অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র ও সুশাসন - মো.ওসমান গনি

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হল গণতন্ত্র ও সুশাসন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন। থাকলেও গণতন্ত্রের অবস্থা এখন কেমন? দেশে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হয় কিনা? দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বলছে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। আর একটি দল বলছে দেশে গণতন্ত্রের কোন লক্ষন ই দেখা যাচ্ছে না। গণতন্ত্র আর সুশাসন না থাকলে দেশের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটতে বাধ্য। টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র ও নারীর ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। 
বর্তমানে দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন হবে না। আর সুশাসন না হলে দেশের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে উত্তরাধিকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সত্যিকারের দল করতে চাইলে দলগুলোকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। দেশের দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত বা নানা মতের আলাপ-আলোচনা থাকতে হবে।  কিন্তু সেটি নেই। আছে শুধু হালুয়া-রুটির ভাগবাঁটোয়ারা।
তৃতীয় কোনো গণতান্ত্রিক দলের আগমন হলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। এছাড়া গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন একসঙ্গে চাইলে হবে না। পর্যায়ক্রমে এগোতে হবে। এজন্য প্রথম দরকার গণতন্ত্র। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে উন্নয়ন হবে। এখন দেশে যে উন্নয়নের ম্যাজিক দেখছি, তা হল বিদেশে কর্মরত প্রবাসী, পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিক এবং কৃষকের অবদান। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সুশাসন প্রয়োজন। দেশে যে গণতন্ত্র আছে, তাতে নানা ত্রুটি আছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটা পরিবর্তন দরকার।
দেশে ডমিন্যান্ট পার্টি সিস্টেম দেখা যাচ্ছে। এ ধারা ২০১৩ সালে শুরু হয়নি, বরং ১৯৯১ সালেই শুরু হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এমন এক সরকার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে তৃতীয় শক্তি জোর করে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দলগুলো অনিশ্চয়তার জন্য এ ব্যবস্থা পছন্দ করে না। রাজনৈতিক দলগুলো উন্নয়নকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এবং বলার চেষ্টা করেন উন্নয়নের জন্য ক্ষমতার ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ। বামপন্থী রাজনীতি বর্তমানে দুর্বল হওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের কথা কেউ বলছে না। রাজনীতির পরিবেশের উন্নতির জন্য এটি প্রয়োজন। 
দুই দলীয় গণতন্ত্রই হোক অথবা একদলীয় হোক, ক্ষমতা সবসময় বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতেই কুক্ষিগত থাকে। বামপন্থী দলগুলোর মূল সমস্যা হল তারা শুধু সম্পদ পুনর্বণ্টনের বিষয়েই নজর দিয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
দেশে পুলিশের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তবে একটি পুলিশি রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, সেরকম নয়। তবে তা আনডিসিপ্লিন এবং মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা হয়তো অন্য নামে বা অন্যভাবে আবার ফিরে আসবে। এজন্য শুধু নিষিদ্ধ করলে হবে না, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে হবে।
নারীই হল এদেশের সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি। সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতিসহ পারিবারিক প্রয়োজনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা যে সেবামূলক শ্রম দিচ্ছেন, তার ওপর দাঁড়িয়েই দেশ আজ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে অগ্রগতি লাভ করেছে। এসব সেবামূলক কাজে পুরুষের চেয়ে নারীদের সম্পৃক্ততা বেশি হলেও নারীরা সামাজিকভাবে এখনও শক্তিশালী হতে পারেননি। এসব কাজে তাদের মজুরি পরিমাপ করা হয় না বললেই চলে। ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীদের কাজের স্বীকৃতি গৌণই থেকে গেছে। অভিভাবকদের মানসিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার। নারীদের আজ মজুরিহীন শ্রম থেকে মজুরিযুক্ত শ্রমে আসার প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায়ও দেখছি তারা বেশ এগিয়ে আসছে। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতার হুমকি থেকেই যাচ্ছে। আবার পেশা ভেদে আছে মজুরি বৈষম্যও। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়লেও সেটি মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় এখনও সন্তোষজনক নয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর এবং পারিবারিকভাবে শিক্ষার পাশাপাশি স্কুলপর্যায় থেকে দক্ষতার উন্নতি শুরু হলে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য কমে আসবে।
রফতানি পণ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা একটি মূল চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও রফতানিবিরোধী মনোভাব দূর করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রফতানি আয় বৃদ্ধি, জিডিপি ও রফতানি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনাসহ সব কাজ ভিয়েতনাম একই সময়ে করতে সক্ষম হয়েছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশেরও নজর দেয়া উচিত। বাংলাদেশের শুল্কহার প্রাথমিকভাবে অনেক বেশি ছিল। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ তা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রগুলো আরও দ্রুততার সঙ্গে শুল্কহার কমিয়ে ফেলায় বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ১৬২টি দেশের উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, শুল্ক শিথিলকরণ এবং রফতানি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বৃদ্ধির মাঝে ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ বাণিজ্য নীতিকে গুরুত্ব দেয়নি। এর পেছনে একটি মুখ্য কারণ হল ডব্লিউটিও থেকে বাংলাদেশের ওপর কোনো চাপ ছিল না। কারণ বাংলাদেশ ডব্লিউটিও’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। স্বল্পমেয়াদে সংরক্ষণবাদের নীতি গ্রহণ করলেও সেটি দীর্ঘমেয়াদে করা ক্ষতিকর হবে।

মো.ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কুমিল্লা, বাংলাদেশ।