অটোয়া, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
বাদাইম্যা (২) -কবির চৌধুরী

বাদাইম্যা (১) পড়তে ক্লিক করুন

বাদাইম্যা (২) 
শীতের বিকেল। সন্ধ্যা হতে এখনও অনেক বাকী, তারপরেও মনে হচ্ছে রাত। আকাশে আধো আলো আর আধো কালোর খেলা চলছে। গতরাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে স্নো পড়েছে। অটোয়াতে প্রায় ৩০ সে.মি. স্নো পড়েছে। আগামী দুয়েক দিন আরও পড়বে। হানিফ ঘরেই বসে আছে। বসে বসে গত পরশু দিনের  বাংলাদেশ আর নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট খেলাটি দেখছে। কোন কামকাজ নাই। গত তিন মাস থেকে বেকার। নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণেই কর্মহীন। কর্মহীন হওয়ার শুরুটা নভেম্বরের ৫ তারিখ ভোর থেকে। এই দিনটি সে কোন অবস্থাতেই ভুলতে পারবে না। ৪ নভেম্বর ২০১৮ ছিল পত্রিকা আয়োজিত ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠান’।  বড় শখ করে হানিফ অটোয়াতে স্থানীয় বাংলাদেশী শিল্পীদের জন্য ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে’র প্রচলন করেছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর একটি বা দুইটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একক অনুষ্ঠানের আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। প্রতিবছরই অনুষ্ঠানের শেষে হানিফ প্রতিজ্ঞা করে- আর নয়। কারণ, সময় লস- টাকা লস- ফ্রেন্ডশিপ লস। কিন্তু তার কথা সে রাখতে পারে না। দেখা যায় দুচার মাস পরই হানিফ আবার অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে দেয়। এবছর ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। হঠাৎ করেই নভেম্বরে স্থানীয় শিল্পী নিয়ে ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে’র ঘোষণা দিয়ে দেয়। অন্যান্য বছর সপ্তাহের এদিক সেদিক অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলেও এবার একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের দিনই অটোয়ায় আরও তিন তিনটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের সাফল্য নিয়ে অনেকের মত হানিফও কনফিউজড ছিল। না জানি কি হয়। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণিত করে অনুষ্ঠানটি অটোয়ার সঙ্গীতপ্রিয় দর্শকদের উপস্থিতিতে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়। কানায় কানায় পরিপূর্ণ কৈলাস মিতালের এবারের অনুষ্ঠানটি অন্যান্যবারের তুলনায় সব দিক দিয়ে সফল। তাই অনুষ্ঠান শেষে হানিফ কদ্দুসকে জড়িয়ে ধরে এবং বলে- ‘আমি জানতাম একদিন না একদিন অটোয়ার সাধারণ মানুষ আমারে হেল্প করবো এবং পত্রিকার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাইবো’। সেই খুশিতে অনুষ্ঠানের পরে হানিফ বন্ধুবান্ধদেরকে নিয়ে স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে আনন্দে মেতে উঠে। যার পরিণতিতে শেষ রাতের এক্সিডেন্ট। একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এক্সিডেন্টের সময় কেউ ছিল না, ভোর ৫টা। সবাই ঘুমে নিমগ্ন। ইচ্ছা করলে হিটকরা গাড়ীর উইপারের নীচে দুঃখিত বলে একটি কাগজে তার সব ইনফরমেশন দিয়ে চলে আসতে পারতো। যা কানাডাতে আইনসিদ্ধ একটি ব্যবস্থা। কিন্তু তা না করে হানিফ ৯১১ কল করে পুলিশের সহযোগিতা চায়। তারপর যা হওয়ার তা হয়েছে। হানিফ আইন ভঙ্গ করে ড্রিংক করে গাড়ী চালানোর কারণে পুলিশ তার লাইসেন্স সাসপেণ্ড করে দেয়। এছাড়া গাড়ীটা তো জাহান্নামে গিয়েছে।  ড্রিংক এন্ড ড্রাইভের কারণে ইন্সুরেন্স কোম্পানি গাড়ী রিপ্লেইস করতে অপারগতা জানায়। সেই থেকে আজ অবধি হানিফ বেকার।         

