অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
আমার জন্মভূমি দাগেস্তান: একটি পুস্তক পর্যালোচনা

এস এম তৌহিদুল ইসলাম

“এইতো সেদিন হেসে খেলে সারা বেলা
পাখিদের বাসা লুট করে বেড়িয়েছি,
প্রেমে এসে সেই আচমকা ছুঁয়ে দিলো
চেয়ে দেখি, একি, সাবালক হয়ে গেছি।

এইতো সেদিন বড় হয়ে গেছি ভেবে
হাজির হয়েছি বয়ষ্কদের ভীড়ে,
প্রেম এসে হেসে, চোখে চোখ রাখতেই
নিমেষে গেলাম বালক বয়সে ফিরে।”
- রসুল গামজাতভ

রসুল গামজাতভ দাগেস্তানের অত্যন্ত জনপ্রিয় কিংবদন্তিতুল্য জনকবি। তিনি একজন আভার ভাষার কবি। দাগেস্তানের পার্বত্য এলাকায় অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাস। লাক, টাট্, আভার প্রভৃতি ভাষায় ওখানকার উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো কথা বলে থাকে। বৃহৎ ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর তুলনায় আভার ভাষা ভাষীরা নিতান্তই সংখ্যালঘু। মাত্র লাখ দুয়েকের মত লোক এ ভাষায় কথা বলে থাকে। কিন্তু এদের শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত কাব্য অত্যন্ত উঁচুমানের। “আমার জন্মভূমি দাগেস্তান” এ বইটি না পড়লে এ সংখ্যালঘু জাতিটির অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় শিল্প সাহিত্যের খোঁজ পেতাম না। রসুল গামজাতভ মূলত একজন কবি। “আমার জন্মভূমি দাগেস্তান” তাঁর প্রথম গদ্যের বই। বইটি আমাকে এতই বিমোহিত করেছে যে, এটি সম্বন্ধে কিছু বলার লোভ সংবরন করতে পারছিনা। আলোচনা শুরু করার আগে আলোচনাটিকে তিনভাগে ভাগ করতে চাই।

 ক. লেখক সম্বন্ধে
 খ. বইটি সম্বন্ধে
 গ. অনুবাদক সম্বন্ধে

ক. লেখক সম্বন্ধে- দাগেস্তান সোভিয়েত রাশিয়ার একটি ছোট্ট পার্বত্য প্রদেশ। লেখক (আসলে কবি) এ পাথুরে পরিবেশে বড় হওয়া একজন মানুষ। তার পিতাও আভার ভাষার একজন বড় কবি ছিলেন। আভার ভাষা কবিকে পানি, বায়ু, স্তন্য, মাটি দিয়ে বড় করলেও কবি বরাবরই রুশ ভাষার নিকট ঋণী। অন্যান্য লেখকেরা যেখানে লেখার অনুবাদ নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন, সেখানে লেখক রসুল তার কবিতার রুশ অনুবাদ নিয়ে বরাবরই উচ্ছ্বসিত। কবির ভাষায় আভার আমাকে জন্ম দিয়েছে বটে, কিন্তু লালন করেছে রুশ ভাষা। রুশ ভাষা না হলে এ রসুল গামজাতভ কারো কাছে পৌঁছতেই পারতনা। বাকিটা বইটির ভূমিকা পড়ে জেনে নেবেন।

খ. বইটি সম্বন্ধে- এখানেই এটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। লিখতে বসে প্রায়ই ভাবছি-বইটিকে কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়। এটি কি দেশপ্রেমের বই, জন্মভূমির প্রতি বিরহ গাঁথা, আভার ভাষার প্রতি প্রেম, শিল্প সাহিত্য সমালোচনা, আত্মজীবনী,নাকি কবিতার বই? লেখক এখানে তার জাতির পার্বত্য জীবন যাপন, সংস্কৃতি, লোকগাঁথা, প্রবাদ প্রবচনগুলো অত্যন্ত মুন্সীয়ানার সাথে আত্মজীবনীতে গেঁথেছেন। আত্মজীবনীগুলো সাধারণ দেখা যায় লেখকের ছোটবেলার ঘটনাগুলো সরলভাবে লেখা। কিন্তু লেখক এখানে আভার ভাষীদের কাব্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য ভাবনাগুলোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মনে হয়।

