ইউরোপের পথে পথে (দুই) – দীপিকা ঘোষ
ইউরোপের পথে পথে (এক) পড়তে ক্লিক করুন
দুই
সকালের নরম রোদের ঝলমলে পরশ কেটে আইসল্যাণ্ডের রিকজাভিক-কেফলাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ন’টায় অবতরণ করলো ওয়াও এয়ারলাইনসের WW144 ফ্লাইট। আমাদের ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আবহাওয়ার কারণে সাত ঘন্টার বদলে সাড়ে সাত ঘন্টায় উড়ে এসে অবতরণ করেছে ww 144. উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপের যে কোনো দেশে যাতায়াতের জন্য এই রুট ইউরোপীয় যাত্রীদের সবচাইতে পছন্দের, বলেছিল কালকের তরুণ ট্যাক্সি ড্রাইভার, ফ্রেডরিক ওরফে ফ্রেড। বাস্তবেও দেখতে পেলাম, ৯৮% যাত্রীরাই ককেশিয়ান জনমানব। বাদবাকীদের নিরানব্বই জন চীনা জনগোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন। ফ্রেডের কথা মনে পড়তেই স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম, কেবল বন্ধুত্বের সারল্য থেকে নয়, ছেলেটি কাল অনর্গল কথা বলেছিল জগৎ জীবন সম্পর্কে তার ভূয়োদর্শী মানসিকতা থেকে। এই বয়সেই ভ্রমনবৃত্তান্ত সম্পর্কে একটি ছোট খাটো অভিজ্ঞান সে।
আটলান্টিকের অস্তিত্ব ছুঁয়েই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে কেফলাভিক বিমানবন্দর। অফিসিয়্যাল নাম, ‘রিকজাভিক-কেফলাভিক’। রিকজাভিক-কেফলাভিক, আইসল্যাণ্ডের প্রধান এবং বৃহত্তম ইন্টরন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। মূলত এখান থেকেই সিংহভাগ ফ্লাইটের আন্তর্জাতিক দুনিয়ার উদ্দেশে প্রতিদিন অভিযাত্রা। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে অফুরন্ত মহাসাগরের সবুজ নীল জলরাশি। সবুজের চিহ্ন যতটুকু রয়েছে তার সবই প্রায় ঘাস, মস, ছোট ছোট ঝোপঝাড়। তবে সবুজের এইটুকু অস্তিত্ব নাকি সর্বত্রই চোখে পড়ে না। পড়ে শুধু দেশটির দক্ষিণপশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে। বিমানবন্দর এবং তার আশেপাশে যতটুকু চোখে পড়ছে পাথুরে কালো অনুর্বর মাটি। চারপাশে বিবর্ণ হলদেটে ঘাস। সবকিছু দেখতেদেখতেই হঠাৎ মনে প্রশ্ন জেগে উঠলো–
আইসল্যাণ্ড যখন বরফে ঢাকা দ্বীপ নয়, তাহলে কেন একে আইসল্যাণ্ড বলে ডাকা হয়?
ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো, পেছনে রয়েছে এক আবশ্যিক ডিপ্লোম্যাসির কৌশলী চাতু্র্য। সবলের হাত থেকে রক্ষা পেতে যে চাতুরী নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সর্বদাই গ্রহণ করে দুর্বল। উদ্ভিদ থেকে জীবজগৎ সর্বত্রই এই নিয়ম, সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলছে।
আইসল্যাণ্ড নামকরণের ইতিহাস ঘিরে রয়েছে অনেক গল্পকথা আর অবিরাম ঘটনার স্রোত। খুব সংক্ষেপে সেটা বলতে গেলেও ফিরে যেতে হবে নবম শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে। যখন নরওয়ের সমুদ্র দস্যুরা এখানে আশ্রয় নেবার আগেই চল্লিশ হাজার বর্গমাইলের দ্বীপটিতে কয়েকজন আইরিশ সন্ন্যাসী এসে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তবে শুধু সমুদ্র দস্যুরা নয়, নবম শতকে পূর্ব ইউরোপের রাজ্য থেকে অনেক ছোট ছোট রাজা আর জমিদাররাও শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছিলেন উত্তর আটলান্টিকের এই দ্বীপটিতে। ১৬০ থেকে ১৮০ লক্ষ বছর আগে সমুদ্র গর্ভ থেকে অনেকগুলো ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে এর ভৌগলিক চেহারা জন্ম নেবার পর, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আইসল্যাণ্ড ছিল জনমানবহীন। পাহাড়, ঝর্ণা, উপত্যকাবোঝাই দ্বীপটি কোনোদিনই অরণ্যপরিবেষ্টিত সবুজ ভূখণ্ড ছিল না। বৃক্ষ বলতে ছিল ছড়ানো ছিটানো দু’ চারটি বার্চ আর কিছু উইলো। তবে গ্রীনল্যাণ্ডের মতো আইসল্যাণ্ডের সিংহভাগ জায়গা কোনোদিন বরফে আচ্ছাদিতও ছিল না। জনবসতিহীন দ্বীপে প্রথমদিকে যারা এসেছিল তাদের সব রকম ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল অফুরন্ত। ছিল অঢেল ভূমিসম্পদ। নির্ভয়ে অবাধ বিচরণের জায়গা।
তাই শত্রুরা যাতে এই দ্বীপ কখনো আক্রমণ না করে সেজন্য দ্বীপে আশ্রয়গ্রহণকারী মানুষগুলো আগে ভাগেই শত্রুরাজ্যে লোক পাঠিয়ে রটিয়ে দিয়েছিলেন-
দ্বীপটি সম্পূর্ণ তুষারাবৃত এক অনুর্বর ভূখণ্ড। প্রচণ্ড শীতের কারণে এখানকার আবহাওয়া প্রতিকূল! বরফে আচ্ছাদিত দ্বীপটি সম্পূর্ণ সবুজবৃক্ষহীন। বরং অনেক দূরে আরও একটি বিশাল আয়তনের ভূখণ্ড রয়েছে। যা সবুজ অরণ্যে পরিপূর্ণ এবং সবদিক থেকেই জন বসবাসের জন্য যথার্থ উপযুক্ত।
সেই থেকে গ্রীনল্যাণ্ড ৮০% তুষারাবৃত হয়েও সবুজ ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত। ওদিকে মাত্র ১১.৫% জায়গা বরফে ঢাকা সত্ত্বেও আইসল্যাণ্ড আজ অবধি বরফের দেশ হিসেবেই আখ্যায়িত।
লাউঞ্জে ঢুকেই খাদ্যের অনুসন্ধানে ছুটতে হলো। প্লেনের অভ্যন্তরে খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় দীর্ঘ বারো-তেরো ঘন্টার ক্ষিধেটা বেশ জোরেশোরে জানান দিতে শুরু করেছিল। প্লেনে এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। সময় পেরিয়ে সকাল এগারোটার কাঁটা ছুঁইছুঁই করছে প্রায়। ব্রেকফাস্টের সময় অতিক্রান্ত। অতএব খাবার দোকানে গিয়ে ব্রাঞ্চের জন্যই মেন্যু পছন্দ করতে হলো। বেশিরভাগ ডিশই ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরী। আগেই জানা ছিল, আইসল্যাণ্ডারদের রান্নাবান্নার ধরণ আমাদের জন্য রুচিকর নয়। চর্মচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করেও সেই রকমই প্রত্যয় হলো। সাবধানে নির্বাচন করতে গিয়ে খাদ্যতালিকায় এলো- ঝাল চিজ ফ্রাই, ভেজিটেবল স্যাণ্ডউইচ আর চকোলেট কেক। পানীয় হিসেবে ঝকঝকে বোতলে ঝর্ণার জল।
খেতে খেতে সহসা বাম দিকের দৃশ্যপটে আটকে গেলো চোখজোড়া। চারটে চেয়ার পাতা টেবিলের ওপর হাত রেখে একজন খাঁটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত চেহারার তরুণ ভদ্রলোক চুপচাপ বসে। তার দৃষ্টি সম্ভবত সোজাসুজি সামনের দিকে প্রসারিত। অনেক লম্বা আর মেদহীন ছিমছাম শরীর। ডান হাতে রূপোর পাতের বালা। খাড়া নাকের ওপর আঁটোসাঁটো স্লিম স্নানগ্লাস। মুখের ওপর ঈষৎ হাসির দীপ্তি ছড়ানো। সানগ্লাসের অন্তরাল ভেদ করে চোখের নিশানা আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না। আশেপাশে নজর ফেলে কাউকে দেখতে না পেয়ে তাই নিশ্চিত হয়ে কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
আচ্ছা, ভদ্রলোক আমাদের চেনেন নাকি গো? এদিকে তাকিয়ে হাসছেন কেন ওভাবে?
