আমার কিশোরীবেলার পাঠশালা (৩) –গুলজাহান রুমী
আমার কিশোরীবেলার পাঠশালা (১) পড়তে ক্লিক করুন
আমার কিশোরীবেলার পাঠশালা (২) পড়তে ক্লিক করুন
( তিন )
পুতুল খেলার আসর ভেঙ্গে গেল লোনার জন্য। একাএকা পুতুল খেলতে মজা নেই। কার ছেলে পুতুলের সাথে বা মেয়ে পুতুলের সাথে ঘটা করে বিয়ে দেব? বেয়াইনের সাথে মেয়ে পুতলের অযত্ন হচ্ছে শশুরালয়ে এই মিছে অভিযোগে ঝগড়া নাকরলে পুতুলবিয়ে খেলার কোনো আমোদ থাকেনা।।আমি পথপানে চেয়ে থাকি লোনা আসবে বলে। কিন্তু দিনেদিনে লোনা ও আমার মধ্যে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে যা আমি বা লোনা বুঝতে পারিনি বা বুঝতে পারার বয়েস আমাদের হয়নি। বিচ্ছেদের সেই প্রাচীর ভেঙে আমরা পুতুল খেলার আসর বসাব সে রকম ভাবনাও আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। আমার আব্বার পেশাগত জটিলতা লেগেই থাকত সব সময়। আব্বা আপোষ করবেননা কিছুতেই। বিবেকে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করবেন এরকম কথা আব্বা যেন ভাবতে পারতেনওনা। এজন্য সব সময় চ্যালেঞ্জ লেগেই থাকত। দুষ্টের দমন করতে গিয়ে নিজেকে অদৃশ্য শক্তির তোপের মুখে পড়তে হত আব্বাকে। সেই উত্তাপ আমাদের গায় এসে লাগে। আমাদের মনের শান্তিতে বাগড়া দেয়। সেই ছোটকালেও এসব ঠিক বুঝতে পারতাম। এখনও যেন আবছা আবছা দেখতে পাই আমাদের বাসায় হঠাত স্তব্ধতা নেমে এসেছে। সবাই খুব নিরব। নেহায়েত খুব জরুরী নাহলে কেউ কারও সাথে কথা বলছেনা। আপারা হাস্যজ্জল থাকলে আমি পিচ্ছিও খুব আমোদে থাকতাম। মনে হত আলোয় আলোয় ভুবন ভরা। মনে পড়ে একদিন সব আলো কালনি এসে গ্রাস করে নিল। মোজাগড় গ্রামে খুন হয়ে গেলেন একজন চেয়ারম্যান। তিনি আমার মেঝ দুলাভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। কি একটা উৎসবে এই চেয়ারম্যানের বাড়ীতে আমিও মেঝআপা ও দুলাভাইয়ের সাথে গিয়েছিলাম একদিন। ছিমছাম ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। অমায়িক হাসি লেগে থাকত চেহারায়। এরকম একজন মানুষ খুন হয়ে গেলেন। আব্বা মফস্বলে ছিলেন, এসেই দৌড়ঝাপ তত্ত্বতলাস শুরু করে দিলেন। কেন আসামি ধরা হয়নি এনিয়ে নানা কান্ড ঘটে যাচ্ছে। ওসি চাচার সাথে সুখকর আচরণ করছেননা আব্বা। সারা মুরাদনগরের মুখ বিষন্ন। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারেনা। প্রশাসনের বিশেষ মহলের নেক নজরে খুনীরা নিরাপদে থাকে। মুরাদ নগরের মানুষের বিষন্নতা আব্বাকেও গ্রাস করে। আব্বার অনেক ক্ষমতা দেখেছি কিন্তু অক্ষমতাও দেখেছি। আব্বা কিছু করতে পারছেননা সেই অন্তর্গত উচাটন আমরা দেখতে পাই। শোনা যাচ্ছে আব্বা যেন আর মুরাদনগরে থাকতে নাপারেন সে জন্যে জোর তদবির সম্পন্ন হয়ে গেছে। নানা অশুভ কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আব্বা