অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
দোল দোল চিত্তে থইথই আনন্দ - খুরশীদ শাম্মী

“দোল দোল চিত্তে থইথই আনন্দ 
হই-চই কেটে যায় সময়
তবুও এগিয়ে চলি 
অজানা সুখের আশায়”

দোল দোল চিত্তে থইথই আনন্দ। হই-চই কেটে যায় সময়। নেই কোনো ভাবনা, নেই কোনো পিছুটান। আছে কেবল বাঁধন ছাড়া সুখ-সুখ তান। ধ্বনিত হয় না, ছোঁয়া যায় না, তবুও স্পন্দিত থাকে মন সর্বক্ষণ। অদৃশ্য পাখায় উড়ে উড়ে চলে। মতানৈক্যর ভয় নেই, বাঁকা প্রেমের প্রভাব নেই, নেই অদূর ভবিষ্যত নিয়ে ছুটোছুটি। এ এক অদ্ভুত অনুভবের সময়। 

কী দারুণ মানুষের শৈশব! 

প্রায় প্রতিটি মানব জীবনেই এই সময়টা থাকে এবং পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে দুর্লভ, দুস্পাপ্য, অতুলনীয় কিছু। স্মৃতিগুলো হৃদয়ের দেয়ালে ঝুলে থাকে এক একটি ক্যানভাস আকারে।

কঠিন বাস্তবতার কাছে হার মেনে আমরা অনেক সময় ভুলে থাকি শৈশব। সামাজিক দায়, পারিবারিক কর্তব্য ও কাজের ভিড়ে শৈশবের মধুর স্মৃতিগুলো ধুলো পড়ে আবছা হয়ে থাকে। আমরা ছুটে চলি সম্মুখের দিকে। আমাদের এই ছুটে চলা ট্রেন কিংবা প্লেনের গতির থেকেও বেগবান। ছোট্ট এক জীবন, অথচ সবার গন্তব্য সফলতার শীর্ষ। এর ব্যতিক্রম যেন আমরা কেউ-ই নই। কম বেশি সবাই ছুটে চলছি অদৃশ্য আলেয়ার খোঁজে। তবে মাঝেমাঝে কোনো দৃশ্য অথবা ঘটনা আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়।   
এমনই এক ঘটনার বর্ণনা করে এই ছবি তিনটি। এবার ফেব্রুয়ারিতে যখন বাংলাদেশে গেলাম, তখন নলছিটি উপজেলার কোনো এক গ্রামের এক গলিতে তুলেছিলাম এই ছবিগুলো। এই ছবির তিনজন নায়ক; নিলয়, নুদার ও মুন। তিনজন মামাতো ফুফাতো ভাই। তারা এখন পার করছে তাদের শৈশবকাল। তারা জানেনা, জীবনের এই সময়টা কত মূল্যবান! তবে তারা উপভোগ করছে জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পারিবারিক কারণে তারা তিনজন থাকে তিন শহরে। বেশ কিছুদিন পর তারা একত্রিত হয়েছে তাদের প্রিয় বোন ব্যস্ত’র দেশে বেড়াতে আসা কেন্দ্র করে। একত্রিত হওয়ায় তাদের আনন্দ আকাশ ছোঁয়া। আনন্দগুলো বিকশিত হচ্ছে তাদের কথায় ও কাজে। বড়দের সাথে কথা বলার ফুরসত নেই কোনো। সময় পার হয় তাদের কখনো উদ্দেশ্যহীন দৌড়ে, কখনো পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, আবার কখনো রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলে। উঁচুনিচু পথ কিংবা পড়ে থাকা ইটপাথরের স্তূপ দেখে দৌঁড়ানোর সুযোগ নেই একদম। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নাকে মুখে পানি গিলে খেলেও আনন্দ খুঁজে পায় সেখানে। রোদে পুড়ে সোনার দেহ অঙ্গার হলেও ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের কোনো। এখন সবকিছুই তাদের দৃষ্টিতে তাদের মতো নিষ্পাপ, নিখুঁত। এমন কি তাদের কথোপকথনগুলোও।

তাদের কথোপকথনগুলো কখনো এমনও শোনা যায়ঃ নুদার ভালোবাসে নিলয়কে বলছে, “নিলয়, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখা যাচ্ছে; মনে হয় তোমার চার্জ শেষ।” কিন্তু নিলয় ক্লান্তির ভার কাঁধে নিতে নারাজ। সে উত্তর দিচ্ছে, “না, ভাই। আমার এখনও দশটা-পাঁচটা চার্জ আছে।” আবার ওই নিলয় মুনকে প্রশ্ন করছে, “মুন ভাইয়া, তুমি বড় হয়ে কয়টা বিয়ে করবা?” মুন তৎক্ষণাৎ উত্তর দিচ্ছে, “দেখি, কয়টা করা যায়।”   