কী করে চিনবেন? আমরা ওকে চিনি?
এছাড়া অন্য কারণ আর কী থাকতে পারে?
অত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। হয়তো স্বজাতি দেখে মনে মনে খুশি হয়েছেন, তাই হাসছেন। আমরা ছাড়া বাদামী চামড়ার আর কেউ তো নেই এখানে।
লাউঞ্জের এদিকটায় সর্বত্র সানরুফ থাকায় সূর্য নরম সোনা রোদ ছড়িয়েছে। তার পরশ লেগেছে আমাদের শরীর জুড়ে। তরুণের মাথার ওপর। তেরছাভাবে হাতের পাতায়। প্লেনে বসেই শুনে এসেছিলাম, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রোদের উষ্ণতা ভালো লাগছিল তাই। এতক্ষণে মনোযোগ দিতেই চোখে পড়লো অন্য খাবার নয়, ভদ্রলোক বোতল থেকে বিয়ার ঢেলে খাচ্ছেন। ঘোষ কথা বললো-
আরও দুটো জলের বোতল নিয়ে এসো। হোটেলে যাওয়ার পথে দরকার হবে।
উঠে গিয়ে খাবার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আগের ছেলেমেয়ে দুটো খরিদ্দারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ততোক্ষণে চোখ রেখেছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। অনেক সময় ধরে এক প্রৌঢ় চীনা দম্পতি কাচের স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে ঘুরে ঘুরে সাজানো খাবার দেখছিলেন। হঠাৎ ভদ্রমহিলা অসন্তোষ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা উচ্চারণ করলেন স্বামীকে উদ্দেশ্য করে। ভদ্রলোক উত্তরে কী বললেন জানি না। কিন্তু তার মুখেও গাম্ভীর্যের রেখা ছড়ালো। এরপরেই সহসা তিনি অসতর্কভাবে ইংরেজিতে বলে উঠলেন-
কিন্তু আমি অনেক ক্ষুধার্ত জেনিভিব! সর্বদা অত হিসেব করলে চলবে না!
