ইলোরায় বইমেলা - ফরিদ তালুকদার
নাম শুনে হয়তো প্রথমেই ধারণা হতে পারে এটি দক্ষিণ ভারতের সেই বিখ্যাত অজন্তা – ইলোরা। কিন্তু না। এই ইলোরা টরোন্টোর উপকন্ঠে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তর - পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট সুন্দর শহর। তবে নামকরণের দিক থেকে ভারতের ইলোরার সাথে এর একটি রেখায় মিল আছে। ১৮৩২ সালে স্কটিশ নাবিক মিঃ উইলিয়াম গিলকিছন প্রথম এই স্হানে পত্তনি গাড়েন। মিঃ উইলিয়াম গিলকিছন এর আদিবাস ছিলো স্কটল্যান্ডের আরভাইন আয়ারশায়ারে। ফলে প্রথমে এর নাম হয় আরভাইন সেটেলমেন্ট। পরে ১৮৩৯ সালে যখন এখানে প্রথম পোস্ট অফিস স্হাপিত হয় তখন এই গ্রামের পুনরায় নাম দেয়া হয় “ ইলোরা”। মিঃ উইলিয়ামের ভাইয়ের জাহাজের নাম ছিলো ইলোরা। ভারতের ইলোরা গুহার নামে উদ্বুদ্ধ হয়ে ই মিঃ উইলিয়ামের ভাই তার জাহাজটির নাম রাখেন। মিঃ উইলিয়াম সেই নামেই তার নূতন পত্তনির নামকরণ করেন।
প্রতিবছর মে মাসের প্রথম সাপ্তাহিক ছুটির সন্ধ্যা এবং পরবর্তী দু’দিন ( শুক্রবার সন্ধ্যা এবং শনি ও রোববার ) এ শহরে একটি চমৎকার বইমেলার আয়োজন হয়। এবছরে তাই এটি ছিলো মে ৩ থেকে মে ৫ পর্যন্ত। প্রায় সব রুচির পাঠকের চাহিদা মেটাতে সিডি, ডিভিডি সহ ৭০ হাজারের মত বইয়ের সমারোহ থাকে এই মেলায়। না, তবে একেবারে নূতন প্রকাশিত কোন বই এখানে পাওয়া যায় না। তাই এটিকে পুরনো বইয়ের ( একখানা ভাল বই কখনো পুরনো হয় না ) মিলন মেলাও বলা যেতে পারে। কিছু স্বেচ্ছাসেবক সারাবছর ধরে বিভিন্ন দাতাদের কাছ থেকে বইগুলো সংগ্রহ করে সাংগঠনিক অফিসে জমা করে। পুরনো বইয়ের মেলা হলেও মেলাটি ঘুরে মনে হয়েছে এটি খুবই সমৃদ্ধ একটি মেলা। এখানে হোমারের ‘ইলিয়াড ওডিসি’ (Iliad and Odyssey by Homer ), ভারজিলের ‘ওনিড’ ( Aeneid, by Virgil ) থেকে শুরু করে ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ ( Rubaiyat by Omar Khayyam ), প্রায় সাম্প্রতিক ড্যান ব্রাউনের ‘দ্যা ভিঞ্চি কোড’ ( The Vinci Code, by Dan Brown ) এর মত বইও যেমন দেখেছি তেমনি রান্না, বাগান করা, স্বাস্থ্য, আধ্যাত্ম, ইতিহাস, জীবন বৃত্তান্ত, ফিকশন এবং আরও অনেক বিষয়ের উপরও বই আছে। প্রতিটা বইয়ের মূল্য ১ থেকে ৩ ডলারের মধ্যে। যে বইগুলো আমাজন বা অন্য কোন বিক্রেতার কাছ থেকে শুধু পেপার ব্যাক কপি কিনতেই লাগে ১৫ থেকে ২৫ ডলারের মত। শিপিং খরচ সহ হয়তো আরও বেশী। সুতরাং এটি শুধু সমৃদ্ধ মেলাই নয় পড়ুয়া পাঠকদের জন্যে একটি সাশ্রয়ী মেলাও বটে।
