একা - ফাহমিদা রিআ
রুখসানা কাঁদছে। আমি অবাক বিস্ময়ে ওর ফুলে ফুলে ওঠা কান্না দেখছি। কোমরে গোঁজা চাবির গোছাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলি,
- বাবা তো মেয়ে কে দেখতে আসবেই । আগে বাসায় ঢুকতে দে, কথা বলি।
- না খালাম্মা খুলবেন না। আমার বেতনের টেকা নিতি আসতিছে, আমার মায়ের জন্যি রাখা শাড়ি নিয়ে যাবে, আমারেও নিবে।
কলিং বেলটা বেজেই চলেছে। চাবি হাতে নিজেই নেমে আসি।
কলাপসিবলের ওপারে দাঁড়ানো এক লোক। ষাটের কাছাকাছি বয়স। মাথায় স্বল্প ক’গাছি চুলে মেহেদির রঙের লাল আভা। ফতুয়া টাইপের শার্ট আর আধ ময়লা চেক লুংগি পরনে। পান খাওয়া দাঁতগুলোতে হাসি ছড়িয়ে বলে - বুবু আমি রুখসানার বাপ, মেয়েরে দেখতি আসছিলাম। তালা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ডাকি রুখসানাকে।
- তোর বাবাকে ঘরটা খুলে বসতে দে।
রুখসানা নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়ায় বাবাকে বসতে দিয়ে। ওর বাবা গার্ডেন চেয়ারে বসে অনবরত পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এবার সরাসরি চাইল আমার পানে।
- অনেক অভাব বুবু। আজ আট দিন হতিছে বড় মেয়েডার বিয়া দিছি। বিশ’হাজার টেকা ডিমান্ড। দশ’হাজার শোধ কইরে বিয়া পইড়েছে। বাকি তিন হাজার জামাইরে তুলি দিতি পারলি মেয়েডারে শ্বশুর বাড়ি নে যাবে। দুই/চার কানি জমি জিরাত যা ছিল হগলডি বেইচে ফেলতি হয়েছে। এখন আপনারা যা দিবেন। রুখসানার ক’মাসের বেতনডাও তুলতি চাইছিলাম।
রুখসানা ফুপিয়ে ওঠে আবারো,
- না দিব না। কিছু দিব না। আমি কষ্ট কইরে কইরে জমায়ে রাখছি মায়ের জন্যি। মায়ের অনেক কষ্ট।
মিনমিনে কন্ঠেই গর্জে ওঠে লোকটি -
- কি কইলি মায়েরে দিবি? তোরে কাজে পাঠায়ে ছিলাম তো আমি। কে তোর মা?
- মার কাছ থেকে কেইড়ে এনেছেন আপনি আমারে। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে রুখসানা।
- কি! এত বড় কথা? বেইশ তবে চল আমার সাথে মায়ের কাছে ফেইলে রেইখে আসবো, মার খেইয়ে খেইয়ে পাঁজরের হাড় বারাবে সেইটেই তোর ভাল।
- না আমি যাবো না। খালাম্মা একা থাকতি পারে না।
- আমার মেয়েরে আমি নিয়ে যাতি এসেছি।
কঠিন মুখ করে বলে লোকটি আমাকেই।
- কোন বাধা মানতি চাইনা।
রাগ হল আমারও।
- নিতে এসে থাকলে নিয়ে যাবেন। ওভাবে কথা বলছেন কেন ?
একটু মিইয়ে গেল লোকটি। আমতা আমতা ভঙ্গিতে বলতে থাকলো
- আমি ঠিক তা কতিছি না। কি আর কবো বুবু ওর মা বড়ই উচ্ছৃংখল ম্যায়া মানুষ। ঘরে রাখলি বংশে চুন কালি দেয় এমন। তালাক দিয়েছি কি সাধে ? শুনতি চান সে কাহিনী ?
- না। আপনি কেন এসেছেন তাই বলেন ? কঠিন মুখ করেই শুধাই।
- রুখসানারে নিতি এসেছি। ওর দেনা পাওনা মিটায়ে দেন, চইলে যাই।
- না খালাম্মা, আমি যাবো না।
আমার হাত চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রুখসানা। এতটা সময় ও আমার কাছে আছে, এমন করে কখনও কাছে আসবার সাহস তো দেখিনি এর আগে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলি
- ভয় নেই, আপনার মেয়ে আপনার কাছেই যাবে। অন্যের মেয়েকে আমি আটকাবই বা কেন ?
