অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আশ্রম: একটি চেতনার নাম – পঞ্চম পর্ব

কবির চৌধুরীঃ গত কয়েক শনিবারে প্রকাশিত আশ্রম: একটি চেতনার নাম নিবন্ধটি পড়ে আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী মনে করছেন পর্বগুলো বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। এত বড় বড় পর্ব লেখার কোনো মানে হয় না। আজকাল আর মানুষ এত বড় বড় লেখা পড়ে না। পর্বগুলো ছোট করতে পারলে ভাল হয়। বিশেষ করে ডিজিটালের এই যুগে! তাঁদের সাথে আমি একমত। আমি জানি মানুষ এখন আর আগের মতো পড়াশোনা করে না, পড়ার চেয়ে ফোনে নিজের বা অন্যের ছবি দেখতে বেশি ভালবাসে। আমি নিজেও ক’জনের লেখা পড়ি? কিন্তু কি করবো? এই লেখাটি এমনভাবে এগুচ্ছে যে ইচ্ছা করেও তা ছোট করতে পারছি না। তবে কেউ কেউ লেখাটিতে নতুনত্ব খোঁজার চেষ্টা করছেন! এই নতুনত্বটা আমার কাছেও ভাল লাগছে। একটি কিছুকে কেন্দ্র করে প্রতি শনিবারে কিছু লেখার অপেক্ষায় থাকা কি যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! তিলকে তাল করার অভিনব উপায়! 
আশ্রমের ১৫তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই আশ্রম: একটি চেতনার নাম নিবন্ধটি লেখার সূত্রপাত! গতানুগতিক সংবাদ না লিখে অনুষ্ঠানের সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গল্পাকারে পুরোনো কাসুন্দির পুনরাবৃত্তির চেষ্টা! হোয়াট অ্যা টাইম! সময়ের সাথে তাল মিলানো ছাড়া আর কি-ই-বা বলা যায়। এই তো কয়েক বছর আগেও পত্রিকাতে কোন অনুষ্ঠানের সংবাদ দেখার জন্য, সেটা হোক দু’লাইনের বা পুরো একপাতার, সংগঠনের কর্মকর্তা, অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, শিল্পী, কলাকুশলী, বক্তা, এমনকি অনুষ্ঠান দেখতে আসা দর্শকরা পর্যন্ত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু এখন আর সেসবের বালাই নেই। টেকনোলজির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে মানুষের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। অনেকের হাতে তো তিনচারটা। এই স্মার্টফোন আর ফ্রি ওয়াইফাইয়ের কারণে আমরা কোনো অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ধারণ করে রাখতে পারি, সরাসরি সম্প্রচার করতে পারি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনের সাথে, বন্ধুবান্ধবের সাথে অনুষ্ঠানের আদ্যপান্ত শেয়ার করতে পারি। মনে হয় সবার হাতেই যেন একটি স্ট্যান্ডবিহীন ফোরইনওয়ান টেলিভিশন! হোয়াট অ্যা ডিজিটালাইজড যুগ! 

ফেইসবুকে লাইভস্ট্রিমিং আর আমাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সরব প্রচার আর উপস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু দরকারী তা সময়ই বলবে। তবে বর্তমানে এর ব্যবহার আমাদের মতো ছোট ছোট পত্রিকার জন্যে যে খুব সহায়ক শক্তি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে প্রবাসে বসে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের জন্যে তা খুবই উপকারী একটি মাধ্যম। প্রবাসে বসে কোনো পত্রিকাতে সংবাদ প্রকাশ করা বা লেখা খুব সহজ না। এখানে অনেক ভেবেচিন্তে কিছু লিখতে হয়। যদি একটু এদিকসেদিক হয় তাহলে খবর আছে। অনেক সময় সংবাদের বিষয়বস্তুর আলোচনা বাদ দিয়ে কার নাম দিলেন, কার ফটো দিলেন তা’নিয়ে শুরু হয় মুখরোচক আলোচনা। আলোচনার ডালপালা এমনভাবে মেলতে থাকে যে অনেকেই এখন কোনো পত্রিকার জন্যে সংবাদ লিখতে বা ফটো তুলতেই আগ্রহী হন না। ভয় পান। আশ্রমের প্রকাশক হিসেবে একসময় আমাকেও নানামেরুকরণের কথা চিন্তা করে পত্রিকাতে ফটো দিতে এবং নামের উল্লেখ করতে হয়েছে। এমতাবস্তায় বর্তমান সময়ের ফেইসবুক লাইভস্ট্রিমিং এবং ফেইসবুক টাইমলাইনে ফটো আপলোড, অনেক প্রকাশক বা সম্পাদককে অহেতুক চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছে। কাউকে না দিলেও আমাকে দিয়েছে নিশ্চিত। তাইতো আমি গতানুগতিক সংবাদের পরিবর্তে যেমন, কে কি করলেন, কে কোন গান গাইলেন, কার কবিতা কে পড়লেন, কে কি বললেন, কেমন মানুষ হলো, কার ফটো দিব, কার দিব না, এইসব চিন্তা না করে, না লিখে তার পরিবর্তে সংবাদের উপর ভিত্তি করে নিবন্ধকামসংবাদ লিখতেই বেশী আগ্রহী। এতে সংবাদের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়াদি খুব সহজেই পাঠকদের সাথে শেয়ার করা যায় এবং যেহেতু আশ্রম একটি সাহিত্য পত্রিকা এবং এটি বাংলাদেশের বাইরে থেকে প্রকাশিত হয়, তাই সেখানে কোনো অনুষ্ঠানের সংবাদের সাথে আমাদের যাপিত জীবনের বহু কাহিনী অবলীলায় জুড়ে দেওয়া যায়। আপাত দৃষ্টিতে যদিও কাহিনীগুলোর মানে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর অথবা মনে হবে আমার জীবনের কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার গাঁজাখুরি চিত্রায়ন। উদাহরণ হিসেবে এখানে অবলীলায় আশ্রম: একটি চেতনার নাম, লেখার প্রথম চার পর্বের কথা উল্লেখ করা যায়। অথবা এই পর্বে আলোচিত বিষয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। 

