অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
প্রয়োজন - সুজিত বসাক

নিশিকান্তের অবস্থাটা আঙুল ফুলে কলাগাছ -এর মতো। বছর পাঁচেকের মধ্যে নাটকীয় উত্থান। বাঁধের ধারে ওর ঝা চকচকে বাড়িটা দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই, সেখানে কয়েক বছর আগেই একটা টিনের আটচালা ছিল। সেই আটচালার ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো নির্লজ্জের মতো ভেতরে ঢুকে পড়তো। 

দোতলার মাথায় মনের মতো করে একটা নিজস্ব রুম করেছে নিশিকান্ত। আদর করে তার একটা নামও দিয়েছে ‘বাগানবাড়ি'। বাগানবাড়ি তার একান্ত নিজস্ব নিভৃত রুম। সবসময় সে ঘরে যাওয়ার অবকাশ না মিললেও সপ্তাহান্তে ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে তরল পানীয় সেবন করে, মস্তি মজলিস হয়। প্রথম প্রথম কোন আপত্তি তোলেনি নিশিকান্তের বউ সবিতা। কঠোর পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে, সপ্তাহের একটা দিন একটু আমোদ ফুর্তি করলে ক্ষতি কী? কিন্তু এখন আর আমোদ ফুর্তি একটা দিনে আটকে নেই। সপ্তাহে দুতিন দিন তো বসছেই, কোনো কোনো সপ্তাহে তারও বেশি হয়ে যায়। সবিতা বুঝতে পারছে, টাকা টাকা করে তার স্বামী ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। তার চোখে অন্যরকম নেশার ঘোর, সমুদ্রের মতো, কোনও কুলকিনারা দেখা যায় না। আগে টাকার মোহে সবিতারও আনন্দ হত, এখন ভয় করে। 
একদিন বলেও ফেলল সেকথা, “তুমি যাদের বাড়িতে ঢোকাও তাদের অনেককেই আমার ভাল লোক মনে হয় না।”
নিশিকান্ত হাসে, “ওদের ভাল মন্দ দিয়ে তোমার কী দরকার? ওরা আমার ব্যবসার পাটনার। ওদের একটু খুশি রাখতেই হয়। এই যে এত এত মনের সুখে খরচ করতে পারছ সে তো ওদের দৌলতেই।”
“সেদিন যে সুন্দর করে মেয়েটা এসেছিল, সেও কী ব্যবসার পাটনার?”
হাসি থামে নিশিকান্তের। চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর মুখে বলে, “ তুমি মেয়েমানুষ , ব্যবসাবানিজ্যের আতাপাতা কিছু বোঝো? টাকা এমনি এমনি আসে না।”
সবিতা থমথমে গলায় বলে, “আমি একেবারে মূর্খ নই। কিছু বুঝি। দ্যাখো, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, এখন এসব বন্ধ করো। আগে তুমি একা বসে ওসব খেতে, আমি কোন আপত্তি করিনি। ধীরে ধীরে  দিন বাড়ল, লোকও বাড়ছে। শেষে বাড়িতে মেয়েমানুষও ঢুকিয়ে ছাড়লে? এই টাকা আমি চাই না।”
“আমাকে কী তোমার কথা মেনে চলতে হবে নাকি? ওপরের ঘরে কী হবে না হবে সেটা কী তুমি ঠিক করবে? মনে রেখো আমি এই বাড়ির গার্জেন।”