- খালাম্মা আপনার মেয়েটা যে নেই, আপনি তো একা থাকতি পারেন না খালাম্মা। আমারে যেতি দিয়েন না, আমি যাব না।
কান্নার দমকে অজস্র কথা বলে চলে রুখসানা।
আর কথা বাড়াতে মন চাইলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চেয়ারটা টেনে বসলাম। ওরা বাবা মেয়ে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিক। রুখসানার স্থায়িত্ব যে চির দিনের নয়, তাতো সব সময়ই জানি, তবু বুকের মধ্যে এমন চিন চিনে কষ্টটা জাগছে কেন।
দশ/এগারো বছরের এই একরত্তি মেয়েটা আজ হঠাৎ করেই যেন কেমন বড় হয়ে উঠেছে। আমার দুর্বল জায়গায় নাড়া দিয়ে সে থাকবার প্রাণপন চেষ্টা করছে। কিন্তু অবুঝ মেয়েকে কি করে বোঝাই, পেটে ভাতে কাজ করতে আসা তোকে কোন ঐশ্বর্যের বলে আটকাবো বলতো ? অবিচ্ছেদ্য রক্তের দাবির কাছে কিছু টেকে নাযে ।
সেই যে আমার মেয়েটা আমার সারা মনে হাহাকার তুলে চলে যাবার পর মেয়ের বাবাও কদিন থেকে আপন কর্মস্থল প্রবাসে পাড়ি জমালেন প্রতি বারের মত। যজ্ঞের ধনের মত আগলে মস্ত ফাঁকা বাড়িটায় পড়ে রইলাম আমি। আত্মীয় স্বজনরা প্রথম প্রথম এলো-গেলো, সঙ্গ দিল যথাসাধ্য। তারপর এক সময় আপন আপন ব্যস্ততায় ব্যস্ত হল সবাই।
সন্তানরা ফিরলো বাবা মায়ের কাছে। বাবা মায়েরা সন্তানের কাছে। আমি হিসেবের অতিরিক্ত ’মা’ হয়েই রইলাম শুধু কোল শুন্য হয়ে।
ঠিক এমনি সময় আগমন রুখসানার। আমার ঠিকা বুয়াটি একদিন সঙ্গে করে নিয়ে এসে যা জানালো তার সারমর্ম হল - মেয়েটা গ্রাম সম্পর্কে তার নাতনী। বাড়িতে সৎমায়ের যন্ত্রনায় বাবা কাজে পাঠিয়েছে এক বাসায়। সেখান থেকে মারধরের ভয়ে চলে এসেছে ক’দিন হল। আমি মেয়েটিকে রাখতে পারি চাইলে।
অগতির গতি বলে কথা। বেহাল অবস্থা তখন আমারও, ওরও। আর তাই টিকে গেল মেয়েটি সবাইকে তাক করে দিয়ে। নইলে এর আগে দু’দিনের জন্য এক পিচ্চি কাজের জন্য এসে এই বিরান বাড়িটায় থাকতে পারবেনা বলে চলে গেছে।
প্রথম দিনেই রুখসানা এসে গুছিয়ে নিলো ওর জায়গাটাকে। আমার ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দার কোনে ফেলে রাখা ছোট চৌকির ওপর জামা কাপড়ের ছোট পুটলি খুলে ওর ক্ষুদ্র সংসারটাকে সাজিয়ে নিলো। পড়ে থাকা আইসক্রিমের বাক্সে সাজ সজ্জার বহরও ছিলো। ভাঙ্গা আয়না, অর্ধেক চিরুনির টুকরো, লিপিষ্টিকের অংশ, রংচটা ইমিটেশনের চুড়ি, দুল আরো অপ্রয়োজনীয় কত কি। দেখে শুনে মনে হলো -
ক’দিনে নিজের মনটাকে নিজেই বসাতে সচেস্ট।
তারপর এক এক করে দিন গড়ায়। একটু একটু করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি আমি ওর ওপর। ঘরে বাইরে সর্বত্র সঙ্গী হয়ে যায় রুখসানা। ধীরে ধীরে ঠিকে বুয়ার অনুপস্থিতিতে ও দুটো একটা দিনের জন্য বেশ চালিয়ে নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত ভুলতেই বসেছিলাম ওর দাবিদার সত্যিকারের মানুষ গুলোর কথা। তারপরই এই বিপত্তি। আর বিপত্তিই বা বলছি কেন? সন্তানের কাছে বাবা তো আসবেই।
কিন্তু বিপত্তিটা ঘটিয়েছে রুখসানা নিজেই। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ির সংসার। উভয়ের আলাদা আলাদা জীবনে রখসানা দেখে মায়ের ঘরে, বাবার ঘরে তার জন্য বরাদ্দ ভালবাসা নেই। আছে বাড়তি হবার যন্ত্রনা। অত্যধিক অবহেলা অত্যাচারে এই বয়সেই আপন পর চিনেছে। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করেছে সে নিজের কর্মের বিনিময়ে। কারো দয়া বা করুণা নিতে সে নারাজ। অপ্রয়োজনীয় হয়েও নয়। এই বোধ ওর এসেছে কি-না জানি না তবে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বার বার সে উচ্চারণ করছে ওর বাবার সামনে
- দেশে গিয়ে আমি কি করবো? আমি চলে গেলে খালাম্মার কাছে থাকবার কেউ নেই যে।
অবাক হয়ে ভাবি, স্বল্পকালীন এই সংসারটায় এমন করে বাঁধা পড়েনি কেউতো আমার মায়ার ডোরে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে রুখসানা এসে দাঁড়ায় এ সময়। বলি
- কিরে বাপ-মেয়ের বোঝাপড়া হলো?