বছরের শেষ এবং শুরু। অনেকের কাছে সময়টা ফেস্টিভ হলেও আমার কাছে তা নয়। বছরের এই সময়টা কাজের জন্যে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই মনে করেছিলাম এই শনিবারে কিছু লিখবো না। কিন্তু লিখতে হচ্ছে। কারণ দায়বদ্ধতা! অনেকের কাছে ‘দায়বদ্ধতা’ হাস্যকর মনে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে অটোয়ার সাম্প্রতিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটা খুবই দরকারী। সম্প্রতি অটোয়ার বাংলাদেশিদের পুরাতন সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের একটি ইমেইল, আনন্দকুঞ্জের বিজয় দিবস পালন, এবং উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় লেখক ড. মীজান রহমানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে কিছু আনন্দ, কিছু বেদনা এবং কিছু আশার কথা লিখবো বলে শত ব্যস্ততার মাঝেও কীবোর্ডে দু’হাতের আঙ্গুল চালাচ্ছি।
শুরুতে আনন্দকুঞ্জের মাধ্যমে পাওয়া আনন্দের কথা লেখা যাক। ফেইসবুকে দেখা একটি বিজ্ঞাপন, পরবর্তীতে চিরাচরিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এলাইভ এডুকেশন ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান পিসের কর্ণধার ড. মনজুর চৌধুরীর মাধ্যমে ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় পালকি রেস্টুরেন্টে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারি। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আনন্দকুঞ্জ সম্বন্ধে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ড. মনজুর চৌধুরীও তেমন করে কিছু বলতে পারেননি। অবশেষে অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের বাহারী কথার ফুলঝুরিতে আনন্দকুঞ্জের কিছুটা ধারণা পাই। সঞ্চালকের বর্ণনানুযায়ী, আনন্দকুঞ্জ, অটোয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের বসার জন্য একটি ছোটখাটো কমিউনিটি সেন্টার। এখানে অটোয়ার ছোট-বড় অনেক বাংলাদেশি সময়ে-অসময়ে একসাথে মিলিত হন। খেলাধুলা, আলাপ-আলোচনা, গানবাজনা ইত্যাদি করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন। উদ্যোগটি নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবী রাখে। 