তাদের এই সব কথোপকথনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। নেই কোনো সীমা, পরিসীমা। তারা কী বলছে, কেন বলছে, তা তারা নিজেরাও জানে না। তবে এগুলো তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে এক শক্ত বন্ধন। পাশাপাশি তাদের হৃদয়ের হার্ড ড্রাইভে জমা হচ্ছে মধুর কিছু স্মৃতি।  

নিলয়, মুন ও নুদারের এমন থইথই আনন্দ দোল দেয় আমার মনেও। গত কয়েকদিন যাবত শৈশবের আবছা স্মৃতিগুলো আলোড়িত করে তুলছে আমার হৃদয়। খুব করে মনে পড়ছে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে চলা শৈশব স্মৃতিগুলো। তারা এখনও ঠিক সেদিনের মতো দোল শুরু করে, হোলি খেলার মতো রং ছিটিয়ে দেয় অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত। আমি ভেসে চলি আনন্দ জড়াজড়ি স্মৃতির ভেলায়। পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়ানো। আহা, কী মধুর ছিল দিনগুলো! ধানের ধুলোয় মাখামাখি, হাঁসমুরগির পেছনে খামোখা ছুটোছুটি, বরই গাছের চারপাশে ঘোরাঘুরি, গোল্লাছুট খেলার বাহানায় দৌঁড়ে বেড়ানো এ-বাড়ি ও-বাড়ি। সন্ধ্যা হলেই কড়া শাসনে গরম জলে হাত পা ধুয়ে, সরিষার তেল মেখে সোজা নানার তৈরি দশ ফুট বাই আট ফুট খাটে হারিকেনের আলোয় মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের সাথে ইট-কুড়ি বিট-কুড়ি কিংবা কাগজ কেটে চোর-পুলিশ-ডাকাত ইত্যাদি খেলা। মনে পড়লে এখনও অন্তরে যেন ফোঁটায় ফোঁটায় মধু ঝরে। 

তাছাড়াও, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল একটু ভিন্ন। বন্দি, বন্দি ভাব ছিল না তেমন। শৈশবের উদ্দেশ্যহীন টইটই ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে আজও আমি দিশেহারা হই। ন্যায় অন্যায় হিসেব জন্মেনি তখনও মনে। শুধু ইচ্ছের ওপর ভর করেই করেছি সবকিছু। ইচ্ছে হলে দৌড় দিয়েছি, গাছে চড়েছি, পুকুরে সাঁতার কেটেছি, খেলতে চলে গিয়েছি দূরের কোনো মাঠে। চুপ করে বসে থেকেছি পাল বাড়ির মূর্তি ঘরের দোরে। নিস্তব্ধতায় গালে হাত দিয়ে দীর্ঘক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেছি শূন্য থেকে একটু একটু করে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিমা তৈরির সবকিছু। তখন আশ্চর্য হয়েছি একটি কাঠের চাকায় ঘুরে ঘুরে মাটির বাসন তৈরি করতে দেখে, একজন মৃৎশিল্পীর হাতে নিখুঁত প্রতিমা তৈরি হতে দেখে, কিন্তু ভাবনা হয়নি তেমন। এখন বসে বসে ভাবি, কী যুক্তিহীন আমাদের বিশ্বাস! মানুষের সৃষ্টি একটি মূর্তিকে-ই-কি-না মানুষ দেবী বানিয়ে নতমাথায় হাত জোড় করে পূজা করে। একটু সুখ ও শান্তির নিশ্চয়তার লক্ষ্যে অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে কত না মিনতি করে। আবার অনেকে এর দ্বারা সামাজিক মর্যাদা সমৃদ্ধ করে।    

হ্যাঁ, কুমার বাড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করাই কি শুধু আমার স্মৃতি? না। তা হবে কেন? তবে ওই স্মৃতির সাথে যোগসূত্র তৈরি করেছে আমার বর্তমান ভাবনার বিষয়বস্তুগুলো। যা আমাকে টেনে নিয়ে যায় শৈশবের নিষ্পাপ দৃষ্টির কাছাকাছি এবং আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সহায়তা করে। 

আমি আশাবাদি, একদিন নিলয়, মুন, নুদারও তাদের শৈশবের অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে খুঁজে পাবে এমন কোনো স্মৃতি, যা উন্মুক্ত করে দেবে তাদের অন্তরদৃষ্টি। ওই স্মৃতির মাঝেই তারা খুঁজে পাবে সমাজের অযৌক্তিক দাবীর মুখোমুখি হয়ে তাদের মনে তখন জন্ম নেয়া কঠিন কোনো প্রশ্নের উত্তর। হয়তো  সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যাওয়ার আগেই তারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে সচরাচর নিয়মে পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তির লোভে ফাটল ধরা পারিবারিক সম্পর্ক।   

খুরশীদ শাম্মী 
টরন্টো, অন্টারিও  
মার্চ ৩১, ২০১৯