অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ফেলে আসা দিনগুলি (পঞ্চম পর্ব) – হুমায়ুন কবির

    রাবেয়া খালার বিয়ের দিনটির কথা খুব মনে পরে। চয়নের নানা বাড়িটা তৃতীয় তলা ইটের তৈরী দালান।  সম্পূর্ণ বাড়িটাই আধুনিকতার সবটুকু দিয়ে সাজানো হয়েছে।
     হরেক রকমের বিদ্যুৎ বাতি আর রং-বেরঙের ঝালোর দিয়ে বিয়ে বাড়ি আরো বেশি সাজিয়ে রঙিন করা হয়েছে। সেদিন ছিলো চাঁদনি রাত। চাঁদের  নরম আলো আর বাহারী আলোক সজ্জার আলোতে বাড়িটা ঝলমল করছে।
     সম্পুর্ন ছাদটাই অতিথি ও বর পক্ষের জন্য তৈরী করা। বরের আসোন, কনের আসোন ও গায়ে হলুদের আসোন অপূর্ব করে সাজানো। গায়ে হলুদের পর চয়ন রাবেয়া খালার পাশেই বসে ছিলো ।
     রাবেয়া খালা পরেছে  চওড়া লাল রঙের পারের হলুদ শাড়ি। গাদা ফুলের গহনার সাজে খালাকে পরির মতো লাগছে। ঠিক যেন একটা পরি। পথ ভুল করে এই বাড়িতে চলে এসেছে।  যার সংগে বিয়ে হবে  তিনি একজন চিকিৎসক। নাম ফাহিম হোসেন। ফাহিম হোসেন স্থায়ীভাবে আমেরিকার আটলান্টাতে বাস করেন। ওখনে নিজের বাড়ি আছে। গ্রামের বাড়ি নড়াইল। চিত্রা নদীর পারে। বিয়ের পর রাবেয়া খালাও আটলান্টাতে চলে যাবে।
     চয়ন রাবেয়া খালার পাশেই শুয়ে পড়লো। খালা বললেন, 
     -কিরে, তোর ঘুম পাচ্ছে?  
     -না খালা, এমনিতেই। তোমার জন্য মনটা কেমন করছে। তুমি না থাকলে এই বাড়িতে আমার একদম ভালো লাগবেনা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি খালা।
     রাবেয়া চয়নের কপালে হাত রাখলো। রাবেয়া খালা কাদছে।
     -খালা, তুমি কাদছো? 
     -তোদের ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে। তুই কিন্ত মন খারাপ করবিনা। মন দিয়ে লেখা-পড়া করবি। আমি তোর জন্য অনেক অনেক চকলেট, গল্পের বই, ছবি আকার খাতা আর রঙ পেনছিল পাঠাবো।
     -আমার কিছু লাগবেনা খালা। শুধু তুমি ভালো থেকো। তাতেই আমি খুশি থাকবো।
     রাবেয়া খালা এবার শব্দ করেই কান্না করছে। এতো ছোটো একজন মানুষ। কিন্ত হৃদয়টা যেনো গভীর সমুদ্র! রাবেয়া খালা চয়নের কপালে চুমু খেলো। তারপর বললো, 
     -এতো নরম মন তোর! এই সমাজ ও সমাজের মানুষগুলো খুবই নিসঠুর, নির্দয়। এতো নরম মন নিয়ে এখানে তুই টিকতে পারবিনা। তোকে আরো অনেক অনেক শক্ত হতে হবে। নইলে বাচবি কেমন করে?

     রাবেয়া খলার বিয়ের পনেরো দিন পরই ফাহিম খালু আটলান্টাতে চলে গেলো।  প্রতিদিনই ফাহিম খালু রাবেয়া খালাকে ফোন করে। ফাহিম খালুর সঙ্গে কথা বলে বলে রাবেয়া খালার সময় ভালোই কাটছিলো।
     অল্প দিন পরই ফোন আসা কমতে থাকে। মাঝে মাঝে ফোন আসলেও কথা খুব কম হয়। বিভিন্ন ব্যস্ততা দেখিয়ে ফাহিম খালু রাবেয়া খালাকে এড়িয়ে চলার চেস্টা করছিলো।  প্রথম দিকে রাবেয়া খালা ব্যাপারটা আমোলে না নিলেও আস্তে কেমন যেনো সন্দেহ হতে থাকে। রাবেয়া খালা ফোন করলেও রিসিভ হয়না। একদিন ছুটির দিনে রাবেয়া খালা ফাহিম খালুকে ফোন করলো। ফোন রিসিভও হলো। তবে অপর প্রান্তে ফাহিম খালু না, একজন বিদেশিনী মহিলা। খুব চেস্টা করে বাংলায় কথা বলছে। রাবেয়া খালা জানতে চাইলো, 
     -কে বলছেন?
     -এলিনা বলছি।
     -কে আপনি? 
     -আমি মিসেস ফাহিম। আপনি কে?