আশ্রম: একটি চেতনার নাম প্রবন্ধের কোনো এক পর্বে আমি আক্ষেপ করে লিখেছিলাম, এ শহরে আমরা অনেক কিছু করি, কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো সবসময় পালন করতে পারি না। এবার আমার সেই আক্ষেপ ঘুছলো মনে হয়! তাই অনেক ব্যস্ততার মাঝেও ড. মনজুর চৌধুরীর সাথে আনন্দকুঞ্জ আয়োজিত বিজয় দিবসের এই অনুষ্ঠানে যাই। গতানুগতিক অনুষ্ঠান। মুখরোচক খাবার-দাবার, চেনা-মুখের উপস্থিতি, ছোট-বড় পারফরমার মিলিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের বড় পাওনা আমেরিকা থেকে আগত ডাঃ মানস কান্তি দাশ এবং অটোয়া ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দীন আহমদের উপস্থিতি! ডাঃ মানস কান্তি দাশের সাথে এর আগে আমার একবার দেখা হয়েছে, কিন্তু ড. নাসির উদ্দীন আহমেদকে আজই প্রথম দেখলাম। অথচ এই গুণী অধ্যাপক গত শতকের ষাটের দশক থেকে অটোয়াতেই আছেন। ড. মনজুর চৌধুরীর তথ্যমতে ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ অটোয়া ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরেট ডিগ্রী শেষ করে অটোয়া ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষাদানে ব্রতী হন এবং এখনো ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ড. চৌধুরী বলেন, “অটোয়া ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করছেন সিংহের মত গত শতাব্দীর ৭০ দশক থেকে। অংকের জগতের বিশেষ শাখা Optimal Control Theory তে অতি সম্প্রতি, তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই “Optimal Control of Dynamic Systems Driven by Vector Measures” সহ ১০ টি বইয়ের লেখক তিনি। তাঁর তাত্বিক কাজের প্রয়োগ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শাখায়। উদাহরণ স্বরূপ, Cancer Immunotherapy ব্যবহার হচ্ছে বায়ো মেডিকেল বিজ্ঞানে, কৃত্রিম হৃদ যন্ত্রের Mathematical Model তৈরী করে কানাডিয়ান স্বাস্থ্য বিভাগে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন অটোয়া ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ইনজিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান।“ 

আমার মতো দুর্ভাগা কয়জন আছে? ড. নাসির উদ্দীন আহমেদের মতো মানুষের কথা জানতে আমাকে ৩৫বছর অপেক্ষা করতে হলো। কিন্তু ভালভাবে কি জানা হলো? বর্ণিত অনুষ্ঠানের সহযোগী এলাইভ এডুকেশনের প্রিন্সিপাল ড. মনজুর চৌধুরী তাঁর আলোচনায় চেষ্টা করেছেন ড. নাসির উদ্দীন আহমেদকে আমাদের সাথে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছোট-বড় শিক্ষার্থীদির সাথে, উপস্থিত সুধীজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে! কিন্তু ড. মনজুর চৌধুরী কী তা পেরেছেন? না, তিনি তা পারেননি। আমরা, অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমাদের ছেলেমেয়েরা, ড. নাসির উদ্দীন আহমেদের মতো একজন গুণী মানুষের সাথে, তাঁর কর্মের সাথে, তাঁর সৃষ্টির সাথে পরিচিত হতে পারিনি শুধুমাত্র একজন সঞ্চলাকের কারণে। একেই বলে আমরা একটি দুর্ভাগা জাতির বংশধর। কী অবলীলায় আমরা গুণী মানুষদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ নষ্ট করি। আমার মতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ষোলকলায় পূর্ণ হতো যদি ড. নাসির উদ্দীন আহমেদকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় জনৈক সঞ্চালক সময়ের দোহাই দিয়ে ড. মনজুর চৌধুরীকে বারবার বাঁধা না দিতেন। এই বাঁধা দেওয়াটা দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। আমি মনে করি এসব ব্যাপারে আমাদেরকে এখনই সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা আমাদের সমাজের একজন গুণী মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, তাঁর সম্বন্ধে কথা বলছি। এই লেখাটি পড়ে অনেকে হয়তো আমার উপর রাগ করবেন। কেউ কেউ বলবেন আমরা কি করবো? আমরা তো এরকমই! কিন্তু আমি বলি আর কতকাল? 

এখন দুঃখ আর বেদনার কথায় আসা যাক। ৫ জানুয়ারি ছিলো উত্তর আমেরিকার পাঠকনন্দিত এবং আশ্রমের নিয়মিত লেখক ড. মীজান রহমানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। মনে কষ্ট নিয়ে লিখতে হয় যে, জীবদ্দশায় আমার, আমাদের অনেকের প্রিয়, শ্রদ্ধাভাজন একজন মানুষের মৃত্যুবাষিকী আমরা মনে রাখি না, ভুলে যাই। উল্লেখ্য ২০১৫ সালের ঐ দিনে ড. মীজান রহমান অটোয়া সিবিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লেখকের সাথে আশ্রমের সম্পর্ক ছিল আত্মার। আমার মনে পরে, অটোয়াতে যখন লেখককে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন তিনি বলেছিলেন- “বাপুরা, অটোয়াতে “আশ্রম” ছাড়া আর কারও দেওয়া সংবর্ধনা আমি নেব না।” তাঁর এই একটি কথাতেই বুঝা যায় তিনি “আশ্রম”কে কতটুকু ভালবাসতেন। বিশেষ করে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। আমি তাঁকে আমার দীক্ষাগুরু হিসেবেই মানতাম এবং এখনও মানি। কিন্তু দেখেন দুনিয়ার লিলাখেলা। জানুয়ারীর ৫ তারিখ চলে গেল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আমরা কিছু করতে পারিনি। অন্ততপক্ষে দিনটিকে কেন্দ্র করে লেখকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে একটা আলোচনারও ব্যবস্থা করা যেত। ফিজিক্যালি না করলেও অনলাইনে করা যেত। কিন্তু আমরা করি নাই, করার চেষ্টা করি নাই। এইসব ছোটখাটো ঘটনা কি ইঙ্গিত করে? মানুষ মরে গেলে কি তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়?  