কোবো ( Kobo ), কিন্ডল ( Kindle ) এবং আরও অনেক ইলেকট্রনিক / অনলাইন মাধ্যমের প্রতাপে হার্ড কপি বইয়ের পাবলিশিং শিল্প এখন তো প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি। কিছু বয়স্ক পাঠক, যারা এখনো পাঠের এই নূতন মাধ্যমের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তাদের জন্যে ই হয়তো এই শিল্প কোনভাবে ধুকে ধুকে টিকে আছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একাডেমিক পাঠ্য বিষয়ের বইগুলোও আর হার্ড কপিতে নেই। শুধু যে মিডিয়া আগ্রাসন তাই নয়। সিলেবাস বইয়ের বাইরে জীবনের অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন কিংবা সুস্থ বিনোদনের জন্যে বই পাঠের পাঠকের সংখ্যা ও প্রায় বিলুপ্তির পথে। কারণ কি? নিশ্চয়ই একটা নয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া সহ আর্থ সামাজিক অবস্হার পরিবর্তন, আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং আরও অনেক কিছুই এই তালিকার আওতায় পড়ে। এক কথায় আবারও বলতে হয় সেই বিবর্তন। বিবর্তন অবশ্যম্ভাবি। কিন্তু এই বিবর্তনের গতিপথ নির্ধারণের নিয়ামক গুলো কি? বিরূপ প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজন থেকেই আমাদের আদি পুরুষদের মাঝে প্রথম বিবর্তনের ধারা শুরু হয় বলে ধরে নেয়া যায়। বিবর্তনের সেই প্রথম পদক্ষেপ হয়তো শুধু শারীরিক গঠন পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ক্ষমতা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ এবং আরও পরে মুদ্রা প্রথা চালু হয়ে গেলে অর্থ স্বার্থের মত বিষয়গুলোও বিবর্তনের গতিপথ নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। যার প্রভাব আমাদের সমাজ জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবন, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকদের মন মানষিকতায় ও নিয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে সমাজ দর্শনের জঙ্গল পথে হারিয়ে যাবার অভিপ্রায় এই মুহূর্তে আমার নেই। সুতরাং প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বর্তমান সময়ে আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পেছনে লক্ষ্যের তীরটা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকেই তাক করা থাকে। আমার সন্তান ৯৫% এর উপরে কিংবা গোল্ডেন জিপিএ পেল কিনা, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার কিংবা ইন্জিনিয়ারিং ডিগ্রী এর সাথে এম বি এ টা যুক্ত করার সঠিক পথে তার জীবন গাড়ী চলছে কিনা এটাই শুধু মুখ্য উদ্দেশ্য। বাকী সব গোল্লায় যাক। খেয়ে না খেয়ে শুধু এটা হাসিল করার জন্যে ই তাকে পাঁচটা টিউটরের কাছে ছুটানো হয় এবং শুধুমাত্র এ উদ্দেশ্য সফল হলেই সমাজ, আত্মীয় স্বজন সবার কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা সু সন্তানের বাবা মা। বাকী কিছু না। আমাদের সন্তানের পরোপকারী মানসিকতা আছে কিনা, পড়াশুনায় খুব ভালো না হলেও সে জীবনের অন্য সব বিষয়ে সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল কিনা, যার পেছনে আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ত ছোটাচ্ছি এটা তার ভালো লাগছে কিনা, এর জন্যে সে মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে কিনা… কে এগুলোর তোয়াক্কা করে?