এসব কথা আম্মাকেও বলতেননা কখনো। কিন্তু আরদালি কাকা ও ঝি-বেয়ারাদের সংবাদ আদানপ্রদানে আম্মা সত্যের কাছাকাছি অনেক কথাই জেনে নেবার কায়দা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। আম্মা আইন জারি করে দিলেন পাড়া বেড়ানো আর চলবেনা। ওসি চাচার বাসায়ও যাওয়া যাবেনা, সেখানের কেউ আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতে পারবেনা। আম্মার এই আইন বাতাস যেন ঢোল পিটিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের অস্তিত্বের উপর দিয়ে। লোনারা পাঁচ বোন। আমরাও পাঁচ বোন। লোনা ছিল সবার ছোট, আমিও আমার বোনদের মধ্যে সবার ছোট ছিলাম। লোনার আপারাও আমাদের বাসায় আসতেন। আমার আপাদের সাথে তাদের অনেক ভাব হয়ে যায় কিছুদিনেই। মেয়েদের জন্য স্কুল-কলেজে যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যখনতখন মন চাইলেই চলে যাওয়ার উপায় ছিলনা। ছেলেরা যেতে মানা নেই। খেলার মাঠে, ক্লাবে, ইতিউতি আড্ডা দিতে যেথা মন চায় যাও। কিন্তু আমরা মেয়েদের জন্য পৃথিবীটা অদৃশ্য এক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাসার চৌকাঠ পেরুনো যাবেনা। তাই থানা সীমানার বসতিগুলো ছিল আমাদের তেপান্তর। লোনাদের বাসায় সব বোনেরা মিলে কিচিরমিচির লেগেই থাকে। লোনা আর ওর বোনেরা আমাদের বাসায় এলে আমরাও পাখপাখালি হয়ে যাই। শীতের ক্ষীণকায়া শুকনো নদীর মত তিরতিরে মেয়েবেলায় বাণ ডাকে আমাদের সখিবিহারে। আমোদে আনন্দে আমরা হৈচৈ শুরু করে দেই। কিন্তু সব লন্ডভন্ড করে গেল। আমার আর লোনার পুতুল বিয়ের ধুম লেগেই থকত। কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে আমাদের পুতুল খেলার আনন্দটাকে তেপান্তরের ওপারে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
আমার বড় আপার বিয়ে হয়ে যায় আমি যখন বছর দেড়েক। কিছুই মনে থাকার কথা নয়। আব্বার চাকুরীর সুবাদে আমরা তখন চাঁদপুরে। বিয়েটা সেখানেই হয়। কিন্তু মেঝ আপার বিয়েটা আবছা মনে আছে। মুরাদকে কোনো রকমে টেনে কুলে নিয়ে হাটতে পারি এরকম সময়ে মেঝ আপার বিয়ে। মুরাদ নগরেই বাহারী কাগজ কেটে মাঠে শামিয়ানা সাজানোর দৃশ্যটার আনন্দ যেন আমার অস্তিত্বে এখনও টের পাই। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে ঘোর আধারে বাঁশের আগায় পটকা বেঁধে বিয়ে উৎসবের মুরাদনগরকে কাঁপিয়ে তোলার আনন্দে মেতে গেলেন পাতানো ভাইবেরাদররা। নেতৃত্বে অবশ্য আছেন আমার চাচাত ভাই। আমাদের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করতেন তিনি। আর আছেন এমপি চাচার ছেলে রুহুল আমীন ভাই। তিনি ভাইয়ার পরম বন্ধু, সারা দিনমান একই সাথে থাকতেন তাঁরা। রুহুল আমীন ভাইরা ছিলেন ১০জন ভাইবোন, ২বোন আর ৮ভাই। ডাক্তার