আমি কারো সাথে কারোর তুলনা করছি না। চলার পথে দেখা যায় অধিকাংশ মানুষই জীবন-সংসারের প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আটকে গেছেন। ড. মীজান রহমান ছিলেন তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, এবং সমাজের জন্যে কাজ করে গেছেন। জীবদ্দশায় নিয়মিতভাবে লিখে গেছেন আশ্রমসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়। লেখক ড. মীজান রহমান এর লেখার সাথে আমার পরিচয় নব্বই দশকের শুরু থেকেই। অটোয়া থেকে প্রকাশিত 'মাসিক বাংলাদেশ' এবং টরন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'দেশ বিদেশে'র মাধ্যমে। আমার মত অসংখ্য পাঠক ড. মীজান রহমান এবং তাঁর লেখার ভক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর লেখার বিষয়বস্তু আর লেখনি। ড. মীজান রহমান এর জন্ম ঢাকায়। ১৯৩২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের কেমব্রিজ ও  কানাডার নিউব্রান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউ ব্র্যান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে গেছেন। গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান তাঁর বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে গণিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে ফলিত গণিতে এম এস সি করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান লন্ডন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। লন্ডনের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর চলে আসেন কানাডায়। 

ড.মীজান রহমান এর লেখালেখির শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে। পড়াশোনার ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে লেখালেখির আগ্রহ কমে যায় এবং একসময় তা বন্ধ হয়ে পড়ে।  তবে আমাদের ভাগ্য ভাল। তাঁর লেখালেখিতে ফিরে আসার অন্যতম মাধ্যম অটোয়ার তথা কানাডার প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের জাতক “বাকাওভ” এর একটি স্মরণিকা এবং অটোয়া থেকে প্রকাশিত 'মাসিক বাংলাদেশ'। সেই যে শুরু হয়েছিল আর থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন। ১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম বাংলা গ্রন্থ 'তীর্থ আমার গ্রাম' প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি, 'লাল নদী' (২০০১), 'অ্যালবাম' (২০০২), 'প্রসঙ্গ নারী' (২০০২), 'অনন্যা আমার দেশ' (২০০৪), 'আনন্দ নিকেতন' (২০০৬), 'দুর্যোগের পূর্বাভাস' (২০০৭), 'শুধু মাটি নয়' (২০০৯), 'ভাবনার আত্মকথন' (২০১০), 'শূন্য' (২০১২) এবং অভিজিৎ রায়ের সাথে 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব' (২০১৫)। এছাড়া তিনি ১৯৯০ George Gasper এর সাথে মিলে  Basic Hypergeometric Series নামে বইটি রচনা করেন। ড. মীজান রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কিছু করতে না পারাটা আমার জন্য দুঃখের, বেদনার আর লজ্জার! জানি না এ লজ্জা ঢাকবো কিভাবে?

গত একমাসে আমার কাছে শ’র উপরে ইমেইল এসেছে। এতসব ইমেইলের মধ্যে, শিয়েতা, ফারজানা মাওলা আর বাকাওভের ইমেইলগুলো একই সুতোয় গাঁথা। এ সপ্তাহের এই আনন্দ ও বেদনার কাহনের সাথে এই ইমেইলগুলো, বিশেষ করে অটোয়ার পুরনো সংগঠন বাকাওভের ইমেইলটি আমাদেরকে অনেক আশা দেখাচ্ছে। অটোয়ায় ধর্মীয় সংগঠন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক, সামজিক, রাজনৈতিক, অনেক ধরণের সংগঠন আছে, নেতানেত্রী আছেন। প্রত্যেকেই তাদের স্ব-স্ব সংগঠনের মাধ্যমে কাজ-কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘বাকাওভ’ ও তাদের আগামী দিনের কাজ-কর্মের জন্যে মেম্বার সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। এই মেম্বারদের মাঝ থেকেই বাকাওভের আগামী নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে গিয়ে যেন আমরা আর কাউকেই জোড় করে কোনো পদে না বসাই। অনুরোধ করে কাউকে না আনাটাই হউক এবারের উদ্দেশ্য। (চলবে…)

কবির চৌধুরী
প্রকাশক, আশ্রম 
৬/১/২০২৪
অটোয়া, কানাডা