লেখকের যেগুণটি আমাকে এ সাহিত্য সমালোচনা লিখতে উৎসাহিত করেছে তাহলো উপমার প্রয়োগ। প্রকৃতপক্ষে কবিতার প্রতিটি শিল্পগুণ সম্পর্কে লেখক সুন্দর সুন্দর যে উপমার আশ্রয় নিয়েছেন, তা সহজেই যে কাউকে ‍মুগ্ধ করবেই। উপমাগুলোর প্রত্যেকটি পাহাড়ি জীবন থেকে সংগ্রহ করা, একদম সরল সাধারণ উপকরণ। কিন্তু কেউ এটাকে এভাবে ব্যবহার করেনি।

কবিতাকে কবি যেভাবে দেখতে চান না- “আমি কোন তরমুজের শুধু চেহারা দেখে পছন্দ করেছি; অথচ পরে ভিতরে দেখেছি বিবর্ণ ও স্বাদহীন। তখন আমাকে প্রায়ই মাথা চুলকাতে হয়েছে।”
 “তাছাড়া দু’টো পুতুলের বিয়ে দিলে তা দিয়ে সন্তান উৎপাদন হয়না।”

আভার ভাষার প্রবাদ-প্রবচন, লোকগাঁথা, ভাষা প্রেম, কাব্যচর্চা প্রভৃতি নিয়েও একটি সংকলন প্রকাশ করা যায়। লেখক সময় পেলে সে ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। আভার ভাষার সমৃদ্ধ অংশ হচ্ছে এর অভিশাপগুলোর সংকলন। একটি ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠীর অভিশাপ দেওয়াটাও কতটা শৈল্পিক হতে পারে তা দু’একটা উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে।
 “আল্লাহ যেন তোর সন্তানদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করেন।”
 “তোর জিভ শুকিয়ে যাক, যে স্ত্রীলোককে তু্ই ভালবাসিস, তার নাম যেন ভুলে যাস।”

কী ভীষণ অথচ শৈল্পিক অভিশাপ! যে পাহাড়িয়া অপকৃষ্ট ভাষায় কবিতা লেখে, তার মা কখনো তা পড়েনা। রুশ ভাষার ন্যায় একটা দানব দ্বারা আভার ভাষা পরিবেষ্টিত থাকলেও তা এখনো হারিয়ে যায়নি। আসলে হারিয়ে যেতে দেয়নি তারা সচেতনে।

গ. অনুবাদক সম্বন্ধে- বইটি আভার ভাষা থেকে রুশ ভাষা হয়ে ইংরেজী অনুবাদ হয়ে বাংলা ভাষায় গড়া হয়েছে। এত গড়া পেঠার মধ্যে লেখকের মূল বই থেকে অনুবাদ কার্য অনেক দূরে সরে যাওয়াই স্বাভাবিক। অনুবাদের মূল সমস্যা হলো মূল ভাষায় লেখকের সুক্ষ্ম আবেগ অনভূতিগুলো অনুবাদক নাও ধরতে পারেন। আসলে সত্যিকারের লেখককে অন্য ভাষায় পড়া যায়না।

কিন্তু এই বইয়ের অনুবাদকদ্বয় অত্যন্ত ভাল কাজ করেছেন। এজন্য আমি ঠিক নিশ্চিত না- রসুল গামজাতভ আসলেই এত ভাল লিখেছেন, নাকি পুরোটাই আমাদের অনুবাদকদ্বয়ের সাহিত্য প্রতিভা। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনুবাদ বই পড়তে গেলে সেটা সুখপাঠ্য হয়না, গদ্যের রস, রুপ অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু এ বইটি আমাকে আগাগোড়াই মন্ত্রমুগ্ধের মত আটকে রেখেছে।

মূল বইয়ের অনুবাদক-আকবর উদ্দীন, কবিতাংশের অনুবাদক-কবি আবুল হোসেন।
 প্রকাশক-জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।

আভার ভাষার শ্রেষ্ঠ এই বইটি আজ আমাদেরও সম্পদ। অনুবাদকদ্বয়ের শ্রেষ্ঠ কাজের একটি অংশ বলে আমি মনে করি। এভাবে বিশ্বসাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের সংযোগ ঘটিয়ে দেবার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।

এস এম তৌহিদুল ইসলাম
লেখক: প্রকৌশলী
বাংলাদেশ।