অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ভিন্ন জীবন (দশ) - সুফিয়া ফারজানা

ড়াই বছর বয়সী মেয়ে ময়নাকে নিয়ে গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে বেশ সুখেই ছিল মতিনের বউ সালমা। বৃদ্ধ শ্বশুর জলিল মিয়া নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করেন তার একমাত্র ছেলের বউকে। শ্বাশুড়ি মারা গেছেন অনেক আগেই। ছোট ননদ মুন্নী গ্রামের কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবার। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়। জমিজমা ভালোই আছে। সালমার স্বামী মতিন ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় বেশ ভালো বেতনেই চাকরি করে। মতিনের বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে বেশ অবস্হাপন্ন ঘরেই। ছোট বোন মুন্নীরও বিয়ের কথাবার্তা চলছে। 

প্রায় এক বছর হয়ে গেল, বাড়িতে আসে না মতিন। ইদানীং মোবাইলে কথাও তেমন বলে না সে। তবে টাকাপয়সা ঠিক মতই পাঠায়। সালমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। আগে তো দুই তিন মাস পর পরই বাড়িতে আসতো মতিন। আর আজ প্রায় এক বছর হয়ে গেল, নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি আসাই ছেড়ে দিয়েছে সে। জলিল মিয়া ইদানীং অস্হির হয়ে উঠেছেন তার একমাত্র পুত্রের জন্য। বার বার সালমাকে জিজ্ঞেস করেন, "ও বউমা, মতিন বাড়ি আহে না ক্যা? একবার আইতে কও। আমার শরীর ভালা না। কবে হুট কইরা মইরা যাই! পোলাডারে কতদিন দেহি না....." 

ননদ মুন্নীও বলে, "ভাইজানের কি হইছে, ভাবি? বাড়িত আহে না ক্যা? তোমার লগে কথাও তো কয় না, দেহি, আগের মত। ঝগড়া হইছে নাকি তোমাগো?"

সালমা কোন জবাব দিতে পারে না। ইদানীং সালমা কল দিলে প্রায়ই কেটে দেয় মতিন। নিজে তো কল দেয়ই না বলতে গেলে। কল দিলেও এক মিনিটের বেশি কথা সে বলে না আজকাল। আগের মত ভিডিও কল দিয়ে আর দেখতে চায় না ময়নাকেও। গ্রামের আরেকটি ছেলে রকিবও চাকরি করে মতিনের সাথে একই কারখানায়। সে বিয়ে করেছে নতুন। প্রায় প্রতি মাসেই বাড়ি আসে সে। সালমা একদিন গেল তাদের বাড়িতে। 

রকিবের বউ শিউলি ভালো মেয়ে, বেশ চটপটে। আগে থেকেই পরিচয় ছিল সালমার সাথে। শিউলি বললো, "ভাবি, আসেন, বসেন।"
"কি খবর, শিউলি, ভালো আছো?"
"আছি, ভাবি। আপনে কেমন আছেন?"
"আছি। রকিব আইছে নাকি?"
"না, এই মাসে নাকি কাজের চাপ বেশি। গত মাসেই তো আইছিলো। এই মাসে আর সময় হইবো না নাকি।" 
"ও। তাই?" আর কি বলবে, ভেবে পায় না সালমা। 
রকিবের মা বের হয়ে আসেন, "বসো, বউমা। চা খাও।"
"না, খালাম্মা। যাই, ময়নারে রাইখা আইছি আব্বার কাছে। আইজ মুন্নীও বাড়িত নাই। কলেজ থাইকা পিকনিকে গেছে।"