লেখা পড়া শেখার পেছনে ব্যক্তি জীবনে সফলতার উদ্দেশ্য আগেও ছিলো। এটা নূতন কিছু নয়। কিন্তু কয়েক দশক পূর্বে ও এই সফলতার সাথে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন এবং একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ইচ্ছার একটা ভারসাম্য অবস্থান ছিলো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মানস জগতে অর্থনৈতিক সফলতার ইচ্ছাটা অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে এর টিপিং পয়েন্টে ( Tipping Point ) পৌঁছে গেছে। এর জন্যে কারোর প্রতি ই নির্দিষ্ট করে আঙুল তোলা যায় না। দিনে দিনে আমাদের সার্বিক সমাজ ব্যবস্হাকেই আমরা এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছা পোষণ কারি ছাত্র ছাত্রীদেরকে মোটামুটি মানের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিপ্লোমা প্রদানকারী কলেজে ভর্তি হতে ন্যূনতম ৮০% মার্ক পেতে হয়। একজন সাধারণ মেধার ছাত্র ছাত্রীর পক্ষে যা অর্জন করা অতটা সহজ ব্যাপার নয়। যার ফলে শুধু সিলেবাস নির্ধারিত অক্ষরের মাঝেই তাদেরকে মুখ গুঁজে থাকতে হয় দিন রাতের বেশীর ভাগ সময়। তার উপর আছে অনলাইন মিডিয়ার চাকচিক্যের প্রভাব। বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো। যদিও অতি প্রয়োজনীয় এ বিষয়টা এখন সেল ফোনের কিবোর্ডের মাধ্যমেই সেরে ফেলে অনেকে (!)।
সুতরাং অন্য বই পড়ার সময় কই? বছরখানেক আগে বি বি সি ( B B C ) এর একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম চীনে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তির জন্যে দেশ ব্যাপী যে পরীক্ষাটা হয় “গাওকাও” নামের সেই পরীক্ষার আগে অনেক বাবা মা তাদের সন্তানদের শরীরে স্টেরয়েড ইনজেকশন পুশ করেন যাতে করে তারা ১৭/১৮ ঘন্টা পড়াশুনা করতে পারে! পৃথিবীটাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? ভাগ্যিস দিন রাতের ২৪ ঘন্টাটাকে তারা বাড়িয়ে ২৫ ঘন্টা করতে পারেনি। তাদের মত যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মোহে নেশাগ্রস্ত তারাও অর্থ দিয়ে অনেক কিছু করে ফেললেও সময়টাকে এখনো বশে আনতে পারেনি বলে আপাতঃ রক্ষা। সর্বোপরি মার্কস নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্হার এই দৌড়ে হয়তো একসময়ে বেশীর ভাগ ছাত্র ছাত্রীই ৯০, ১০০ পেতে সক্ষম হতে পারে কিন্তু তাতে কি প্রকৃত সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা আছে?
“বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না”। একেবারে খাঁটি কথা। ‘বই চুরি করেও হয়তো কেউ চোর হয়না’ যদি ঐ মহান চোর বইটি পড়েন! আমি অবশ্য আজন্ম দেউলিয়া হয়েও বই কিনি। খুব খারাপ অভ্যাস বলা যাবেনা! তবে বই পড়ার ব্যাপারে আমার অভ্যাসটা একরকম ভানুর চুটকির অর্ধেকাংশ। তার রম্য কথোপকথনের একটা পর্বে ভানু বাবু বলেন ‘আমার ঘরে বইয়ের বড় একটা লাইব্রেরী আছে কিন্তু সেখানে কাউকে ঢুকতেও দেইনা আর আমি নিজেও পড়িনা'! বড় না হলেও আমাদের ঘরে বইয়ের ছোট একটা সংগ্রহ আছে। সে বই পড়তে কারোর জন্যে কোন নিষেধ না থাকলেও আমি নিজে বলা যায় মোটেই পড়িনা। সুতরাং ভানু বাবুর সাথে অর্ধেক মিল। তবে তফাৎ হলো ভানু বাবুর ক্ষেত্রে বিষয়টা শুধু রস সৃষ্টির জন্যে কথার কথা আর সেক্ষেত্রে আমারটা নির্ভেজাল সত্য! দুঃখের কথা..!!
তারপরও বই কিনি। ভালো বইয়ের কথা শুনলে সংগ্রহে রাখতে মন চায়। কেউ যদি কখনো রঙিন পৃথিবীর আকর্ষণে ক্লান্ত হয়ে পাওলো কোয়েলহো এর ‘দি আলকেমিস্ট’ ( The Alchemist by Paulo Coelho ) কিংবা আমাদের শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ এর সাদা কালো পাতায় একবার চোখ বুলায়..!!
ফরিদ তালুকদার
টরোন্টো, কানাডা।
মে ৯, ২০১৯
-
নিবন্ধ // মতামত
-
09-05-2019
-
-