নিশিকান্তের গলার স্বর ধীরে ধীরে রুক্ষু হয়ে উঠছে। সবিতা অবাক চোখে তাকায় স্বামীর দিকে। টাকার নেশা এভাবে পাল্টে দেয় মানুষকে!
নিশিকান্ত আপনমনে বলে চলে, “কষ্টের দিনগুলো তো দেখেছ। টাকা ছাড়া সব ফাঁকা। এখন বাড়ি বয়ে সবাই তোয়াজ করে। এসব তুমি চাও না?”
ফুঁসে উঠল সবিতা, “ না চাই না। খারাপ মেয়েমানুষ কেন আসবে বাড়িতে? পাড়া পড়শী এখনও টের পায়নি, পেলে কী হবে বুঝতে পারছ? হয়তো ভয়ে কিছু বলবে না, কিন্তু মনে মনে ঘেন্না করবে। এই টাকা আমি কোনদিন চাইনি।”
“তবে তুমি কী চাও? সব ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকি?”
“একটু স্বচ্ছলতা, একটু স্বাচ্ছন্দ্য সব্বাই চায়। আমিও সেটুকুই চেয়েছিলাম। আমি জেনেছি ওদের অনেকেই গরু পাচারের সাথে জড়িত।”
“আর কী কী জানো তুমি?”
“আমার জানাটা কী ভুল?”
“না। তবে একটু বেশি জেনে ফেলেছ। শোন সবিতা, তোমাকে একটা পোস্কার করে কথা বলে রাখি। ফল খাচ্ছ খাও, গাছের খবর নিতে যেও না, ওরা কিন্তু ভাল লোক নয়।”
নিশিকান্তের মাথা নাচিয়ে কথা বলার ধরণ দেখে হাঁ হয়ে গেল সবিতা। এই কী তার সহজ সরল স্বামী? চোখের সামনে লোকটা এতটা পাল্টে গেছে টেরই পায়নি সে! কান্না পেয়ে গেল সবিতার। 
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ ওরা ভাল লোক নয় বলেই তো বলছি। ওদের সঙ্গে জড়াচ্ছ কেন? নিজের বিপদ তো নিজেই ডেকে আনছো। সবশুদ্ধু মরতে হবে।”
নিশিকান্ত হাসল, অচেনা হাসি, “এত মরার ভয় থাকলে তুমি কেটে পড়তে পার। আমার আরও টাকা চাই। ন্যাকা সত্যবাদী সেজে জীবনটাকে হেঁদিয়ে কাটাতে চাই না। সোজা পথে কত টাকা পাওয়া যায় সে তো এতকাল দেখলাম। যেখানেই পয়সা সেখানেই ঝক্কি। সবাই শালা দেদার লুটছে, আমার বেলাতেই সতীপণা? জীবনের আদ্দেকটা ঠেলেগুজে পার করলাম, আর কবে বেঁচে থাকার মজাটা নেব শুনি? পটল তোলার পর?”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সবিতা। আঁচল ঢেকে চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করল। নিশিকান্ত ওর কাঁধে হাত রেখে
বলল, “মরা কান্না জুড়ো না তো। হয়েছেটা কী শুনি? টাকা যখন আসছে, একটু আয়েশ করে নাও। তুমিও তো অনেক কষ্ট সহ্য করেছ। আরে ওরা খারাপ লোক হলেও আমার কথায় ওঠে বসে। যাদের তুমি প্রতিবেশী বলো ওরা কি খুব ভাল? যখন আমাদের চাল চুলো ছিল না তখন কেউ পাঁচ পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিল? করেনি। এখন একটু টাকাপয়সা হয়েছে আমাদের , সেটাও সহ্য হচ্ছে না। হিংসের জ্বালায়  জ্বলছে।”

