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরো অনেকের আলোচনা শুনতে না পারলেও আশ্রমের প্রকাশক হিসেবে, আয়োজকদের একজন হিসেবে আমি খুব আনন্দিত। কারণ, ২০০৯ সালে প্রথম সংখ্যা আশ্রমের সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম যে, পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর ভালো কাজে সহযোগীতা করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। অটোয়ায়  “আমার মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদ আর প্রেরণা।  এছাড়া এই অনুষ্ঠানটি আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সফলতার মূল চাবিকাঠি। (চলবে…)  

কবির চৌধুরী
প্রকাশক, আশ্রম
২৩/১২/২০২৩
অটোয়া, কানাডা