অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
আমার শৈশব স্মৃতি : বইপড়া ও সংরক্ষণের উপযোগিতা - আয়েশা সুলতানা

স্মৃতির দুয়ারে আজকাল মাঝে মধ্যে হানা দেয় সোনালী অতীত। জীবনের প্রায় সায়াহ্নে  এসে প্রায়ই মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলির কথা। নয় বোন আর তিন ভাইয়ের এক বিরাট পরিবারে আমার বেড়ে উঠা। ছোটবেলায় খুব অনাড়ম্বর আর অতি অল্পতেই খুশি হবার মানসিকতার জীবনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আমার বাবার নাম জনাব অমিনুল্লাহ আর মা হলেন বেগম সেতারা আখতার খাতুন। কর্মসূত্রে বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ও অঞ্চলে আমাদের থাকতে হয়েছে। 

আমার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বিসিএস প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বাংলাদেশের সীমারেখা তখন দুই বাংলায় বিস্তৃত ছিল ও সেই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে তার বদলীর সুবাদে আমাদের ভাই বোনদের জন্মস্থান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হয়েছিল। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রাণাঘাট আমার জন্মস্থান হলেও সে স্থানের তেমন স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় তেমন ঠাঁই পায়নি; তাঁর মূল কারণ, আমার শৈশবেই বাবার পূর্ববঙ্গে বদলী হওয়া। এর অল্প কিছুকাল পর দেশ বিভাগের ফলে আমাদের শৈশবে আর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া হয়ে উঠেনি।এর পর যা কিছু বাসস্থান বদল সব ঘটেছে পূর্ববঙ্গের বা বর্তমানে বাংলাদেশের সীমার মাঝেই।

কিন্তু সীমার মাঝে থেকেও যে অসীমের সাথে মিশে থাকা যায়, সে শিক্ষাটুকু আমরা অহরহই পেতাম আমাদের মায়ের ও বাবার নিরন্তর বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্য চর্চার সাথে নিবিড় সংশ্লিষ্টতার কারণেই। বাবার কাছ থেকেই  আমাদের বাংলা বর্ণশিক্ষার হাতেখড়ি। বাবার শিশুদের শিক্ষা দেওযার একটি নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। বাংলা বর্ণমালা শিক্ষণ পদ্ধতিতে তিনি আমাদের কোনদিন 'তালব্য', 'মূর্ধন্য'; 'দন্ত্য; --এসব নিয়ে শিশুর কচি মনটাকে ভারাক্রান্ত করেন নাই। 'র' আর ‘ড়' এর মাঝে সুস্পষ্ট যে উচ্চারণগত পার্থক্য আছে সেটি তিনি অতি সহজে ধরিয়ে দিতেন। আমি  ছোট বেলায় একবার মাত্র ছড়ার বইগুলো কেউ পড়ে দিলে পরবর্তী কালে ছবি গুলো দেখলেই হুবহু গড় গড় করে বলে যেতে পারতাম। আমার নিজের ক্ষেত্রে মনে হয় 'অক্ষর' চেনার আগেই 'শব্দ' গুলো চেনা হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে কথা সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসিখুশী' প্রথমভাগ তো মনে হয় মাতৃগর্ভ থেকে নির্গত হওয়ার পরই আমাদের খেলার সাথী ছিল।

বাবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও একজন সৎ একনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ হিসেবে নিজ পরিবারে বারবার  তার প্রমাণ রেখে গেছেন। আমি অংকে বরাবরই ছিলাম কাঁচা। কিন্তু আমাকে উনি একেবারে নিরুৎসাহিত না করে ধৈর্য সহকারে জটিল সমস্যা গুলো বুঝিয়ে দিতেন। আমার ছোট এক ভাই অংকে ছিল দারুণ ভাল। বাবা তাঁর আগ্রহ ও মেধা অনুযায়ী পড়ার কাজে সাহায্য করতেন।

এই লেখাটির শুরুতেই বইয়ের কথা বলছিলাম। বই পড়া কিন্তু আমাদের শেখাতে হয়নি। আমাদের পরিবারে সকল সময় চার পাশে অসংখ্য বইয়ের মেলা থাকতো। সহজ ও সরল আদর্শে লালিত আমাদের শৈশবের নিত্য জীবনে বিনোদন বা আনন্দের উপকরণ আর অবসর বা 'পাসটাইম'এর অঙ্গ ছিল স্কুলপাঠ্য  বই এর বহির্ভুত কোন বই। বড় আপাদের দেখেছি ছোট বেলা থেকে প্রকাশিত সেই সময়কার জনপ্রিয় বিভিন্ন সাময়িকী যেমন, 'মৌচাক', 'রংমশাল', 'শিশুসাথী'র গ্রাহিকা ওনারা। একটি বছর শেষ হলেই আম্মা বাঁধাই করে ওগুলো যত্নের সাথে সংরক্ষণ করতেন।

এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের ও বিশ্ব সাহিত্যের অসংখ্য গল্প, কবিতা উপন্যাসের বই এর সমন্বয়ে আমার আম্মার বাক্তিগত লাইব্রেরীটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ; কিন্তু, বাইরের কেউ এলে হঠাৎ বইগুলোর দেখা পেতনা। শুধু মাত্র যেগুলি তখন পড়ছি সেগুলো ছাড়া সবই যত্নে রক্ষিত থাকত আমাদের বাসার পেছন দিকের কামরায় বড় বড় ট্রাঙ্কের ভেতর। কোন ট্রাঙ্ক কিন্তু বন্ধ বা 'লক' করা থাকত না; যাতে করে আমরা যখন খুশি বই নিয়ে পড়তে পারি। আম্মা সম্ভবত শিবরাম চক্রবর্তীর একটি রম্য গল্প থেকে, বন্ধুদের হাত থেকে বই ধার চাওয়ার সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার এক লেখা থেকেই সম্ভবত এই ধারণা কাজে লাগিয়েছিলেন। ভাল একটি  বইয়ের মাধ্যমে আমাদের মনের জগতের বিভিন্ন আলোকিত দুয়ার উন্মোচিত হতো। এই ভাবে শৈশব থেকেই আমরা বই পড়া ও সংরক্ষণের উপযোগিতাকে অনুভব করেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে সংগ্রহের বইকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রাখতে হয় আর সেই বই কখনও অপাত্রে দান করা উচিত নয়।

আমার বাবা আম্মা দুজনেই তাঁদের অবসরে ভাল আর উদ্দীপনামূলক কোন কবিতা আবৃত্তি ও এ সম্পর্কিত বিস্তৃত আলোচনা করতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের অনেক কবিতাই আম্মার প্রায় কন্ঠস্থ ছিল। প্রায়ই দেখতাম প্রতিদিনের রান্নার সময়ও আম্মা আপন মনে কবিতা আউড়ে যাচ্ছেন! রবীন্দ্রনাথের  ঠাকুরের  'সবলা'  কবিতাটি যেন আম্মারই মনের প্রতিচ্ছবি। ওনারা স্বামী স্ত্রী একসাথে কত যে ইংরেজী আর বাংলা বই পড়তেন আর আলোচনা করতেন তার হিসেব দিতে পারব না । আম্মা আর আব্বা নিজেরা তো নিয়মিত সংগ্রহে রাখতেন আর একই সাথে এই সংগ্রহের অন্যতম জোগানদাতা ছিলেন আমাদের পরিবারের অপর দুইজন বই অনুরাগী ব্যক্তিত্ব, আমার মামা প্রফেসর নাজমূল করিম ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ) ও আমার বড় আপা মিসেস রেবেকা সুলতানা।

 মনে পড়ে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, আম্মা একদিন আমার হাতে তুলে দিলেন পার্ল এস. বাক- এর বিশ্বখ্যাত 'দ্য গুড আর্থ' বইয়ের একটি সাবলীল অনুবাদ। সেই প্রথম বিশ্ব সাহিত্যের দোর গোড়ায় নিজেকে যেন নুতন ভাবে আবিষ্কার করলাম। এছাড়া ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী ও সাধারণ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের বইগুলোও বেছে নিয়ে মা তার এই কিশোরী  মেয়েটির হাতে তুলে দিতেন। বাবা মায়ের বইয়ের মাধ্যমে এই ধরনের একটি সুন্দর মানবতার দিক- নির্দেশনা আবহ সৃষ্টির প্রয়াস পরবর্তী কালে আমাকে সততার ও মানবতার কল্যাণমুখী আদর্শে জীবন গড়ে তুলতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। আমার আম্মার মত একাধারে  পরিপূর্ণ গৃহিনী আর সাহিত্যনুরাগী মহিলা খুব কমই দেখা যেত। যাদের স্মরণ করলাম, আমার পিতা মাতা, মামা, বড় আপা--আজ তারা কেউ নেই এ ধরণীতে। সুন্দর পৃথিবী গড়ার কারিগর হিসাবে আজ তাদের মত মানুষের বড়ই অভাব। ওনাদের আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

আয়েশা সুলতানা 
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ( অবসরপ্রাপ্ত ) 
দর্শন বিভাগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ,বাংলাদেশ