আজ একাদশী। মা মারা যাবার পর একবছর নিষ্ঠা সহকারে পালন করেছিল নিশিকান্ত। তবে সবিতা করে এখনও। ওর বাপের বাড়ি আবার বৈষ্ণব ঘর। একটা দিন আধপেটা খেয়ে থাকলে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না, বরং উপকার। পাকস্থলী একটু বিশ্রাম পায়। বাবার দীক্ষা গুরু বৈদ্যনাথ গোস্বামী খুব জোর দিয়ে বলতেন সেকথা। তবে নিশিকান্তকে জোর করে না সবিতা। শুধু আমিষটা খেতে বারণ করে।

একাদশীর দিনেই চরম এক বেয়াদপির কান্ড করে বসল নিশিকান্ত। দুই কিলো খাসির মাংস বাজার থেকে নিয়ে এসে বলল, “ কষিয়ে রান্না করে রাখবে। রাতে কয়েক জন বিশেষ অতিথি আসবে।”
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল সবিতা, “তুমি ভাল করেই জানো একাদশীর দিন আমি আমিষ কিছু ছুঁই না। আমি পারব না। রান্নাঘরে মাংস তুলতেও দেব না। তুমি যেখান থেকে পারো রান্না করে নিয়ে এসে তোমার বিশেষ অতিথিদের খাইয়ো।”
ক্ষেপে উঠল নিশিকান্তও, “এসব নিয়ম-কানুন তোকে কে করতে বলেছে? বুড়ো বুড়িরাও আজকাল একাদশী করে না। মা মারা যাবার পর একবছর তো করেছি। তোর এত কুড়কুড়ানি কেন? তুই কি চাস একটু খুলে বল তো? ইদানিং দেখছি স্বামীকে খুব হেলাছেদ্দা করতে শিখে গেছিস।”
তুই! ভাষাহীন সবিতা। শত অভাবেও নিশিকান্তের মুখে খারাপ কথা বেরুতে দেখেনি সে। এতকাল শুনে এসেছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। এখানে তো উল্টা পুরাণ! আসলে অসৎ পথে আসা অর্থ সাথে করে অনৈতিকতাও নিয়ে আসে। সবিতা আর একটা কথাও বলল না। নিশিকান্তের ফেলে রাখা ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। নিশিকান্ত একটু অবাক হল। ভেবেছিল যে মেজাজে শুরু করেছে সবিতা তাতে সহজে ছাড়বে না, কিছুটা সময় টানবে। একদিক থেকে ভালই করেছে সবিতা। নিশিকান্তের মেজাজটাও যেভাবে চড়ে গিয়েছিল তাতে নির্ঘাত দুচার ঘা বসিয়ে দিত। আজকাল মেজাজটা বশে থাকে না, বুঝতে পারে সে। বাপ ছিল নিরীহ মানুষ, বউ পেটানো মেজাজ ছিল ঠাকুদ্দার। ঠাকুদ্দার মেজাজটা তার মধ্যেও ফিরে আসছে নাকি? আনমনে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় নিশিকান্ত।

রাতের মজলিস যথাসময়ে জমে উঠল। আজ অতিথির দলে রয়েছেন পুলিশের দুই বড় কত্তা। তেনারাও এখন নিশিকান্তকে  ‘বাবু’ বলে সম্মোধণ করেন। টাকার এমনই মাহাত্ম্য! শুধু সবিতাই বুঝল না। তবে রেগে মেগে রাঁধলেও বেড়ে রেঁধেছে মাংসটা। অতিথিরা খুব খুশি। সবিতার উপর আর এতটুকুও রাগ নেই নিশিকান্তের। ধীরে ধীরে ঠিক পথে আসবে। আরে! থানার বড়কর্তারা যেচে নেমতন্ন নিতে চাইলে সে কেমন করে না করে? ওরা চটলে ব্যবসাও চৌপাট, কে বোঝাবে সবিতাকে? একাদশী দ্বাদশী আসবে যাবে, কিন্তু বাবুদের মুড বেগড়ালে যে সারাজীবন একাদশী করতে হবে!

বড়সাহেবের বাঁ হাতে মদের গ্লাস, ডান হাতে মাংসের টুকরো। ঢকঢক করে মদ খাচ্ছেন, গপগপ করে মাংস খাচ্ছেন। দেখে মন ভরে গেল নিশিকান্তের। ওদের পরিচর্যার দায়িত্ব ফুলটুসির। ওর বেসামাল যৌবন বারুদের স্তূপের মতো বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। নেশাটা মাথায় গড়াতেই বড়সাহেবের দেয়াশালাই কাঠিটি জ্বলে উঠল। হ্যাচকা টানে ফুলটুসিকে কাছে টেনে জাপটে ধরলেন। পাঁজাকোলা করে তুলে টলতে টলতে নিয়ে গিয়ে ফেললেন পাশের খুপড়ি ঘরের বিছানায়। ফুলটুসি মুচকি হাসে। শালাদের কত রঙ্গ! এই মাতালদের সে চেনে, অল্প জলের মাছ, খলবল করে বেশি। নেচে কুঁদে বীরত্ব দেখানোর চেষ্টা করলেও আসলে লতানে গাছ।

