ভাষার নীতি-দুর্নীতি-রাজনীতি ও বাঙালীর উন্নয়ন - কুদরতে খোদা
আজ আমি যে বিষয়ে লেখার নিয়ত করেছি সেগুলো না লিখতে পারলেই আমি খুশী হতাম৷ কারণ এই কথাগুলো অনেকাংশে অপ্রীতিকর এবং দুঃখজনক। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সর্বস্তরের চালুর সংগ্রাম শুরুর বছর ১৯৪৮ থেকে আজ ৭০ বছর পার হয়েছে৷ এর মধ্যে স্বাধীনতা-উত্তর ৪৮ বছরে সর্বস্তরে বাংলা প্রতিষ্ঠা ও প্রসার তো দূরের কথা, বাংলা ভাষা এখন একটা বিপদের সম্মুখীন৷
বিপদটা এখনও অনেক খানি অদৃশ্য, অবহেলিত। তা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে নানা কারণে, যদিও প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলেই ঘটা করে দুনিয়াজুড়ে বাঙালিরা নানা আচার অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে৷ রেডিও, টিভি, টকশো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ও পত্রপত্রিকায় রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী লেখক-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে বলতে লিখতে দেখা যায়৷ তবে, বিপদটা একেবারে দৃষ্টির বাইরে তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ আমার জানা মতে, অন্তত কতিপয় বিবেকবান ও দায়িত্বশীল বাঙালী নিয়মিত এবং সাহসের সাথে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর বিষয়ে বলে-লিখে যাচ্ছেন৷ এমনকি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকেও তার বক্তৃতায় এ বিষয়ে কথা বলতে শোনা গেছে। তিনি আদালতের বিচারকদের অনুরোধ করেছেন যেন উনারা আদালতের রায় বাংলায় লেখার চেষ্টা করেন বা অন্ততপক্ষে যেন সহজ ইংরেজীতে লেখেন৷
এখন প্রশ্ন হলো সমস্যাটা কোথায়, এর কারণ কি, বা এর ভবিষ্যত কি?
যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয় ‘লিখুন বাংলায়, যাতে মানুষ বোঝে’ তখন বুঝতে হবে সমস্যাটা কত গভীর। পৃথিবীর কোন সভ্য, স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক দেশের আদালতে এটা অসম্ভব কারণ এরকম একটি দেশে রাষ্ট্রভাষায় লিখতে বা বলতে না পারলে সেটা অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। ফলে কোন বিচারকের চাকরি থাকবে না এবং এই এক্ষেত্রে কোন অজুহাতও চলবে না৷
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এটাকে বলেছেন ‘নষ্টামি, প্রতারণা, বা বিশ্বাসঘাতকতা’৷ কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আর ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’ কিন্তু, সংবিধানে বাংলা ভাষা উন্নয়নের বিষয়ে দিক-নির্দেশনা থাকলেও চার দশকের বেশি অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না!
আমি সহমত। আমি এটাকে বলছি দুর্নীতি, যদিও আমরা দুর্নীতি বলতে সাধারণত অবৈধ বা অসাধু উপায়ে আর্থিক বা অন্যভাবে ক্ষমতাবান বা লাভবান হওয়াকে বুঝি৷ কিন্তু দুর্নীতির আরেক অর্থ হলো নষ্ট,পচন, বা সঠিক বা খাটি অবস্থান থেকে ভুল ভেজাল পথে সরে যাওয়া৷
আলোচনার সুবিধার্থে আমরা বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে তিনটি প্রশ্নে সীমিত রাখতে পারি৷
১) বাংলা ভাষা আসলেই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে কিনা বা ভেজাল আক্রান্ত কিনা৷
২) ভাষার মধ্যে একটু ভেজাল থাকলে সমস্যা কোথায় বা অন্যকথায়, ভাষা- দূষণ উন্নয়নের পথে কিভাবে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে?