হাতের নখ খুটে মাথা নিচু করে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে
- টেকা চায়। টেকা পেলেই চলি যাবি, আর আসবেনা বলতিছে।
- আর তুই?
- আমারেও নিবে না।
- নাকি যাবি না? হেসে তাকাই ওর পানে।
আবার মাথা নিচু করে চুপ মেরে যায়। কিছুক্ষণ আগের কান্নার দমক থামেনি তখনও। থেকে থেকে ফুলে ফুলে উঠছে ছোট্ট শরীরটা।
- আয় আমার সঙ্গে। ড্রয়ার খুলে ক’টি টাকা ধরিয়ে দেই রুখসানার হাতে।
- তোর বেতনের টাকা তোরই থাকলো। এটা তোর বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য করলাম।
- আমার বোন না তো আপন। সৎ বোন।
প্রতিবাদী সুর করে কচি গলায়।
হাসতে হাসতে বলি
- বেশ তো তোর সৎবোনের জন্য সাহায্য করলাম।
আর কিছু না বলে টাকা ক’টি হাতে এগিয়ে গেল বাবার কাছে। খানিক পরে ফিরে আসে আবার দু’চোখ ভরা পানি নিয়ে। একটু বিরক্ত হয়েই শুধাই
- কি হলো আবার?
- খলাম্মা, আপনি বাবারে চলি যেতে বলেন আমি আমার মায়ের জন্যি রাখা শাড়ী দিব নানে।
- একি জ্বালাতনে ফেললিরে তুই।
এগিয়ে ঘরে ঢুকি। রুখসানার বাবা তেমনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে। বল্লাম,
- ওর যখন এতই ইচ্ছে শাড়ীটা মাকে দেবার। আপনি বাধ সাধছেন কেন অযথা? এবার আসেন।
উঠে দাঁড়ালো লোকটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এদিক ওদিক তাকিয়ে মেয়েকে খুঁজলো কি না জানি না। গলা নামিয়ে বললো
- বড্ড উচ্ছৃংখল। একটা কথা আপনাকে দিতি হবি আমারে। ওর মা এলি যেন মেয়েরে দিবেন না। মেয়ে আমার উচ্ছন্নে যাবে। ও ছাওয়াল মানুষ, বুঝে না। আপনার দায়িত্বেই রেইখে গেলাম।
আমার যে কি হয়ে গেল। প্রচন্ড জেদ আলোড়ন তুললো হৃদয়ে। মা সেতো মা-ই। দশ মাস গর্ভে বয়ে বেড়ানোর সুখ দুঃখের মিশ্র অনুভুতি সে তো আর কেউ জানে না। এরপরে যদি সে মা সন্তানের দায়িত্ব পালনে অপারগও হয়। তবুও মায়ের অপরিসীম ঋণ শোধ করতে পারে না সেই সন্তান। সন্তান হারা মা আমি। শোক-তাপ বয়ে বেড়ানোর ভার একা আমারই শুধু। এ সত্যতা অনুভব করছি আমি তিলে তিলে। নিচে গেট বন্ধের শব্দ মিলাতে না মিলাতেই রুখসানা ছুটে এলো।
- আমার বাবা চলি গেছে ?