জেনিভিব জবাবে ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে হিসহিস করলেন দু’বার। আমার মুখে বিরক্তি নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি ছুঁড়লেন। সম্ভবত এত ব্যক্তিগত বিষয়টা শুনে ফেলেছি বলেই তার মুখের ওপর অন্ধকারের পর্দা ছড়ালো। আইসল্যাণ্ড ইউরোপের সবচাইতে ব্যয়বহুল দেশ। গ্রোসারি থেকে ট্রান্সপোর্টেশন, রেস্টুর্যান্ট থেকে ইউটিলিটি, সবক্ষেত্রেই অগ্নিমূল্য। বিশ্বের ব্যয়বহুল দেশের তালিকায় এর অবস্থান আপাতত চার নম্বরে।
ট্রাভেল গাইড বুক দেখে দর্শনযোগ্য আকর্ষণীয় স্থানগুলো অনেক আগেই স্থির করা ছিল। তবে কিনা একদিন পরেই লণ্ডন অভিমুখে উড়ে যাওয়ার কারণে সময় বড় সংক্ষিপ্ত। অনেকগুলো ট্যুরিস্ট স্পট থেকে তাই বেছে নেয়া হলো, আইসল্যাণ্ডারদের ভাষায় ‘গালফস’কে। অর্থাৎ সোনালি জলের ঝর্ণাকে। যাই হোক, খাওয়া শেষে এয়ারপোর্টের মানি একচেঞ্জ অফিসে ছুটতে হলো দ্রুত পায়ে। ট্যুরিজম কোম্পানিগুলো, ইউরো কিংবা ইউ এস ডলার গ্রহণ করলেও আইসল্যাণ্ডের সব জায়গাতেই এই পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয়রা সাধারণত ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলেও অফিসিয়্যালি আইসল্যাণ্ডিক কারেন্সি (আইসল্যাণ্ডিক ক্রোনা)ব্যবহারের প্রয়োজন বহুক্ষেত্রেই পড়ে।
কারেন্সি একচেঞ্জ অফিসের দায়িত্ব যিনি সামলাচ্ছেন তিনি কার্যক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। বয়সে যথেষ্ট প্রবীনা। নাম দেখলাম, আর্ডিস। ঘোষ সহজেই অন্তরঙ্গ আচরণে সম্পর্ক গড়ে তুলতে জানে। কয়েক মিনিটের আলাপনে এখানেও সেটা হলো। ‘গালফস’ দেখতে আগ্রহী জেনে প্রথমেই তিনি জানতে চাইলেন-
প্যাকেজ ট্যুরে যাচ্ছো, নাকি ইনডিপেন্ডেন্টলি?
ব্যক্তিগতভাবে।
ঘোষের সংক্ষিপ্ত জবাব শুনে ভাবনার গভীরে ডুব দিলেন আর্ডিস-
তোমরা একেবারেই নতুন এখানে। স্থানীয় কারুর সঙ্গে যেতে পারলে সব দিক থেকেই সুবিধে হবে।
কিন্তু আমরা তো কাউকে চিনি না।
আমার এক বন্ধু আছেন, আমার মতোই বহু বছর আমেরিকায় কাটিয়ে এসেছেন। মাঝে মধ্যে ইউ এস থেকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে যেতে চাইলে স্টিফেন তাদের সাহায্য করেন।
সে রকম হলে তো ভীষণ ভালো হয়!
আচ্ছা ফোন করে দেখছি।
সৌভাগ্যবশত স্টিফেনকে পাওয়া গেলো এবং আর্ডিসের অনুরোধে রাজিও হলেন। কৃতজ্ঞতা জানাতে বললাম-
ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ! এরপরে আমেরিকায় কখনো এলে অবশ্যই আসবেন আমাদের দেখতে! অপেক্ষা করবো কিন্তু!
উত্তরে আর্ডিস স্মিত হাসলেন-
নিশ্চয়ই। আমি এখনো আমেরিকার প্রেমে পড়ে আছি!
ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে কার্ড বার করে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো-
ফোনে যোগাযোগ হবে আশা করি।
নিশ্চয়ই। কেন নয়? আর্ডিস তার সুগঠিত দাঁতে পুনর্বার হাসলেন।
হোটেলে যেতে যেতে ঈশ্বরের করুণার ধারায় ভেসে গেলো অন্তর। মন বললো-
তিনি যদি কৃপা করে সৌভাগ্যের ডালি না সাজাতেন এমন অসম্ভব ঘটনার জন্ম কি হতো কোনোদিনও? তাঁর অদৃশ্য হাতের স্পর্শেই না জগৎ জুড়ে ঘটনা ঘটে! অবশ্য সব ঘটনাই সৌভাগ্য বয়ে আনে না। দুঃখের স্রোতেও ভাসিয়ে দেয়! কিন্তু তারও নিশ্চয়ই কারণ থাকে। চলবে…
দীপিকা ঘোষ
ওহাইয়ো, আমেরিকা।
-
গ্রন্থালোচনা // ভ্রমণ
-
22-04-2019
-
-