অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
উন-মানুষের দেশে রাজনীতির মহান পুরুষ - মিঠুন চৌধুরী

শ্রদ্ধাঞ্জলি

বাংলাদেশের রাজনীতির নিলোর্ভ, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক ও দার্শনিক মহান পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রয়াত হয়েছেন। সংগ্রামমুখর এক জীবনের প্রতিটি লড়াইয়ে বিজয়ী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরে স্বজন হারানো এবং তৎ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে যে কয়জন মানুষ নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতেই ছিলেন তিনি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশের জনগণের সেবায় নিয়োজিত এক নিভৃতচারী নেতা। যিনি কাজ করেছেন নিরবে। এমন রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি নিজ ঘরে। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে। নিজের পিতার জীবনাচরণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এই ধারার রাজনীতিতে। মূলত শৈশব থেকে রাজনীতির চর্চা তাঁকে একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদে পরিণত করে।

মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একজন ছাত্র হয়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এবং অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে সেই বিক্ষুব্ধ সময়কে। তখন ৬৯ সাল। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের শিক্ষাজীবনকে বিপদে ফেলে তিনি দেশ মাতৃকার টানে রাজনীতি করে গেছেন নির্মোহভাবে। ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধের ডাক এলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই সৈয়দ আশরাফ সাড়া দিলেন দেশ মাতৃকার ডাকে। একজন রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়ে লড়লেন সম্মুখ সম্বরে। যোগ দিলেন মুজিব বাহিনীতে।

মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় হারালেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর অল্প সময়ের মধ্যেই হলেন পিতৃহারা। রাজনীতির মাঠ এবং পরিবার দুই ক্ষেত্রেই অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়লেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। চরম এক বিরুদ্ধ সময়ে হাল ধরলেন পরিবারের। পাড়ি জমালেন যুক্তরাজ্যে। কিন্তু রাজনীতির হালও ধরলেন অন্য হাতে। প্রবাস জীবনে পরিবারকে দাঁড় করাতে যেমন উদয়াস্ত করেছেন ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়েছেন। সেখানে যুবলীগকে সংগঠিত করেছেন। জাতির জনকের হত্যার বিচার দাবিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্বারে দ্বারে গেছেন। যুক্ত হয়েছেন ব্রিটেনের লেবার পার্টির রাজনীতিতে।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন জ্ঞানী, সজ্জন ও বিশ্বমানের রাজনীতিবিদে পরিণত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। যুক্তরাজ্যের মত দেশে লেবার পার্টির রাজনীতিতে তিনি হয়ত সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করতে পারতেন। পেতেন একটি আপাত সুখী জীবন। কিন্তু দেশের ডাক যতবার এসেছে ততবার তিনি সাড়া না দিয়ে পারেননি। এই হলো সৈয়দ আশরাফের বিশেষত্ব। আবারও বঙ্গবন্ধু কন্যার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশে ফিরেছেন। নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনার সঙ্গী হয়েছেন।

‘দু:খে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দু:খ কিসের’- এই যেন ছিল তাঁর জীবনের মূল সুর। যতবার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে ততবার তিনি ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন বীরের বেশে। যখন দেশে এক এগারের বিভিষীকা নেমে এল তখনও তিনি দু:খ জয়ী বীর। হাল ধরলেন দলের। দেখালেন তিমির বিদারী পথ। শুধু দলকে নয় দেশকে পৌঁছে দিলেন এক নিরাপদ বন্দরে। রাজনীতি সচেতন সকলেই জানেন কী বিপদ সংকুল চক্রান্তের পথ পেরিয়ে দেশকে তখন ফিরতে হয়েছিল গণতন্ত্রের পথে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন সেই যাত্রাপথের অন্যতম প্রধান কান্ডারি।

রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী যোদ্ধা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে প্রতিপক্ষ শিবিরের যোদ্ধারাও ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। কারণ তিনি মেনে চলতেন গণতন্ত্রের আদি ও অকৃত্রিম পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের নীতি এবং বিশ্বাস করতেন দেশের মালিক জনগণ। রাজনীতির যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো যুদ্ধই তাকে পরাজিত দূরের কথা ক্লান্তও করতে পারেনি । তাই নিকৃষ্ঠ শত্রুরা চেয়েছিল কুৎসা রটিয়ে মিথ্যের মিথ তৈরি করতে। সেখানেও ব্যর্থ চক্রান্তকারীরা। এখানেই মহান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে রচিত মিথ্যের বেসাতি বাংলাদেশের মানুষের মনের অন্দরে জায়গা পায়নি। মানুষ তাদের নেতাকে চিনত, জানত এবং ভালোবাসতো।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী একটি বিশাল দলকে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালনা করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। ছিলেন একাধিকবারের সফল মন্ত্রী। সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জাগতিক হিসেবে দেনার তালিকা লম্বা হয়েছে তাঁর। তবে মানুষের হৃদয়ে তাঁর নামের বিপরীতে অর্জনের তালিকা যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে তারই প্রমাণ নেতার প্রয়াণে সাধারণের আবেগের বহি:প্রকাশ। হয়ত আরো অনেক কিছু পাবার ছিল। কিন্তু কিছু মানুষের জন্ম হয় দেবার জন্য। যারা দিতে আসেন তারা প্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকেন না। তিনি তাদেরই একজন। দিয়েছেন দেশকে, দেশের মানুষকে এবং তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতি এক মহান পুরুষ। চরম অবক্ষয় আর স্খলন এর এই সময়ে তিনি শুধু উজ্জ্বল ব্যতিক্রমই নন তিনি সততার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। তাঁকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা চার দশক পরে আবারো ভাই হারা হলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারালো তাদের আর্দশিক নেতাকে। আর বাংলাদেশ হারালো গণতন্ত্রের রাজপুত্রকে। জনগণের হৃদয়ের রাজপ্রসাদে সৈয়দ আশরাফ রাজার আসনে আসীন। সে আসনে ভালোবাসার হীরক খচিত মুকুটটা চিরটাকাল পড়েই থাকবে তাঁর অপেক্ষায়।

মিঠুন চৌধুরী, সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ।