অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
দুটি কবিতা - ফজলুল হক সৈকত

১)  নীল নীল রঙে

রাজ্যের পিপাসা নিয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকালে যখন
চোখগুলোর বল নড়ছিল বসন্তের বাতাসে দুলতে-থাকা
নুয়েপড়া পাতার মতো;
কবিতা থেকে শব্দগুলো যখন খুলে খুলে পড়ছিল তোমার
কালো কোটের ভেতরে - তুমি খুব বিষণ্ন ছিলে কি?
মনে নেই।  

তোমার ফিরে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তটা ছিল সবচেয়ে
বেদনার; তোমার বসে থাকার ঢঙে আর নীল নীল রঙে
মেখে গিয়েছিল সমস্ত হৃদয়।

তুমি মুছে-যাওয়া লিপস্টিকে আঁকছিলে আমার ফুটো হয়ে
যাওয়া মন; বলছিলে - এতো লোকে কেন যে আমার সাথে
দেখা করতে চায়, বুঝি না!’

তোমার রোদলাগা গালের পিপাসায় কিংবা জানালায় প্রথম
কবিতার দ্বিতীয় পঙক্তি অবধি তুমি ছিলে অন্য একজন-
তারপর...

২)  মাঠ পেরোলেই আমাদের বাড়ি

মাঠ পেরোলেই আমাদের বাড়ি...
মাঠ পেরোলেই নদী।

মাঠের মধ্যে মরিচ ক্ষেত, বাঁশবাগান, লিক ধরে চলতে থাকা গরুর গাড়ি।

মাঠের মধ্যে মিজানের মা, বড় জ্যাঠা; মাঠের মধ্যে আউলা চুলের রমনা ফুপুর ময়লামাখা উদোম শরীর।

নদীর ধারে কদম গাছের সবুজ পাতা, চোঙায় জমা কানচ মাছ, নদীর বুকে সাঁতরে ভাসা করিম কাকা।
নদীর পাড়ে বাতাম ক্ষেতে আমির তাঁতি, রুহুল আমিন,
লাটাই হাতে লুঙ্গি কাঁধে মালেক কাকা।

মাঠ পেরোলেই দাদির বাড়ি- ছোট দাদি
বিপ্লবীদের প্রিয় ছিলেন আমিন চাচা, পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকা
তরুণীদের রুপোলি গাল; মাঠ পেরোলেই সন্ধ্যাবেলা মেঘমাখানো চুলের মিষ্টি গন্ধ নেওয়া নিবিড় সময়।

বাড়ির মধ্যে চুলার পাড়ে করিমজান- পাগলি মেয়ে, উঠান জুড়ে খড়-বিছালি, কলের পাড়ে
লাভলি আপা, খড়ির ঘরে... কী জানি হয়!

বাড়ির মধ্যে - ঘরের মধ্যে দাদির কণ্ঠ, দাদার কাশি, মাঝবয়েসী নারীর গন্ধ, তেলের শিশি,
পানের বাটা, তাকের ওপর মায়ের করা বয়মভরা বড়ই আচার, চৌকির নিচে লুকোচুরি;
নাসিমা তো ছোট্ট খুকি।

বাড়ির মধ্যে মুক্তার হাতের আমের ফালি, সন্ধ্যা হলে রাবেয়া বুর আলসেমি আর হাতের পাখায়
বাতাস খাওয়াÑ ঘরের মধ্যে, মটকির পাশে সাপের ভয়ে গায়ে কাটা।

ভোরের মাঠে লাঙল হাতে সুনীল-সুশীল, পাশের পাড়ায় যূথী পিসি, মিনতি আর মালতিরা
আলতা মেখে খেলে বেড়ায়, মাদ্রাসাতে ক্বারিসাবের মধুর কণ্ঠ, লিচুতলায় একলা দাঁড়ায় কমলা
খালা- কপালে তার কালো টিপ; ইউসুফেরা গ্রাম ছেড়ে যায়, মাঠের মধ্যে পড়ে থাকে ওদের জমি।

নিবিড় রাতে আকাশ জুড়ে তারার খেলা, রাত পোহালে খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে আসা হাঁসের মিছিল।

মাঠ পেরোলেই স্বপ্নগুলো, নদীর ধারে হারিয়ে ফেলা এক জীবনের গল্পগুলো।

ফজলুল হক সৈকত
ঢাকা, বাংলাদেশ