৩) এই জাতীয় দূষণের কবল থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
শিক্ষিত, সচেতন, ও ভাষা নিয়ে কাজ যারা কাজ করেন তারা এ বিষয়ে প্রায় একমত যে ভাষা- দূষণ ক্যান্সারের মতো বিস্তার লাভ করছে৷ দেশে-বিদেশে, গোচরে-অগোচরে, ঘরে-বাইরে এর উদাহরণ পাওয়া যাবে সর্বত্র। এগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক কথা লেখা হয়েছে, বিশেষ করে বিডিনিউজ২৪ডটকম এ৷ ফলে আমি এখানে এ প্রসঙ্গে কথা বাড়াবো না, শুধু দু একটার উল্লেখ করব মাত্র৷
বাঙালি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজকাল প্রচলিত বা প্রমিত বাংলা বলতে পারেনা বা বলতে চান না৷ অনেক মেহনত করে ইংরেজি স্টাইলে বাংলিশ বলার বদভ্যাস রপ্ত করেছেন যাতে শুনে মনে হয় যেন উনি সদ্য কানাডা-আমেরিকা-ইংল্যান্ড থেকে উড়ে এসেছেন৷ যেমনঃ এরা ‘আমরা’ (সর্বনাম) কে বলে “আমড়া” (ফলের নাম), বৃষ্টিকে বলে ‘বৃচটি, ইত্যাদি৷
বাঙালী দুধের মধ্যে পানির ভেজাল দিত বলে বাল্যকালে শুনেছি। কিন্তু এরা এখন বাংলার মধ্যে অহেতুক ইংরেজি-আরবী-হিন্দির ভেজাল শব্দ মিশায়। যেমন, সো, বাট, ভিউয়ারস, লাভ করি, রাবিশ, বিন্দাস, ইত্যাদি ফাশন-শব্দগুলো সমাজে, এমনকি গণমাধ্যমেও হরহামেশাই শোনা যায়। বিস্ময়কর, কিন্তু বিয়ে-শাদী, জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলোতে ইংরেজিতে উপস্থাপনা বা ঘোষণা করতে দেখা যায়। এমনকি বয়-বেয়ারা পর্যন্ত এসব অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে তোতাপাখির মতো দুই-একটা মুখস্ত বুলি আউড়ে স্মার্ট হবার হাস্যকর চেষ্টা করতে থাকে!
এছাড়াও, অহেতুক কথা বলার সময় ভুলভাল ইংরেজি বাক্য-শব্দ উচ্চারণ করা; সাইন বোর্ড, বিল -বোর্ড, প্রতিষ্ঠানের নাম, সংসদের কমিটির নাম, ইংরেজিতে দেয়া; ব্যাংক-বীমা হাসপাতাল থেকে শুরু করে রেডিও-টিভির অধিকাংশ নাম ইংরেজিতে লেখা প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। টিভিতেও এফএম রেডিও-র মতো ইংরেজি-বাংলা মিশ্র ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা ও পাশাপাশি অনেক অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত ভাষায় উপস্থাপনা, প্রশ্নোত্তর সহ এক জগাখিচুড়ী ভাষা কৃত্রিমভাবে চাপানোর চেষ্টা চলছে।
আর সবচেয়ে দুঃখজনক ও আপত্তিকর হল বাংলাদেশের শতখানেক ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলোর নাম ইংরেজিতে দেয়া যেমনঃ ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, ইয়ুল্যাব, ইন্ডেপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ, ইত্যাদি! কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোর সোনালী, রূপালী, পুবালী, অগ্রণী এরকম খাঁটি বাঙলা নাম চালু ছিল। এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যায়। এখন আর কোন প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখা হবে কিনা সন্দেহ৷ এক কথায়, মনে হচ্ছে যেন বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রে কোন নিয়ম নীতির প্রয়োজন নেই। যার যেভাবে খুশী বাক্য রচনা করবে, বানান করবে, উচ্চারণ করবে! এ ক্ষেত্রে যেন ‘আমরা সবাই রাজা’। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলোর ভাষা-চর্চার ইতিহাস ও ঐতিহ্য কি তাই বলে? বলাই বাহুল্য, ইংরেজি, ফরাসি, স্পানিশ, জার্মান, চীনা, জাপানি সহ বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো খুবই নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চলে। কারণ, ভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব তারা সত্যিকার অর্থেই উপলদ্ধি করে। অতএব, তারা এর উন্নয়নে যত্নশীল।
