তৃতীয় ভাবনা - ফরিদ তালুকদার
শহীদ মুনীর চৌধুরীর 'রক্তাক্ত প্রান্তর' যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এখন পরিচিত তার বিখ্যাত সেই দার্শনিক উক্তির সাথে-
'মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়'। অসাধারণ সত্য কথা। শুধু তো মানুষ নয় এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের তাবৎ সৃষ্টিই প্রতিমুহূর্তে বদলায়। 'বিবর্তন'--- একটি অবশ্যম্ভাবী এবং নিরবিচ্ছিন্ন ধারা। সুতরাং সময়ের সাথে আমি আপনি সবাই-ই বদলাই। বদলে যাচ্ছি অবয়বে, বদলে যাচ্ছি মন ও মানসে। এমনকি তেমন ভাবে উপলব্ধি না করতে পারলেও আমাদের মতোই বদলে যাচ্ছে একটি বৃক্ষ, প্রকৃতি, প্রতিটি জীব ও জড়।
পরিবর্তনের এই ধারায়-ই আজ যে আপনার বন্ধু, হরিহর আত্মা, একটা সময়ে এসে হয়তো তার সাথে আপনার সেই সম্পর্কটা তেমন আর নাও থাকতে পারে। এমনকি রূপ নিতে পারে ভিন্ন মেরুতে। এর পেছনে কারণও অনেক হতে পারে। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত? সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তাকে আর বন্ধু না ভাবা? তার প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা কিংবা একেবারে শত্রুর পর্যায়ে ভাবা? নাকি অন্যকিছু?
জানি বিষয়টা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি নির্ভর। তারপরও অনুরোধ করবো এমন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বে আরেকবার ভাবুন। আরেকবার এমন করে ভাবার চেষ্টা করুন যে এই লোকটির সাথেই আপনি অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এবং ওটুকু উপভোগ করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা কিন্তু সেখানেও কিছুটা থেকে যায়। হয়তো পরে তার দ্বারা আপনার অনেক ক্ষতিও হয়েছে। সুতরাং বন্ধুত্বের নবায়ন আর সম্ভব নয়। তাই বলে কি ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলবেন? বেশিরভাগ সময়েই কাউকে মন থেকে ছুঁড়ে ফেলতে খুব বেশি ক্লেশে পড়তে হয় না! কিন্তু কাজটা কতোটা সঠিক? না হয় তার সাথে আর না-ই মিশলেন তেমন। এমন একটা দূরত্ব রেখে চললেন যাতে করে সে আর কোনো ক্ষতি আপনার জন্যে বয়ে নিয়ে আসতে না পারে। এটুকু মেইনটেইন করে তাকে কি তখনো শুভকামনায় রাখা সম্ভব নয়? এবং এভাবে রাখতে পারলে তা কি আপনার মনোজগতেও খানিকটা স্বস্তির বাতাস নিয়ে আসে না? একবার ভেবে দেখা যেতে পারে কি?
অন্যের মঙ্গল কামনায়ই হয়তো নিজের মনে স্বস্তি / শান্তি ধরে রাখার একটি অন্যতম সহজ পথ। এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি।
প্রার্থনায় রাখি আমার বিদায়টা যেন নীরবে প্রচার বিহীন ভাবে ঘটে। তবে সেই বিশেষ মুহূর্তে পৃথিবীর কারোর প্রতি যেন আমার কোনো শত্রুতার বা ঘৃণার মনোভাব না থাকে। নিজের সাথে নিজের এ যুদ্ধটা এখন সার্বক্ষণিক। আর আমার বন্ধু / শত্রু (আছে কিনা জানি না) দু'একজন যদি জেনেও যান আমি আর নেই, বিদায়ের পরে আমাকে নিয়ে কে কী ভাবলেন, বললেন তাতে তো তখন আর আমার তেমন কিছুই যায় আসে না। কারণ জীবনের অল্প যা কিছু অভিজ্ঞতা তাতেই সার জেনে গেছি যে, খুব দ্রুত নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে দেয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির একটি। আর সবটা না জানলেও নিজস্ব উপলব্ধিতে অন্ততঃ এতটুকু ধারণা করতে পারি যে, আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া এই জীবনে মহা আত্মার কাছে আমার ভুল, ব্যর্থতা এবং অপারগতা/অপরাধের দায়ভারের পাহাড় কতোটা উঁচু হয়ে আছে!
সর্বোপরি এই দু'একজন যদি কেউ থেকে থাকেন যাদের মনে আমাকে নিয়ে কোনো ভাবনার উদয় হতে পারে তাও বা কতোদিন কতোটা সময়ের জন্যে? দু'দিন কিংবা দু'ঘন্টা? সময়টা কি এখানেও একটু বেশি বলে ফেললাম? কারণ পৃথিবী যে ব্যস্ত খুবই!
ফরিদ তালুকদার
জানুয়ারী ২৯, ২০২৪
টরন্টো, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
29-01-2024
-
-