অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মীজান ভাই ( ড: মীজান রহমান) এর কাছে চিঠি - শিরীন সাজি

মীজানভাই,

আপনি চলে যাবার আজ নয় বছর। সেদিনও এমনি এক সন্ধ্যা ছিল। ভীষণ বরফ পড়ছিল আর শীতের বাতাস বইছিল। কবির ভাইয়ের সাথে হাসপাতালে যেতে যেতে কত ফোন রিসিভ করেছি। সবাই আপনার কথা জানতে চাইছিল। তখনো আপনি ছিলেন।
হাসপাতালে পৌঁছে আইসিইউ তে পৌঁছেছিলাম যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা প্রায়। রিসিপশনের মেয়েটাকে বেড নং  আর আপনার নাম বলতেই  রুমে ফোন করলো। করিডোর ধরে বিষণ্ণ মুখে কিছুটা ব্যস্ততা নিয়ে এগিয়ে এলেন আপনার বড় ছেলে বাবু। উনি একঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছিলেন ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে। জানালেন, ”আব্বুর কষ্ট হচ্ছে, লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হবে কিছুক্ষণের মধ্যে।” আপনাকে দেখতে যেতে চাইলে বললেন, থাকনা আব্বু তোমাদের স্মৃতিতে যেমন আছে তেমন। একটু জোর করেই বললাম, আমরা উনাকে দেখতে চাই। আপনার বেডের কাছে যখন পৌঁছুলাম, দেখলাম আপনার ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আপনার হাত ধরে। একরাশ যন্ত্রপাতীর ভীড়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন মীজান ভাই। মনে হলো ঘুমিয়ে আছেন। আমি  আপনার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থণা করলাম। জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ বুঝি একেই বলে! একেই বলে মৃত্যু, একেই বলে চলে যাওয়া!, যার স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে।
রুম থেকে বের হয়ে হেঁটে আসছিলাম। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চোখ। অমোঘ সেই মৃত্যু! আপনি চলে যাচ্ছেন! লাইফ সাপোর্টটা খুলে নিলেই আপনি অতীতের একজন হয়ে যাবেন। নিশ্চিন্তে চলে যাবেন সেই অন্যজীবনে, যার ঠিকানা বেঁচে থাকা মানুষ জানেনা। কোন সে দেশ, কোন সে আকাশ নাকি কোন সে মহাশূন্য!

গেটের কাছে আসতেই অনেক চেনা মুখ। সবাই মিলে নানান কথা। আমি চুপ হয়ে বসে ভাবছিলাম কোথায় যাচ্ছেন মীজান ভাই? 
ভালোই তো ছিলেন। ছিমছাম। একাকী নিজের মতন জীবনযাপন। নিজস্ব নিয়মে, নিজস্ব ভালোলাগার জগতে। ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে পড়তেন বেড়াতে। মন্ট্রিয়েল, টরন্টোসহ নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। সবখানেই আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকতো  আপনার প্রিয় মানুষরা। 
আপনি চলে যাবার পর আর সাহিত্য আড্ডা হয়নি তেমন করে। আপনি ছিলেন আমাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। আপনাকে ঘিরে আবর্তিত হতাম আমরা সবাই।

আমার প্রিয় পাশের মানুষকটাকে হারিয়েছি মীজান ভাই ২০২০ এর অক্টোবর এ। হাতের মুঠোর হাত হারিয়ে গেছে! মিঠু নামে না ডেকে ওকে আপনি ডাকতেন মিঠঠু।

বেঁচে থাকাটা ভার লাগে। তারপরেও বেঁচে থাকতে হয়। যত দিন যায়। মনে হয় খুব স্মৃতি নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। জীবনের চলার পথে এখন শুধু হারানোই চলছে বেশি।

যেখানে গেছেন, সেখানে আনন্দে থাকেন মীজান ভাই। ওপারের জীবনটা, এপারের জীবনের মত কি মায়াময়?
আমাদের জন্য মায়া হয় মীজান ভাই?
আমার তো হয়! পাশের মানুষটার জন্ন্য। প্রিয় মা বাবার জন্য, আত্মীয়, বন্ধু সহ চলে যাওয়া পরিচিত মানুষদের জন্য খুব মায়া হয়!

অটোয়াতে যে কোন অনুষ্ঠানে গেলে সামনের সাড়িতে আপনাকে মনে করি। 
আশ্রম এর ১৫ তম বছর পূর্তি  অনুষ্ঠান করলাম আমরা ডিসেম্বর ৩/২০২৩ তে।। মনে হচ্ছিল কোথাও আছেন, হঠাৎ কোথাও  থেকে এসে বলবেন কেমন আছো সুন্দরী? কবি বলেও ডাকতেন মাঝে মাঝে। মানুষ চলে গেলেও কথাগুলো, স্মৃতিগুলো থেকে যায়। আর আপনার মত জ্ঞানী গুণী মানুষ বেঁচে আছেন তাঁর লেখায়।
ভালো থাকেন মীজান ভাই। আমরা ভালো থাকার চেষ্টায় আছি।

শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা 
৫ জানুয়ারী'২০২৪