তবে, এগুলো রোগের লক্ষণ মাত্র, মূল কারণ নয়৷ এবং এই রোগ বা সমস্যাটা বহুমাত্রিক৷ মানুষের শরীরে যখন রোগ জীবাণু বাসা বাধে তার কিছু লক্ষন থাকে। তেমনি, ভাষার দূষণও হলো একটি জাতির অসুস্থতার লক্ষণ৷ কারণ মানুষ তার সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ও উন্নতি -- যা কিছু অর্জন করেছে তার প্রধান বাহন হল তার মাতৃভাষা৷ উন্নয়নের জন্য ভাষার গুরুত্ব অপরিহার্য৷ খুব সোজা করে বললে উন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল (টেকনোলজি)৷ আর এই জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই। এজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম৷ আর আঞ্চলিক প্রবাদ আছে ‘তোলা দুধে পোলা বাঁচেনা’। ফলে, বই-পুস্তক, জ্ঞানবিজ্ঞান তথ্য সবকিছু মাতৃভাষায় যত সহজলভ্য হবে ততই জাতীয় শিক্ষার ভিত্তি পোক্ত হবে- এই জলের মতো তরল সত্য বুঝার জন্য কারো রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই৷ চীন জাপান কোরিয়া ফ্রান্স জার্মানি রাশিয়া ক্যানাডা আমেরিকার মত অনেক উন্নত দেশের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে৷
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা না গেলে দেশের উন্নয়নে সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না৷ আর এখানেই হল ভাষার রাজনীতি। ভাষা প্রতিষ্ঠার এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। পশ্চিম পাকিস্তানীরা যেমন আমাদের উপর উর্দু চাপাতে চেয়েছিল আর ইংরেজরা চাপিয়েয়েছিল ইংরেজী। এক পর্যায়ে আমরা রাজনীতির পরাধীনতা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি বটে, কিন্তু বিদেশী প্রভুদের মানসিক ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে এবং আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পার্থক্য একটাই, আগের শত্রু ছিল বিদেশী-বিজাতীয়। কিন্তু, এখন এরা আমাদেরই জাত ভাই বাঙালি, এরা আমাদেরই আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব সহকর্মী৷ মানে ঘরের শত্রু বিভীষণ। তাহলে, এগুলোর কারণ কি এবং এদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই বা করবো কিভাবে এখন প্রশ্ন সেটাই।
কারণ বহুবিধ- রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক, ইত্যাদি৷ এখানে এত আলোচনা করার সুযোগ নেই৷ তবে, সংক্ষেপে যা বলা দরকার সেটা হল- হীনমন্যতা বা অজ্ঞতা। বাঙালি হয়ত মনে করে উল্টোপাল্টা ইংরেজি বলতে পারলে জাতে উঠা যাবে, আরবী বলতে পারলে সোজা বেহেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা, আর হিন্দি বললে বলিউডের নায়ক নায়িকাদের মতো স্মার্ট হওয়া যাবে। তবে এহেন হীনমন্যতা বা অজ্ঞতার মূলে আছে আধুনিক ও মানব উন্নয়নমুখী ভাষা নীতি এবং শিক্ষানীতির অভাব। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলা ইংরেজি ও আরবি শিক্ষার এক বিষাক্ত জগাখিচুরী। ফলে, বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি এহেন বিষবৃক্ষের ছায়াতলে শুকিয়ে মরবে সেটাই স্বাভাবিক। ভাষা ও সংস্কৃতিও যেন এখন ইয়াবাখোর বা ইয়াবা-সম্রাটদের নিয়ন্ত্রণে। নাহলে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সর্বস্তরে বাংলা চালু করা যাচ্ছে না কেন? উচ্চ শিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় একই অবস্থা৷
উপনিবেশিক মানসিকতার কারণে ও তাদের ক্ষমতা কাঠামো বজায় রাখতে ভাষাগত বৈষম্য সৃষ্টি করে শাসকশ্রেণী৷ কারণ আমজনতা ভাষা বুঝলে তো শাসক শাসক শ্রেণীর জন্য তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা৷ যে কারণে অনেক ঘটনাই ঘটছে সরকারের চোখের সামনে৷ সরকার অনেকটা যেন নীরব দর্শক৷ যাহোক, অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর একুশের বক্তৃতায় বিচারকদেরকে অনুরোধ করেছেন মামলার রায় বাংলায়, না হয় অন্তত পক্ষে ‘সহজ ইংরেজিতে’ লিখতে। এখানে অনুনয়-বিনয় করার কি আছে আমার কাছে বোধগম্য নয়। সোজা নিয়ম করলেই হয় -বাংলায় লিখতে না পারলে এদেশে বিচারকের পদে কারো চাকরি হবে না বা তাঁর চাকরি থাকবে না৷ এটা কি কল্পনা করা যায় যে কোন সভ্য ও স্বাধীন দেশে কোন বিচারক সেদেশের সরকারী বা রাষ্ট্র ভাষায় রায় লিখতে অপারগ? কিন্তু সত্যি সেলুকাস, বাংলাদেশেই তা সম্ভব!