অতিথিদের বিদায় করে নিশিকান্ত ফুলটুসির হাতে একগুচ্ছ টাকা দিয়ে বলল, “ বড়সাহেবের খুব মনে ধরেছে তোকে। সামনের টিপটা ম্যানেজ হয়ে গেলে আবার ডাকব ওদের। পাট্টি হবে। তখন আরও টাকা পাবি। এখন তুইও আমার ব্যবসার পাটনার।”
খিলখিল করে হেসে উঠল ফুলটুসি, “আমি পাটনার! হাসালে নিশিদা। ওসব টোপ দিও না। আসল পাটনারই কলা দেখিয়ে বেচে দিয়েছিল আমাকে। এখন সবাই আমার পাটনার, তবে দুদিনের।”
নিশিকান্ত চোখ পাকিয়ে বলল, “একটু বেশিই টেনেছিস মনে হচ্ছে। অনেক রাত হল। বাইরে মকবুল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। যা এবার কেটে পড়।”
“না, আমি যাব না। আজ তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। প্রতিদিনই কাজ হয়ে যাওয়ার পর আমাকে ভাগিয়ে দাও।”
নিশিকান্ত গম্ভীর হল, “দ্যাখ ফুলটুসি পাগলামি করিস না। ব্যবসার প্রয়োজনে তোকে ডাকি, মানে ডাকতে হয়, তার বেশি কিছু না সেটা মনে রাখিস। তোর ফুল পেমেন্ট তো দিলাম, আর কী চাস?”
ফুলটুসি ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, “ঠিকই বলেছ নিশিদা। আমি হলাম গিয়ে প্রয়োজন। কিন্তু আমারও তো কিছু প্রয়োজন থাকতে পারে, সেটা কেউ বোঝে না। তুমি নেবে? তুমি চাইলে তোমার সাথে কোন ব্যবসা করব না। পুরো ফ্রি। আমি সবার প্রয়োজন, একদিন তুমি আমার প্রয়োজন হও। হবে?”
“তোর নেশা চড়ে গেছে, উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করেছিস। আমার বউ আছে, ছেলেমেয়েরা আছে, একটা কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ছাড়বি দেখছি।”
“সে তো সবারই থাকে নিশিদা। তার জন্য কী এসব বন্ধ হয়ে আছে? এই যে একটু আগে পুলিশের দুই বড়বাবু এসব করে গেল, ওদেরও নিশ্চয়ই বাড়িতে বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে। বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বউয়ের পাশে শুয়ে দিব্যি মিথ্যে চালাবে, ডিউটি সেরে এলাম। কীসের জন্য এত টাকা করছো? নিজেও একটু  ফূর্তি করো।”

মায়াবী রাত। একটু আগেই বাইরে দেখে এসেছে নিশিকান্ত, একটা থালার মতো চাঁদ দক্ষিণের আকাশে ঝুলে আছে। নেশা ধরানো একটা ফিনফিনে হাওয়া বইছে। আশেপাশের বাড়ি গুলো প্রেতনগরীর দালানের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। দূরে নদীবাঁধের দিকে দুচারটে আলোর চলাফেরা, মাছের আশায় জাল পাতছে জেলেরা।
ওদের আবদারে একটু গিলেছে নিশিকান্তও। অতিথি থাকলে খেতে চায় না সে। তাতে অতিথি সৎকারে ব্যাঘাত ঘটে। সে খায় পরে, সবাই চলে যাওয়ার পর। হাওয়ার দমকে নেশা ছড়াচ্ছে, বুঝতে পারল নিশিকান্ত। সামলে নিয়ে বলল, “আজ কী শুরু করলি বল তো? এরকম করলে এরপরে অন্য কাউকে ডাকব।”
“সে ডাকতেই পারো। পয়সা ছড়ালে আমার মতো হাজারটা মেয়ে পেয়ে যাবে। আমি তোমার একটু সেবা করতে চাইছি, সেটাতেও তোমার আপত্তি? তুমি কেমন পুরুষ গো? ফুলটুসি কিন্তু সবার কাছে হাত পাতে না। আমার কাছে তুমি অন্য পুরুষ, তাই তো …”
হেসে উঠল নিশিকান্ত, “তুই আমাকে ভালবাসিস? এত পিড়িত দেখাচ্ছিস কেন?”
নিশিকান্ত নিজের কথাতে নিজেই অবাক হল। নেশা ছড়াচ্ছে মাথার অলিগলিতে। সর্বনাশের আগুনের ফুলকি উঠছে। চিড়বিড় করে জেগে উঠছে ঘুমন্ত সাপ। সামনে সুন্দরী ফুলটুসি। চোখে কতকালের উপোসী চাউনি। 
দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভেতরটা জেরবার করে দিলেও শেষ পর্যন্ত কামদেবের শর গেঁথে গেল নিশিকান্তের মনে। একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। দখল নিচ্ছে মনোরাজ্যের। কামাগ্নির উত্তাপ বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছল, মনে হল সব ভস্ম হয়ে যাবে। এক্ষুণি কোন শীতল সরোবরে অবগাহন দরকার। তীব্র দহন যন্ত্রণা নিয়ে নিশিকান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল শীতল সরোবররূপী ফুলটুসির ওপর। ডুবে যাচ্ছে নিশিকান্ত। আহ্, কি শান্তির অবগাহন! এর জন্যই কী এত আয়োজন? এই কী সেই মোক্ষের ঘর? 
আসঙ্গ লিপ্সায় মাতাল বেহুঁশ দুটো নরনারী বাহ্য জ্ঞান শূন্য। চারপাশের দৃশ্যমাণ জগৎ আপাতত তাদের চেতনা বহির্ভূত। কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। হঠাৎ নিশিকান্তের চোখ গেল জানালার দিকে। নিমেষে পার্থিব শরীরের ভূমিতে নেমে এল তার চেতনা। কে? কে ওখানে? সবিতা নাকি? এত রাতে ও এখানে কী করতে এসেছে? ছিটকে সরে গেল নিশিকান্ত। 
ফুলটুসি বিরক্ত গলায় বলল, “ভূতে পেল নাকি তোমাকে? এভাবে কেউ সরে যায়?”
নিশিকান্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, “সর্বনাশী এক্ষুণি তুই বেরিয়ে যা। আমার মাথায় খুন চেপে যাচ্ছে, পালিয়ে যা, নইলে মেরে ফেলব।”
ভয় পেয়ে গেল ফুলটুসি। দ্রুত পোশাক পরে নেমে গেল নীচে। একটু পরেই গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল নিশিকান্ত।