গত সাড়ে তিন মাস তার ভালই কেটেছে। প্রতিদিনই ৮/১০ ঘন্টা করে টিমহরটন্সে দু’বেলা আড্ডা দেওয়া গেছে। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে শুধু রাতের আড্ডাই হয়। বিকেলেরটা বন্ধ। কারণ, বিকেলের আড্ডার সাথী তুহিন কানাডার বাইরে- প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। তাই হানিফ ইচ্ছা করলেই টিমহরটন্সে যেতে পারছে না। অথচ ঘরে বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। শেষপর্যন্ত হানিফ জ্যাকেটের উপর জ্যাকেট পরে হাঁটতে বের হয়ে যায়। সে আজ হাঁটবে। মন ভরে হাঁটবে। হাঁটার জন্য বাড়ীর পাশের রাস্তাটা বেছে নেয়।      

হানিফ অটোয়ার যে এলাকাতে বাস করে, সেই এলাকাটি শহরের অন্যান্য এলাকার মত উন্নত নয়।  এখানের অধিকাংশ মানুষই খেটে খাওয়া গোছের। রুজ আনে রুজ খায়। যারা কাজ কাম করে না তারা সরকারের মাসিক ভাতার উপর নির্ভরশীল। অটোয়াতে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, হরহামেশা নতুন নতুন আবাসিক এলাকা, নিত্যনতুন মার্কেট তৈরি হচ্ছে কিন্তু অটোয়ার এই প্রাচীন ঘনবসতি এলাকাটির কোন উন্নয়ন হয়নি। উন্নতি হয়েছে এক জায়গায়, আগে যেখানে এলাকার ডাস্টবিনগুলোর আশে পাশে বসে সিগারেট আর গাঁজা ফোঁকা হত সেখানে এখন মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউতে বসে গাঁজা ফোঁকা আর কেনাবেচা হয়।        

হানিফ তার বাসার পিছনের রাস্তা কামিংস দিয়ে একমনে হাঁটছে। রাস্তার সাইডওয়াকগুলো স্নোতে ভরা। এখনও পরিস্কার করা হয়নি। সে গাড়ী চলাচলের রাস্তা দিয়েই একমনে হাঁটছে। রাস্তাটা আজ একেবারে নিরিবিলি।  মানুষ আর গাড়ীর চলাফেরা খুবই কম। হানিফের হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। আপনমনে ফোনে সেইভ করা গান শুনছে আর হাঁটছে। বাংলাদেশের নতুন গায়ক রাসেল ফেরদৌস নূরের কণ্ঠে, “তুমি হৃদয় বোঝো না, আমার মন বোঝো না- তোমার জন্য কাঁদে আকাশ, কাঁদে বাতাস, ঝরে জোছনা” গানটা শুনতে ছিল তখনই জ্যাকেটের বুক পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন অনুভব করে। হাতের গ্লাভস খুলে পকেট থেকে ফোনটি বের করে নাম্বার দেখে এবং উত্তর দেয়,   
-হেই    
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে পাওলার মায়াবী কণ্ঠ ভেসে আসে, 
-আপনি কোথায়?
-রাস্তায়।  
-রাস্তায় কি করেন?
-হাঁটছি আর আপনার সাথে কথা বলছি। 
-কোথায় যাচ্ছেন?
-কোথাও না, হাঁটার জন্য হাঁটছি।
-এই জন্যই তো বলি, আপনি আস্ত একটি পাগল। এই দিনে মানুষ হাঁটতে বের হয়।
-কি করবো। কিছু ভাল লাগছিলো না। অস্থিরতায় ভুগছিলাম। আমার কথা বাদ দেন, বলেন আপনি কেমন?
-না, তেমন কিছু না। বসে আছি। আপনি সেদিন বললেন না- লাইসেন্স ফেরত পেয়েছেন?
-জ্বী, আপনাকে বললাম তো। ভুলে গেছেন? 
-না, ভুলিনি। এখন কি তাহলে গাড়ী কিনবেন?
-কিনতে তো চাই। কিন্তু কেনা হবে না।
-কেন?
- ঐ একটা কথা আছে না, ইচ্ছা আছে বন্ধু সামর্থ নাই। ও আচ্ছা ভুলেই গিয়েছিলাম- ভুলার আগে বলে ফেলি, হ্যাপি বার্থ ডে। কত বছর হইল যেন? 
-কবে মরলো রহমত, আর আজকে হলো কবর জিয়ারত। এক সপ্তাহ পরে উইশ করলেন।
-ঐ দিনই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ইচ্ছা করে করিনি।  
-কেন? 
-আপনার বার্থডে আর ভ্যালেন্টাইন ডে একই তারিখ তাই।    
-ওহ তাই বলেন। এনিওয়ে, উইশ করার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকেন। এখন রাখি। আবার ফোন করবো। 