যাহোক, আরেকটি বিষয়ে কিছু বলা দরকার আর সেটা হলো উন্নয়ন। আমরা যদি মনে করি শুধু টাকা পয়সা ধন দৌলত থাকলেই একটা সমাজ উন্নত হয় তাহলে বিশ্বের দরবারে সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে উন্নত দেশ বলা হতো৷ কিন্তু মজার বিষয় হলো এই দেশগুলো জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের তালিকায় তুলনামূলকভাবে নিচের দিকে। অথচ অনেক স্বল্প বা মধ্যম আয়ের দেশ সূচকের তালিকায় উপরের দিকে আছে। কারণ উন্নত দেশ বলতে আমরা বুঝি সে দেশগুলোকে- ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষা সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি- এর সব কিছু মিলিয়ে যারা উন্নত তাদেরকে।
মোটকথা, একটি সমাজের সার্বিক বিকাশে মাতৃভাষার চর্চা অপরিহার্য৷ একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ভাষা শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি কিংবা অর্থোপার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় নয়৷ মাতৃভাষা মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য৷ গান কবিতা সাহিত্যের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা, জ্ঞান ও মননের চর্চা করা, চিন্তার গভীরে প্রবেশ করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই৷ কাক যেমন পুচ্ছ ধারণ করলে ময়ূর হয়না, তেমনি বাঙালী যতই ইংরেজী-আরবি-হিন্দিতে ঘেউ ঘেউ করুক না কেন সেদেশী হতে পারবে না। যেমনটি কবি বলেছেন ‘বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি মনের আশা’।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালুর আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সঠিক লক্ষ্য ও সদিচ্ছা থাকার কারণে ভাষার রাজনৈতিক অধিকার অর্জিত হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সর্বস্তরে বাংলা এখনও চালু হয়নি। ১৯৯৯ সনে বাংলার স্বীকৃতি জুটেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হবার মাধ্যমে। সেই সুবাদে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর দাবি পর্যন্ত জানাতে দেরী ও দ্বিধা করেনি, যদিও নিজের দেশের ভেতরেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে এখনও সফল হয়নি৷ বাংলাদেশ হাইকোর্টের ভাষা সংক্রান্ত একাধিক সুপারিশ ও রায় থাকার পরেও এখনো সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায় নি৷ এত করে বোঝা যায়, বাঙালীর নজর মূলত পুরষ্কার, আত্মপ্রচার, আনুষ্ঠানিকতার দিকে বেশী, ২১র অঙ্গীকার অর্থাৎ সর্বস্তরে বাঙলা প্রতিষ্ঠায় নয়।
বাংলা কে পাস কাটিয়ে, বা অবহেলা করে উন্নয়নের চিন্তা করা জাতির জন্য বিপদজনক। মাতৃভাষা আমাদের পরিচয়। আমরা ইংরেজি বা যে কোন বিদেশী ভাষা বিরোধী নই। আমরা অন্যান্য ভাষাও ভালোভাবে রপ্ত করতে চাই কিন্তু ‘মাতৃভাষা আগে পরভাষা পরে’৷ পরিশেষে, যেমনটি দুঃখ করে বলেছেন কবি আব্দুল হাকিম “যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে জন কিসের জন্ম নির্ণয় ন জানি৷”
কুদরতে খোদা
মন্ট্রিয়ল, কানাডা।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
20-03-2019
-
-