ওলিউল্লাহ এমপি চাচার বিশাল সংসার। তাঁরা সবাই আমাদের খুব আপন জনের মত ছিলেন। আর আব্দুস সোবহান স্যারের গোটা পরিবারের ছেলেরা মিলে বাজি পোড়ানোর উৎসব করতে মেতে উঠেন। আমি ছোটভাই মুরাদকে নিয়ে যন্ত্রণায় পড়ে যাই। সে দৌড়ে চলে যেতে চায় বাজি পোড়ানোর মাঠে। আমার মনে হয় সে পোড়ে যাবে বাজির আগুনে। আপাদের উপর রাগ হয়, তারা কেন মুরাদকে সামলাচ্ছেননা। আমার বারণ সে মানছেনা, গড়াগড়ি দিয়ে হলেও বাজি পোড়ানোতে সে যাবেই।
সোবহান স্যারও আব্বার খুব কাছের লোক ছিলেন। মনে পড়ে আরু ভূঁইয়া ও তারু ভূঁইয়া কাকারা এসেছিলেন কোম্পানীগঞ্জ থেকে। আব্বার সাথে এই চাচাদের খুব অন্তরঙ্গতা ছিল। আমরা যখন মুরাদনগরের পাঠ শেষ করে মৌলভীবাজার আমাদের পৈত্রিক শহরে চলে আসলাম তখন তারা আমাদের মৌলভীবাজার পৌঁছে দিয়ে গেছেন একথাটা খুব মনে পড়ে। কীকরে যে এই দূরদেশের মানুষরা আমাদের এত আপন হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁরা মুরাদনগরে আমাদের জন্য বাসাবাড়ির জমিজমাও ঠিকঠাক করে ফেলেন। তাঁদের সাথে মুরাদনগরের বহু লোকজন চাইছিলেন আমরা যেন সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাই। আব্বা এক সময়ে নিমরাজী হয়ে পড়েন। আব্বার এই একখান স্বভাব ছিল। শুনেছি সেই ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ে তিনি যখন আসাম পুলিশে জয়েন করেন সেইকালে দেশভাগের পরেও আসামে আব্বা থেকে যেতে চেয়েছিলেন। আমার দাদা ডাক্তার তুরাব আলী নিজে আসাম গিয়ে আব্বাকে ধরে নিয়ে আসেন। দাদাও একসময়ে আসামে সিভিল সার্জন হিসেবে সারা জীবন কাটিয়েছেন। আব্বা যখন সেখানে জয়েন করেন দাদা সবেমাত্র রিটায়ার্ড করেছেন। আসাম যাওয়া সহজ ছিলনা সেকালে। এজন্য দাদা মাদি হাতী পোষেছিলেন। ‘আদরনী’ নাম রেখেছিলেন আমার দাদী হাতীটার। আদরনীর গল্প শুনে খুব ইচ্ছে হত হাতীর পিঠে চড়ে বেড়াতে যাই। মন খারাপ হত আমাদের কেন এখন হাতী নাই এই ভেবে। দাদা সবে আদরের ভাতুষ্পুত্রীকে বিয়ে দিয়েছেন আব্বার সাথে। কত গিরিখাত পেরিয়ে রুপকথার অলিক রাজ্যের মত আসাম যাবার গল্প কতবার আম্মাকে সেধে শুনেছি। কিকরে বিয়ের পর আম্মা আসাম গেলেন সেই গল্প। যখন ইচ্ছে তখনই শুনতে চাইতাম। মেজাজ ভাল থাকলে আসাম যাত্রার একই গল্প আম্মা বলতেন। প্রতিবারই নতুন মনে হত। আম্মা অবশ্য নববধু হয়ে আসাম যাবার গল্পটি বলতে ভালবাসতেন। আসামেই আব্বা আর আম্মা নবদম্পতি জীবনের প্রথম সংসার পাতলেন। আব্বার পায়ের তলায় যেন বৃক্ষের শিকড়, যেখানেই যান সেই মাটিতেই গজিয়ে যায়। একইভাবে মুরাদনগরে যখন থেকে যাবার সুমতি আব্বার হলো দাদা খবরটা জেনেই লাঠিসোটা হাঁকিয়ে মুরাদনগরে গিয়ে দিব্যি হাজির হয়ে গেলেন। - চলবে
গুলজাহান রুমী
অটোয়া, কানাডা।
-
গাল-গল্প//সাক্ষাৎকার
-
06-02-2019
-
-