আবারও রক্তাক্তের পথে কি পার্বত্য চট্টগ্রাম? – নয়ন চক্রবর্ত্তী
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দরবান এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে উঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম, যার মোট আয়তন প্রায় ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল, যা আমাদের দেশের মূল ভূখন্ডের ১০ ভাগ!
প্রকৃতির সৃষ্টরূপ এই পার্বত্য অঞ্চলে ১২ টি ভিন্ন ভাষাভাষি পাহাড়ি আদিবাসীর জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাহাড়ি বাঙালি মিলিয়ে প্রায় ১৫ লক্ষের মতো লোকের বাস। সর্বশেষ একটা জরিপ মনে আছে, যদি ভুল না হয় তাহলো পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫৯ শতাংশ বাঙালি,ও ৫১ শতাংশ পাহড়ি সেখানের বাসিন্দা,বর্তমানে বাঙালির সংখ্যাটা ব্যাপক।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করে, ফলশ্রুতিততে ৫ হাজার ৪০০ একর জমি পানিতে তলিয়ে যায় যা চাষযোগ্য জমির ৪০ ভাগ। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে উদ্বাস্তু হয় ১ লাখের উপর পাহাড়ি, আর বাকিরা ভারতে পাড়ি জমায়, বলে রাখা দরকার যে, ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়। আর ১৯০০ সালে প্রবর্তিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়িরা ভেবেছিল তাদের রাজনৈতিক, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাবে। কিন্তু সংবিধানেও শুভঙ্করের ফাঁকিটা থেকেই যায়। এরপর শান্তিবাহিনীর উত্থান, তারা দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। হয়তো মনে আছে সবার, পাহাড়ে বিষবাষ্প কিভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল! জনসংখ্যার ভারসাম্য, শান্তিবাহিনী দমনের জন্য ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পাহাড়ে চার লক্ষ বাঙালিকে অভিবাসন দেয় তৎকালীন সরকার। শান্তিবাহিনীকে ঘায়েল করতে এবং পাহাড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন ঘটে। বাঙালি আগমন আর সামরিকায়নের প্রভাবে শুরু হয় সংঘর্ষ, লোভের অনলে পুড়তে থাকে বসতভিটা, কাউখালী, লংগদু, কলমপতি, নানিয়ারচর, বরকলে চলে গনহত্যা। এসব অনেকে শুনলে বলবে কল্পকাহিনী। গুগল সার্চ দিলেই ইতিহাস আপনার কাছে আসবে! ইতিহাস কারো সাথে বেইমানী করে না!
জীবন বাঁচাতে ৭০ হাজারের উপর পাহাড়ি অনেক বছরের জন্য শরণার্থী হয় ত্রিপুরায়। এরপর অনেক ঘটনা; বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে সাত পাঁচ হয়ে তীরে আসে শান্তি চুক্তির মাধ্যম! আওয়ামীলীগের আমলে, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অস্ত্র জমার দেওয়ার মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর গেরিলা গ্রুপটি রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধের অবসান করে সেনাবাহিনীর সাথে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভূমি সমস্যার সমাধানসহ পার্বত্য শান্তিচুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের প্রত্যেক সরকারই অনীহা দেখিয়েছে। হয়তো বলতে পারেন উন্নয়ন হয়েছে, উন্নয়ন ধারাবাহিক বিষয়, এটা হতে বাধ্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু জনপদ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনশিল্পে আয়বর্ধক।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত কি যদি জানতে চায়, উত্তর কেউ দিতে পারবে না, পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
যে কোন স্থাপনা করার নামেই উচ্ছেদ, নির্যাতন, জুলুমবাজি চলছে। বারবার যেকোন ইস্যুতে পাহাড়িদের আবাস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলছে, এসবের নিশ্চুপতার ফলাফল লংগদুর ঘটনা, যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হবে সেখানে সংঘর্ষ, রক্তপাত অনিবার্য। অবাক লাগে, যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ! শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা নিয়ে আওয়ামীলীগ বিএনপি পালা করে প্রতিশ্রুতির পসরা সাজায়, ভোট ব্যাংকের জন্য। ভোট শেষ শান্তিচুক্তি নামক বিষয়টা আবার কৃষ্ণবিবরে।
একসময় রাঙামাটির তবলছড়ি বাজারে দোকান ছিল ৫০টি, এখন হাজারটা। আর মালিক সব বাঙালি। ক্ষমতা বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ বঞ্চনার আরেক নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমার এক পাহাড়ি বন্ধু সরাসরিই বলে, আমাদের কারণেই তারা নাকি হারিয়ে যাচ্ছে, আর কয়দিন পর গহীন জঙ্গলে পাহাড়ের চূড়াগুলোতে তাদের বাস হবে। কি করবে এখানে নির্যাতনের মাত্রা ভয়ংকর।