২০০৬ সাল। হানিফ ডাউন টাউনের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করে। লাইন কুকের কাজ। সপ্তাহে পাঁচ দিন, ৩৫ থেকে ৩৮ ঘণ্টা। প্রতিদিন বিকেলে। হানিফের একমাত্র কাজ এটিই। অন্যদের মত সে দুটি বা তিনটি কাজ করতে আগ্রহী নয়। সেকারণে হানিফ অনেক সময় কাজের আগেই ডাউন টাউনে চলে যায়। সেদিন রবিবার ছিল। সে ঘণ্টা খানেক আগেই বাইওয়ার্ড মার্কেটে চলে আসে। দেখে রেস্টুরেন্ট খুব বিজি। রেস্টুরেন্টের ভিতর বাহির কাস্টমারে ভর্তি। কুক সার্ভার সবাই ব্যস্ত। হানিফ এমুহূর্তে রেস্টুরেন্টের ভিতরে যাবে কি না চিন্তা করছিলো, তখন দেখতে পায় বিলি বারে রাখা মেশিনে খেলছে। বিলিকে দেখে হানিফ রেস্টুরেন্টের ভিতরে চলে আসে।     

বিলি পাপাডাকিস, গ্রীক ক্যানাডিয়ান। রেস্টুরেন্টের মালিক। সে খুব কমই রেস্টুরেন্টে আসে। মাঝে মধ্যে আসে, টাকা নিতে। তার থাকার মানে হল হানিফের কাজ নাই। বিজি না হলেই বারে ডেকে নিয়ে আসবে। বারে তার একটি খেলার মেশিন আছে। বিভিন্ন জাতের খেলা খেলা যায়। যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই মেশিনটার সামনে বসে থাকবে আর খেলবে। রেস্টুরেন্টের সবাই বলে সে নাকি বিলির সবচেয়ে বেশী পছন্দের কুক। বিলি অবশ্য সব কুককে-ই প্রচণ্ডভাবে ভালবাসে। তাই তো সে সবসময় তার সার্ভারদেরকে বলে বেড়ায়-‘নেভার মেসাপ উইথ মাই কুক’। বিলিকে দেখে তার ভালই লাগছে। আজ কাজ করতে হবে না। রোববারের কাজ। রোববার হল ক্লিনিং ডে। খুব খুশি হয়েই তার সামনে যায় এবং বলে,    
-হ্যালো বস, হোয়াটস নিউ?  
-আই টোল্ড ইউ নেবার কলড মি বস।
-সরি; হোয়াটস ব্রিং ইউ টুডে সো আরলি।
-নাথিং পার্টিকুলার, অল সেইম সীট, নাথিং হেপেনিং। হোয়াট এবাউট ইউ। এনি লাক?
-নো।     
হেই পাওলা, প্লিজ কাম হেয়ার। গিভ হিম রাম এন্ড কোক- ডাবল শট। ওহ আই ফরগেট টু ইনট্রডিউস হার। সী ইজ পাওলা। সী স্টার্টস টুডে। পাওলা_ হি ইজ হানিফ, মাই ফ্রেন্ড! বাংলাদেশী ফ্রেন্ড। 

হালকা-পাতলা, চিকন গড়নের কোমর পর্যন্ত আঁকাবাঁকা করা বিক্ষিপ্ত লম্বা কালকেশ, কড়া টকটকে হলুদ ত্বকের ২০/২২ বছরের মেয়েটি হানিফের সামনে টেবিলের উপর ড্রিংকটি রেখে বলে, 
- আপনার ড্রিংক¬___  
মেয়েটির কথা শুনে হানিফ থ’ বনে যায়, ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে_  

আই উই’বি ব্যাক বলে বিলি কিচেনে চলে যায়… চলবে।

কবির চৌধুরী
অটোয়া, কানাডা।