     রাবেয়া খালা বাজ পরার মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো। কোন উত্তর না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলো। কাপা কাপা হাতে রিসিভার রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো। আলো অফ করে দিয়ে জানালা খুলে দিলো। এ কি করে সম্ভব! ফাহিম আটলান্টা বিবাহিত স্ত্রী রেখে আমাকে বিয়ে করেছে! অতচ যেদিন রাবেয়া খালা, ফাহিম খালুকে বলেছিলো,
     -এমন হয়না, আমার প্রানটা তোমার প্রান হয়ে যাবে আর তোমার  প্রানটা আমার  প্রান?
     ফাহিম খালু অবাক বিস্ময় ভরা চোখে রাবেয়া খলার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর সদ্য মেহেদীর রঙে রাঙানো কাকন পরা হাত দুটি নিজের দুহাত দিয়ে মোলায়েম করে চাপ দিতে দিতে বললো, 
     -কে বলেছে হয়না! এইতো তোমার প্রানটা আমার প্রান হয়ে গেলো আর আমার প্রানটা তোমার প্রান!
     আনন্দ আর ভালো লাগায় রাবেয়া খালার দুই চোখ দিয়ে আনন্দ ধারার মতো পানি গড়িয়ে দুগাল বেয়ে বুক ভিজিয়ে দিতে থাকলো। আজকেও রাবেয়া খালা ফুপিয়ে ফুপিয়ে  কাদছে। তবে আনন্দ নয় বেদনায়! গভীর বেদনায়!
     চয়ন যখন রাবেয়া খালার আনন্দ দেখেছে তখন ভালো লাগায় মন প্রান ভরে গেছে।  আবার যখন কষ্টে কান্না করতে দেখেছে, তখন বেদনার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। এই সমাজে একজন মেয়ে-যে কতোটা অসহায় তা রাবেয়া খালাকে দেখেই অনুধাবন করতে পেরেছে!
     চয়ন এখনো চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পায় রাবেয়া খালার বলা সেই কথাগুলো, 
     "তুই মন খারাপ করবিনা। মন দিয়ে লেখা পড়া করবি। আমি তোকে অনেক অনেক চকলেট, গল্পের বই, ছবি আকার খাতা আর রঙ পেন্সিল পাঠাবো"।

********

     চয়নদের বাসায় সপ্নিল বলে একটা ছেলে প্রায়ই আসতো। ছেলেটি শারিরীক  প্রতিবন্দি। চয়নের মা'কে নানি আর চয়নের বাবাকে নানা বলে ডাকে। এমনিতেই সপ্নিল সবকিছুই বুঝে। তবে কথা খানিকটা জড়িয়ে যায়। চয়নদের বাসায় এলে চয়নের মা খুব যত্ন করে খেতে দেয় এবং আদরও করে। চয়নও সপ্নিলকে মামা বলে ডাকে। সপ্নিল খুব ভালো পরিবারের ছেলে। জন্মের সময় নার্সের ভুল সিদ্ধান্তের কারনে সুন্দর একটা জীবন শুধু নস্ট হয়েই যায়নি; পরিবার ও পরিবারের বাইরে সমস্ত জায়গায়ই আজ অপমানিতো ও অবাঞ্ছিতো। এই দায় সপ্নিলের না। তারপরও সব কস্ট আর অসম্মান সপ্নিলের এখন নিত্যদিনের সঙ্গি। 
     চয়ন, মায়ের কাছ থেকে জেনেছে যে, জন্মের পর নার্স যে ইনজেকশন শিশুকে দেয়া হবে; সেটা ভুল করে মা'কে আর মায়েরটা শিশুকে দিয়ে দেয়। আর এই কারনেই সপ্নিলের আজ এই অভিশপ্ত জীবন। সপ্নিলকে দেখলে কোন ভাবেই বুঝার উপায় নেই যে, সপ্নিল এই পরিবারের ছেলে। মানুষ বাড়ির কাজের ছেলেকেও আরেকটু ভালোভাবে বাচতে সাহায্য করে। কিন্ত সপ্নিলের পরিবার ,সপ্নিলের সঙ্গে সেটা করেনা। কেন? সপ্নিলের কি দায়?  সপ্নিল নিজে কাজ করে নিজের পেটের খাবার যোগার করে। কাজ বলতে কেউ যদি দয়া করে কোন কাজ দেয় তবেই আর কি। 
     সপ্নিলের বাবা নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। সপ্নিলের ছোট আরও দুটি ভাই ও একটি বোন আছে। সপ্নিলের বাবা মারা যাওয়ার পর সপ্নিলরা নানা বাড়িতেই থাকে। বাবা থাকলে হয়ত সপ্নিলকে অন্যের দায় এভাবে বয়ে বেড়াতে হতো না। বাবা নিশ্চয়ই কিছুটা দায় বহন করতেন। এটাও সপ্নিলের জন্য আরও একটা দূরভাগ্যের কারণ। সপ্নিল হয়ত কতো কি বলতে চায়, কিন্ত কিছুই বলা হয়না। বলতে পারে না। আর বলেই কি হবে! কে শুনবে সপ্নিলের কথা? কে বুঝবে সপ্নিলকে? কেউ কি আছেন? নেই। থাকবেওনা।
     চয়ন শুধু ভাবে,
     -আহা! আমার যদি তেমন ক্ষমতা থাকতো তাহলে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিবন্দি শিশুদের দায়িত্ত আমি নিতাম। আর নির্যাতিত নারীদের জন্য তৈরী করতাম অবারিত সুন্দর ও শান্তির আশ্রম!
     কিন্ত চয়ন শুধু ভাবতেই থাকবে। কিছুই করা হবেনা অসহায়দের জন্যে। তবুও চেস্টা করে যাচ্ছে। সপ্ন দেখে যাচ্ছে। সপ্ন দেখতেতো আর বারন নেই!
     সপ্নিলের কথা মনে হলে চয়ন দেখতে পায়  হাত ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে এই সমাজটাকে পাশ কাটিয়ে একটা নিস্পাপ অসম্ভব সুন্দর কিশোর বয়সী ছেলে এগিয়ে চলছে। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে। চলবে...

হুমায়ুন কবির
ঢাকা, বাংলাদেশ।