ওর কান্না ধোয়া ছোট মুখটায় বিপদ কেটে যাবার অবোধ প্রসন্নতা দেখে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলি,
- কিরে, আজ চা খাওয়াবি না ? চোখ-মুখ ধুয়ে চট পট চা করে নিয়ে আয় । আমি ব্যালকনিতে বসছি।
অর্ধসমাপ্ত বঙ্কিম রচনাবলিতে চোখ বুলাই বসে বসে। কঠিন শব্দের লাইন দুটো পর পর দু’বার আউড়িয়েও কিছুতেই মাথায় ঢোকাতে না পেরে দৃষ্টি ছুড়ে দেই সামনের গ্রীল গলিয়ে এক টুকরো আকাশটাতে। উদাস হয়ে যায় মনটা হঠাৎ। দৃষ্টির সীমানায় ঐ আকাশের কোল ঘেঁসে ভেসে বেড়াতে দেখি সোনা মেয়েকে আমার। পেঁজা পেঁজা সাদা তুলোর মত নায়ে ভেসে ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটা আমার দূর থেকে দূরে- বহু দুরে সরে যাচ্ছে ত্রমশ। মোচড় দিয়ে ওঠে বুকটা।
- খালাম্মা চা।
রুখসানার ডাকে বর্তমানে ফিরি। ধুমায়িত চায়ের কাপে ছোট্ট ট্রেটা সামনের ত্রিপায়ায় রেখে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে রুখসানা। মুখে খই ফোটায় শত কথার।
কতক কানে যায় কতক যায় না।
ওর কিছুক্ষণ আগে কান্নাকাটি করা ফোলা ফোলা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে ওঠে। কটা মাসইবা হলো ওর আসার। অথচ আমার মেয়ে হারানো মত ফাঁকা জায়গাটার এক কোনে জুবুথুবু হয়ে ও ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে নিজেরই চেষ্টায়।
ঠিকে বুয়ার পিছনে পিছনে বাকুমবাকুম করে সব কাজ কেমন গুছিয়ে নিয়ে টেবিলে খাবার রেখে প্রতিটি বেলা আদেশের সুরে বলে
- খালাম্মা ভাল করে খাবেন, নানী বলে দিয়েছে।
শোবার আগে দুধ গরম করে গ্লাসে ঢেলে দিতে দিতে বলে প্রতিদিনই
- এখনই খান তো খালাম্মা ঠান্ডা হয়া যাবি।
নির্ঘুম চোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাতা কলমে আঁকিবুকিতে আমার মেয়ের অজস্র কথা লিখতে লিখতে মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। অঝোর ধারায় টলোমলো হয়ে ওঠে মনটা। অবুঝ আর অশান্ত হৃদয়ে ক্লান্ত শান্ত হয়ে দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে এক সময়। ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখি চারপাশ সযতনে মশারী গোজা। হাল্কা কাঁথাখানি গায়ে জড়ানো এলো চুলগুলি বেনিতে জড়ানো। এমনি কত রাত যে ভোর হয়। আর এমন রাতগুলোতে আমাকে না জাগিয়ে সনিপুন গৃহিনীর মত দায়িত্ব সেরে পেছনের তক্তপোসের ওপর থেকে ছোট্ট বিছানা তুলে আমার খাটের পাশে কার্পেটের ওপর বিছিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে রুখসানা। শুধু কি শুশ্রুষা ?।
এটা বোঝতে ওটা উপদেশ দিতে দিতে ভাঙ্গা রেকর্ডের মত চলে আমার নিত্য দিনের বকবকানি। ওর বয়স সুলভ চপলতায় সুযোগ পেলেই ছাদের রেলিংয়ে ঝুঁকে পড়ে কাপড় তোলার অজুহাতে, আচারের বৈয়াম রোদে দিতে গিয়ে পর্চের কিনারা বেয়ে হাটবার, অতি আগ্রহে সময়ে অসময়ে চেঁচিয়ে গান গেয়ে পাড়া মাথায় করাতে, টিভির সামনে বসলে ওঠবার গড়িমসিতে, স্বরবর্ণের চারটি অক্ষর চারশোবার পড়েও মনে রাখবার অপারগতায়, অজস্র বকুনি শোনে সারা দিনমান। ফলাফল অপরিবর্তনীয়।
অতএব, পুনরাবৃত্তি। চক্রবৃদ্ধিহারে নীরব বাড়ির সরবতা বাড়ে আরো। প্রতিটি দিন গড়ায় এমনি করে, একটু একটু করে রুখসানার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি ক্রমশ, টের পাই।
- খালাম্মা, এবার আমার বাবা এলে কিন্তু গেট খুলবেন না কলাম। এবার এসে আমারে নিয়ে যাবে শাসায়ে গেছে।
মনে মনে বলি, লোহার গেটের সাধ্য কি, রক্তের সম্পর্কে বাধা দেয়? মুখে বলি - -মার কাছে যাবি রুখসানা?
হঠাৎ এমন প্রসঙ্গে কথা বলা থামিয়ে অবাক চোখে তাকায়। আবার বলি
- যাবি, মার কাছে ?