পরের দিন সকালে সবিতার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে নিশিকান্ত বুঝতে পারল রাতে তার দেখার ভুল ছিল না। বেপরোয়াভাবে বলে উঠল, “তুমি কি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করা শুরু করেছ? এসবের মানে কী? আমি যা করছি সেসব তোমাদের ভাল রাখার জন্যেই করছি। তবু এত সন্দেহ কীসের? এখানে কিন্তু তোমার চলবে না, কথাটা মনে রেখো।”
সবিতা শান্ত গলায় বলল, “তোমারই তো চলছে। আমি ওদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি। ভাইকে বলেছি, ও নিতে আসছে। তুমি তোমার মর্জি মতো তোমার বাড়িতে থাক। আমি জানি আমাকে আর কোন প্রয়োজন নেই তোমার। অপ্রয়োজনীয় জিনিসকে তো মানুষ ফেলেই দেয়।”

প্রয়োজন। সবিতার শেষের কথাটা কানে এসে বাজল নিশিকান্তের। কাল রাতে ফুলটুসিও এই কথাটাই শুনিয়েছিল তাকে। তখন কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু এইমুহুর্তে মনে হল, ছোট্ট একটা শব্দ, অথচ যেন কত অর্থ ধারণ করে আছে বুকে। মানুষের কতরকমের প্রয়োজন! কারও টাকা প্রয়োজন, কারও বাড়ি প্রয়োজন, কারও গাড়ি প্রয়োজন, কারও নারী প্রয়োজন, কারও শুধু ভালবাসা প্রয়োজন, এই প্রয়োজনই তো টেনে হেঁচড়ে দৌড় করাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এই প্রয়োজন শব্দটা কী শুধুই মনের বিকার? আপেক্ষিক একটা শর্ত মাত্র? অথচ এই প্রয়োজনকে জীবন আবর্তিত হয়। হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাত্রার হেরফের হলেই যত গোলমাল। এই মুহূর্তে সবিতা ও নিশিকান্তের মধ্যে সেটাই বোধহয় হচ্ছে।

চলে গেল সবিতা। নিশিকান্ত চেয়ে চেয়ে দেখল। কিছুই বলতে পারল না। অথচ মনে মনে বলতে চাইল অনেককিছু। যাবার সময় সবিতা এমনভাবে বাড়িটার দিকে তাকাল, সেই দেখার মধ্যে বেদনার সাথে আরও অনেক কিছু মিশে ছিল। নিশিকান্তের মনে হল, বদলে গেছে দৃশ্যপট। সেই আটচালার বাড়ি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে সামনে। একটা খেটে খাওয়া মানুষের ভাঙা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুখগুলোকে খুঁটে খুঁটে আঁচলে ভরে নিচ্ছে সবিতা, যে সুখগুলো সেই খেটে খাওয়া মানুষটার আর প্রয়োজন নেই। এখন সে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুখে থাকে। ইচ্ছে করলেই সুখ কিনে নিতে পারে অনেক টাকা দিয়ে। তবুও কেন জানি হু হু করে উঠল নিশিকান্তের বুকের ভেতরটা। 

সুজিত বসাক
দিনহাটা, গোপাল নগর
কোচবিহার, ভারত