আমরা কি রক্তাক্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম কি দেখতে যাচ্ছি? নাকি পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে মেশিনগানের শব্দে জর্জরিত হয়ে সংঘাতের পথে হাটছে? একটি গোষ্ঠি এসবি কামনা করে, আবার ও ভূমি দখল করে, মানুষ হত্যা করে লোভের অনল ছড়িয়ে দিতে তারা মরিয়া। কল্পনা চাকমার মতো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, পুড়িয়ে মারছে বারবার প্রকৃতির লালিত সন্তানদের। যিনি ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই আলোচিত তপন জ্যোতি চাকমা ডাক নাম বর্মা চলতি বছরের ৪ মে প্রতিপক্ষের ব্রাশ ফায়ারে অপর তিনজন সঙ্গী এবং তাকে বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকসহ নিহত হন। ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা নিহত হওযার পরদিনই জ্যোতি চাকমা বর্মা নিহত হন।
উল্লেখ্য যে শক্তিমান চাকমা এককালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। ছাত্রলীগ ছেড়ে তিনি যোগ দেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে। পরবর্তীতে মতবিরোধে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গড়ে তোলেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তিবিরোধী প্রসিতবিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের প্রভাব বেশি খাগড়াছড়িতে। ভাঙনের পর দুটি দলের মধ্যে সংঘাত লেগে আছে।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকা এখন সশস্ত্র চার গ্রুপের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ভূমি যার বেশি, চাঁদা তার বেশি এই আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে সশস্ত্র চার গ্রুপ। এটাই তাদের মূল দ্বন্দ্ব। অনেকটাই খুন করার নিরাপদ এলাকা যেন এখন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম।
শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত ২১ বছরে সশস্ত্র গ্রুপের দ্বন্দ্বে ৮ শতাধিক খুন হয় এবং ১৫শ’ গুম হয়েছে। আগে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও ভাগবণ্টন নিয়ে খুনখারাপি হলেও এখন আগামী নির্বাচনে কে কোন দলে যাবে তাই নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। তার চাইতে বড় কথা প্রতিশোধ, পাহাড়ে একটা রীতি চালু তাহলো লাশের বদলা ডাবল লাশ। এক গ্রুপ ব্রাশফায়ার করলো ৫ জন মারলো অপর গ্রুপ ১০ জন মারবে যেভাবেই হোক। পাহাড়ের জনপদে এখন অস্ত্রের ঝনঝনানি। কোথায় কখন কার লাশ পড়ে সেই আতংক সবার মনে পাহাড় যে বারবার অশান্ত হয় তা এসবের ধারাবাহিকতায়। একটি খুনের রেশ না কাটতেই হচ্ছে আরেক খুন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) নেতা শক্তিমান চাকমাকে হত্যা এবং পরদিন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে রাঙামাটিতে একটি মাইক্রোবাসে গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করেছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দলসহ নানা কারণে খুন-খারাপিতে জড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের সশস্ত্র আঞ্চলিক চার সংগঠন। এসব ঘটনায় যেমন খুন হচ্ছেন রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধি, আবার এসব ঘটনায় সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ছে তাদের ওপরেই।
পাহাড়ে রক্তের দাগ শুকায় না, পাহাড় রক্ত ছাড়া কথা বলে না। পাহাড় যেমন সুন্দর তেমনি পাহাড়ের মানুষ ও সুন্দর। কিন্তু এখন পাহাড় ভয়ংকর, যে ভয়ংকররূপী ছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তি আগে ঠিক তেমনি। পাহাড়ে এখন ব্রাশ ফায়ার ছাড়া বিচার নেই, লাশের বদলা লাশ, ভ্রাতৃঘাতী হয়েছে সংগঠন গুলো। যা সর্বশেষ ৭ জন নিহত স্বনির্ভর এলাকায়। এই রক্ত এখন প্রতিশোধে মরিয়া, যা সংগঠন গুলো পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে যেন মিটাতে চাইছে। যা থেকে সুযোগ নিচ্ছে সেই দেশ বিধ্বংসী নিষিদ্ধ সংগঠন গুলো। এখনি প্রশাসনের উচিত এসব থামানো। পাহাড়িরা পাহাড়িদের বর্তমান শত্রু। ঠিক এরকম প্রতিদ্বন্দ্বীই বানাতে চেয়েছিল একটি পক্ষ। যা সুবিধা ভোগ করবে সুবিধাভোগীরা।
এসময়ে দরকার শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন তাহলে সংঘাত কমবে।আস্থা বাড়বে সরকারের উপর।আর যদি সরকারের উদাসীনতা আর প্রতিশ্রুতির ডালপালা ছড়ায় তাহলে পাহাড়ে সংঘাত নিশ্চিত। নাহয় আবার গেরিলা কার্যক্রম শুরু করবে উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো, তাদের অপ্রাপ্তির বেদনা থেকে জন্ম নিবে সন্ত্রাস। রক্তাক্ত হবে সবুজ পাহাড়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো দেশটা পাহাড়ের কান্না আর বন্দুকের নল দ্বারা পরিচত হোক এটা কোন শুভবুদ্ধির মানুষ শেষ পর্যন্ত কামনা করে না।
এই বাংলাদেশে পাহাড়ি বাঙালি সবাই এক, দেশ আমাদের বাংলাদেশ।
নয়ন চক্রবর্ত্তী, সংবাদকর্মী
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
23-08-2018
-
-