- এখন না তো খালাম্মা। খালু বিদেশ থেকে এলে তারপর। আপনি যে একা থাকতি পরাবেন না।
- বোকা মেয়ে। অন্যের জন্য কেউ ভাবে না। নিজের জন্য ভাবতে শিখ - এটাই নিয়ম জগতের। আপন মনেই বলি।
মুখে বলি -
- সেই যে কবে তোকে মার কাছ থেকে তোর বাবা কেড়ে নিয়ে এসেছিল । তারপর তো মাকে দেখিসনি আর। এখন মাকে দেখলে চিনবি তো ? সজোরে মাথা দোলায় রুখসানা। উচ্ছল হাসিতে উদ্ভাসিত হয় সারামুখ -
- এই এত বড় একটা নোলকবালি পরে আমার মা। দেখলেই চেইনে নেব। তায়, এখন কিন্তু যাবে নানে খালাম্মা।
সন্দেহ আর ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে আমার চোখে চোখ রাখে রুখসানা। দৃষ্টি সরিয়ে নেই ওর দুচোখ থেকে। ছোট্টুনি এক অপরূপ সুন্দর মুখ এসে ভর করে দৃষ্টিতে। ও চোখের নির্মীলিত দৃষ্টি পড়তে চাই মন হাতড়ে, পারি না। বন্ধ দুটি চোখেও কি আর্তি ছিল আমার মেয়ের - মা যাব না যাব না। । জানি না কিছু জানি না। অসহায়ের সারিতে আমার পাশে রুখসানার মাকে আবিস্কার করি। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমার মত দুঃখী মানুষের দলে রুখসানার মার তো থাকবার কথা নয়। আমার ডাক না হয় সেই সুদূরে পৌঁছায় না। কিন্তু রুখসানার মার আর্তনাদ যে চারপাশে বাজছে। সেদিনের পর থেকে বাড়িটা পাল্টাতে থাকে তাড়াতাড়ি। আমার আর বকুনির সুযোগ হয় না। রুখসানা নিজে স্থির হয়ে আমাকেও স্থির করে দিয়েছে। চোখের পলকে ছাদ থেকে নেমে আসে কাপড় তুলে, আচারের বৈয়াম বেলা পড়বার আগেই তাকে সাজিয়ে রাখে, গান ভুলে ফাঁক পেলেই বর্ণমালার বই নিয়ে বসে চারটি অক্ষর মুখস্ত করে, পরবর্তী চারটিও শিখে ফেলে, মেঝেতে কিছু পড়তে না পড়তে মুছে তুলবার জন্য ব্যস্ত হয়। আমার অপছন্দের কোন কাজে আর আগ্রহ দেখায় না। সংকটাপন্ন আমি ছল করি। দু’দিনের জন্য বেড়াতে বলে ওর আত্মীয়টির হাতে তুলে দিই রুখসানার সমস্ত দেনা পাওনা মিটিয়ে। আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চলে যাই সেই স্বর্ণপুর। দক্ষিণের ব্যালকনি নয়, চালা তোলা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকা সেই মা, যে নাকে নোলকবালি দুলিয়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পরিশ্রম শেষে ঘরে ফেরে। স্পষ্ট দেখি আমার হাতের কারুকার্যময় কাঁকন জোড়া মিলিয়ে দুটো কাঁচের চুড়ি হয়ে যায়, কাঁঠালিচাপার আভা ছড়ানো পরনের শাড়িটা হয়ে যায় ধান ক্ষেতের মত সবুজ রঙা শাড়ি। আর ক’টি ঘন্টা পেরুলেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মায়ের বুকের মাঝখানটায় পৌঁছে যাবে রুখসানা। অকারনে ভিজে ওঠে চোখের পাতা। দৃষ্টি ঝাপসা হয়। আর সেই আবছায়ার মধ্যে পথের অনেক বাঁক আর দুরত্ব ঘুচিয়ে রুখসানার মায়ের কাছে পৌঁছানোর দৃশ্যটা দেখতে পাই, রুখসানার কণ্ঠ
ইথারে ইথারে ভেসে বেড়ায়-
--- মা আমি আসছি।
রুখসানার মায়ের হাহাকার করা বুকের ঘাটতি পূরণের উচ্ছ্বাসের জোয়ার আমার বুকের টের পাই।
গরম পানির ধারা গাল বেয়ে নামে, ঝাপসা দৃষ্টি পরিস্কার হয়, আর সেই পরিস্কার আলোয় দেখি আমি একা। শুধুই একা।
ফাহমিদা রিআ
মালিবাগ, ঢাকা
-
গল্প//উপন্যাস
-
20-02-2024
-
-