অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
অভিবাসী মন… (প্রথম পর্ব) – ফরিদ তালুকদার

মার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন্ সোনার গাঁয়”…  অতি প্রিয় একটি নজরুল গীতির প্রথম লাইন।

খর চৈত্রের দুপুর। হিজল আর বাঁশ ঝাড়ের ছায়া পেরিয়ে দক্ষিণের বিস্তৃত মাঠের বাতাসে পরিস্কার চোখে পড়ে নীল আকাশ থেকে ঝরে পড়া সূর্যের কাঁপন। তপ্ত রোদের দাহকে এড়াতে বাঁশ হিজলের ছায়ায় শুয়ে  জাবর কাটছে ছোট্ট গরুর পাল। দৃশ্যটি কেমন যেন শরৎ বাবুর বিখ্যাত মহেশ গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। 

দক্ষিণের পথে মাঠের দৌড় বলেশ্বরের তীরে এসে থমকে গেছে। একটু থেমে ওপারে আবার মাঠ। এই দুই মাঠের বিস্তৃতি ই এক সময়ের তেজস্বিনী বলেশ্বরের গর্ভ থেকে উদগত। সময়ের পরিক্রমায় সব জৌলুস হারিয়ে সে এখন মাত্র বিশ ফুটি বুকের এই ক্ষীণ ধারায় পরিণত হয়েছে। বয়সী সন্ধ্যার আসরে তার সেই উন্মত্ত যুবতী সময়কে নিয়ে এখন আর কোন গল্প কথা হয়না। তবে এখনো আসে জোয়ার ভাটা। তার ক্ষীণ ধারার বুকে এখনো দোলে একাদশীর চাঁদ। তার তীরে বেড়ে ওঠা কিশোর এখনো দেখে স্বপ্ন। 

জীবন পাল্টায়। পাল্টায় বলেশ্বরের দুই তীরে মানুষের চাওয়া পাওয়া জীবিকার ধরন। ছোটবেলার কিছু কিছু রোমাঞ্চকর দিনগুলোর অন্যতম ছিল বলেশ্বরের ওপারের মাঠে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা এবং ঘোড় দৌড়ের প্রতিযোগিতা। বছরে একবার হওয়া এই মেলা এখন বিলুপ্ত উৎসবের তালিকায়। সারাটা বছর প্রতীক্ষায় থাকতো শিশু মন। বাঁশি, বেলুন, বাতাসা, মুরলীর প্রাণ ভরা এই উৎসবের জন্যে। এখনকার কোন শৈশবের এমন কোন প্রতীক্ষা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিত প্রতিটা প্রজন্ম ই সময়টাকে তাদের নিজেদের মত করে উদযাপন করে। প্রকৃতির অবধারিত বিবর্তনের ধারায় আমরা এক সময় থেকে আরেক সময়ের উপকন্ঠে এসে দাঁড়াই। সময়ের সমান্তরালে চলে মনোজগত ও। তারপরও কখনো কখনো তা মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। তাইতো এতটা বছর পরে গিয়ে যখন বাতাসে শৈশবের সেই মাটির গন্ধ খুঁজি বড় ধাক্কা লাগে বুকে। একটু কান্না পায় কি পায় না বুঝতে পারিনা। হয়তো একটু বেশীই বোকামি এই আবেগ। জানিনা…। এখনো বহতা কালের সাক্ষী বলেশ্বর যে কিছুই বলেনা!

শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর সকল প্রাণী ই আবেগ অনুভূতির দাঁড়া তাড়িত হয়। তাদের জিন ক্রোমোজম এবং বেড়ে ওঠা পরিবেশই একে নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝে মধ্যে এর শ্বাশত সহজাত প্রকাশ শরীর মন দুটোর জন্যে ই প্রয়োজন। যারা একটু বেশী সৃষ্টিশীল তারা নিজস্ব কর্মের ভিতর দিয়েই এর মুখ্য প্রকাশ ঘটায়। বেশীরভাগ সাধারণ মানুষই সেই সব কর্মকে উপভোগ করে আবেগ আপ্লুত হয়। ঘটনা বিশেষে কখনো কখনো অবচেতন ভাবেই ( জাগতিক হিসেবে কোন যৌক্তিক কারন ছাড়াই ) মনের মধ্যে একটি পক্ষ বিপক্ষ তৈরী করে উচ্ছাস আর শিহরণের মাত্রাটা আর একটু উঁচুতে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনা – ব্রাজিল ফুটবল খেলার সময় অধিকাংশ বাংলাদেশী তরুণ তরুণীরা যেমন করে থাকে। বলাবাহুল্য আমি নিজেই একশত তেত্রিশ ভাগ একটু স্থূল এই আবেগী শ্রেণীর গোত্রভুক্ত। আর সে কারনেই ম্যারাডোনার আপাতঃ শেষ বালিকা বন্ধু ওকে ঘর থেকে বেড় করে দেয়ার খবরটি পড়ে মনটা ক্ষণিকের জন্যে দু’ছটাক খারাপ হয়ে যায়! একসময় গলফ ছিল আমার তালিকায় এক নম্বর বিরক্তিকর খেলা। বয়স ই হোক বা ষাঁড়ের যুদ্ধের মত নর্থ আমেরিকান ফুটবল খেলার ধুন্ধুমার রণকৌশলের কারনেই হোক, কেন যেন গলফ এখন আমার পছন্দের উল্টো মেরুতে। আর তাই টাইগার উডস একটা খারাপ রাউন্ড খেললে মনের আকাশটা কেমন মেঘমন্ডিত, বৃষ্টি, বরফ এর মিশ্রনের মত প্যাচপ্যাচে হয়ে থাকে! আর ভালো সট গুলো বিয়ারের রংয়ে রাঙিয়ে, বারবার দেখি। এমনকি অর্ধাঙ্গিনীর সদ্য চোখে পড়া গয়নাটা কিনতে যাওয়ার পরিকল্পনাকে সদর্পে (?) উপেক্ষা করেও..!!