রকিবের মা ই কথা উঠালেন, "বউমা, মতিন বাড়ি আহে না কতদিন?"
"তা প্রায় এক বছরই হইতাছে, খালাম্মা।"
"এতদিন বাড়ি আহে না? দুধের মাইয়াটারেও দেখতে মন চায় না তার?"
"জানি না, খালাম্মা। ফোনও খুব কম দেয়। তবে টাকা পাঠায় প্রতি মাসেই।"
"একটু খোঁজখবর নিও, বউমা। কি আর কমু তোমারে, অহন দুনিয়াটাই খারাপ। তাছাড়া পুরুষ মানুষের কোন বিশ্বাস নাই। তোমারে কেমনে কই? রকিবের কাছে শুনলাম, গার্মেন্টসের এক মাইয়ার সাথে নাকি মতিনের খুব ভাব। প্রায়ই নাকি তার ঘরে যায় মতিন। সেই মাইয়ার নাকি আবার স্বামী নাই, মইরা গেছে। আমি নিজেই যাইতাম তোমাগো বাড়ি, এই কথাটা তোমারে কইতে। তুমিই আইছো, ভালাই হইলো।"

সালমার মাথাটা ঘুরে উঠে। সে বিশ্বাস করতে পারে না কথাগুলো। তবে সে কিছু বুঝতেও পারে না। মেলাতে পারে না কিছু। যে লোক দুই মাসও বাড়িতে না এসে থাকতে পারতো না, সে আজ এক বছর বাড়ি আসে না। তার এত আদরের মেয়ে, তার ময়নাকেও সে ভুলে গেল? কেন? কার জন্য? কিসের আকর্ষণে?? সালমা কোন রকমে শুধু বললো, "আমি আসি, খালাম্মা।"

শিউলি তার জন্য চালতার আচার আর দুধপুলি পিঠা নিয়ে আসে। "ভাবি, একটু পিঠা খান। আমার বাপের বাড়ি থাইকা পাঠাইছে, আমার মায়ের হাতের দুধপুলি পিঠা, খুব মজা।"
"না রে, ভালো লাগতাছে না। আইজ যাই।"

আর দেরী করে না সে। এক রকম ছুটেই চলে আসে বাড়িতে। ঘরে ঢুকেই চোখ যায়, দেয়ালে টাংগানো তাদের যুগল ছবির দিকে। তাদের বিয়ের পরদিন তোলা হয়েছিল ছবিটা। কী প্রাণবন্ত হাসি হাসছে মতিন ছবিটাতে! সালমাও হাসছে লাজুক হাসি। আরেকটা ছবিতে মতিনের কোলে ছয় মাসের ছোট্ট ময়না। সেই ছোট্ট ময়না এখন কত বড় হয়ে গেছে! সে এখন ময়না পাখির মত কত কথাই যে বলে! তার বাবাকে একটু দেখার জন্য, বাবার কোলে ওঠার জন্য কত কান্না করে!

এখনও পাঁচ বছরও হয়নি তাদের বিয়ের। প্রথম এক বছর বাড়িতেই ছিল মতিন। হঠাৎ কি মনে হল, বললো, শহরে যাবে, চাকরি করবে। গ্রামের কলেজ থেকেই বি এ পাস করেছিল মতিন। শিক্ষিত ছেলে, শহরে যাবে, চাকরি করবে, এটা তো খুশির কথা। কেউ আপত্তি করেনি। সালমাও খুশি হয়েছিল। মতিন প্রথম প্রথম প্রতি মাসেই বাড়ি আসতো। কত কিছু নিয়ে আসতো বাড়ির সবার জন্য, কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি আর কসমেটিকস আনতো সালমার জন্য। মতিন বলেছিল, শহরে একা একা থাকতে তার খুব কষ্ট হয়। কিছু দিন পর ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া করে নিয়ে যাবে সালমা আর ময়নাকে।

সেই মানুষ কেন ভুলে গেল তাকে? কিসের মোহে পরেছে সে? তাহলে রকিবের মায়ের কথাগুলোই কি ঠিক? অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে ওঠে সালমার। এখন কি করবে সে? কি করা উচিত?

পরদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলে ময়নাকে কোলে নিয়ে গ্রাম থেকে বেশ দূরে জেলা শহরে চলে যায় সালমা। তারপর টিকিট কেটে  উঠে পরে  ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনে। ঢাকায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। ময়না খিদে আর জার্নির ধকলে কাঁদতে থাকে। মতিনকে কিছুই জানায়নি সালমা। রকিবকে জানিয়েছিল। রকিব স্টেশনে এসে সালমা আর ময়নাকে রিসিভ করে পৌঁছে দেয় মতিনের ভাড়া বাসায়।। (চলবে)

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