“Nothing can come from nothing” and
“It is impossible for the matter to be the final and original being”….. Philosopher Clarke
“কোন কিছু ছাড়া কোন কিছুই আসা (সৃষ্টি হওয়া) সম্ভব নয়”
এবং…
“বস্তুর পক্ষে কখনোই সব কিছুর শুরু এবং শেষ হওয়া সম্ভব নয়”…. দার্শনিক ক্লার্ক। 

On the other hand (অন্যদিকে)…
“Whatever exists must have a cause or reason of it’s existence; it being absolutely impossible for anything to produce itself, or to be the cause of it’s own existence”… Philosopher David Hume.

“মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তার সব কিছুর অস্তিত্বের জন্যে অবশ্যই কোন না কোন কারন থাকতে হবে; কোন কিছুর নিজে নিজে তৈরী হওয়া যেমন সম্পূর্ণ ভাবেই অসম্ভব তেমনি তার নিজের অস্তিত্বের কারন হওয়াও সম্পূর্ণ অসম্ভব”… দার্শনিক ডেভিড হিউম।

----কোন দিকে যাবো? বুঝতে পারিনা। বিতর্ক এবং দ্বন্দ্ব মানব জীবনের (অন্য প্রাণীদের মাঝেও দেখা যায়) একটি নৈমিত্তিক ঘটনা এবং তা ঈশ্বর থেকে শুরু করে গভীর দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, দৈনন্দিন জীবনের ছোট খাটো সিদ্ধান্ত সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।  

প্রতিটা মানুষ কি তার কর্ম দিয়ে যার যার মত করে জীবনের জন্যে একটা সুরঙ্গ পথ তৈরী করে তার ভিতর দিয়ে গোটা জীবন অতিবাহিত করে অবশেষে একদিন পরকাল নামক পাত্রে নিক্ষিপ্ত হয়? যেক্ষেত্রে এই তৈরী সুরঙ্গের মানদণ্ডের দায় দায়িত্ব তার নিজের উপরেই বর্তায়? নাকি জন্মক্ষণ বা জন্মপূর্ব থেকেই তার জন্যে সুরঙ্গটি পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং সে শুধু তার ভিতর নিক্ষিপ্ত হয়, পরে গোটা জীবনই সে সেই সীমার মধ্যে থেকে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে একদিন ইহলীলা সাঙ্গ করে। এখানে তার নিজ দায়িত্বের মাত্রা খুবই সীমিত। যেটাকে আমরা সোজা কথায় ভাগ্য বলে থাকি। নিজের কাছে এ ধাঁধার কোনদিন উত্তর পাবো বলে মনে হয় না। 

বর্তমান ই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এটা এখন আমরা অনেকেই জানি।  কিন্তু জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কোনটি? প্রশ্ন টা প্রায়শঃই আমার মনে জাগে। 

মাতৃ গর্ভের নিজস্ব ছোট ভূবন শেষে পৃথিবীর পথে জীবনের প্রথম যাত্রার ছোট পথটুকু পারি দিয়ে সফল অবতরণের পরেও মায়ের বুকের পরিধিতে ই আমরা পড়ে থাকি দীর্ঘ একটা সময়। সম্ভবতঃ জন্মের পরে মানব শিশুই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অসহায় থাকে। স্মৃতি শক্তি তৈরী হবার পূর্ব পর্যন্ত এ জীবনের যতটুকু জানি তাতো শুধু শোনা কথা। বাকীটা হয়ত অন্য শিশুর জীবন দেখে ধারণা করে নেই। তবে বেশীর ভাগটাই থেকে যায় অন্ধকারে অজানা রহস্য। যেমন অজানা রহস্য জিন ক্রোমোজমের ভিতর বয়ে বেড়ানো আমাদের এক একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর সবার মস্তিষ্কের রসায়ন। জন্মগত কোন বড় সমস্যা না থাকলে এই সময়েই আমরা জীবনের পথে মহাকাব্যিক সেই প্রথম পদক্ষেপ টি ফেলতে শিখি। এই সময়েই আমরা পৃথিবীকে সবচেয়ে নির্মল হাসিগুলো উপহার দেই। জীবন কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা তাই সেখানেই ফেলে এসেছি বলে আমার কখনো মনে হয়।

ভার্সিটিতে আমাদের এক বন্ধু ছিল ( ছিল বলছি কারন যোগাযোগ নেই, তবে জেগে আছে সবসময় হৃদয়ের কাছাকাছি )। খুব ভালো বন্ধু শাকিল, একবার কথা শুরু করলে হাতের সিগারেট বেচারার অবস্থা কাহিল হয়ে যেত। কম হলেও তিন চারবার করে নিভে যাওয়া সিগারেটে আবার আগুন ধরাতে হতো। কথা তবুও শেষ হতো না। আমরা বলতাম তুই পায়ে বল পেলে এতই ড্রিবল করিস যে পাস ও দিস না গোল ও করিস না, শেষে ওটা মাঠের বাইরে নিয়ে ছুটতে থাকিস। অর্থাৎ শাকিল ততক্ষণে মাঠ ছেড়ে অলিগলি পার হয়ে ভুলেই গেছে গল্পটা কোথা থেকে শুরু করেছিল। কিন্তু গল্প দিব্যি চলছে…। নিশ্চিত, অভিবাসী মন লিখতে গিয়ে এখন আমার হালও তেমনি। ---- চলবে

ফরিদ তালুকদার
টরন্টো, কানাডা।