ইউরোপের পথে পথে (পাঁচ) – দীপিকা ঘোষ
প্রায় এক ডজন সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম ওপরে। অফিসের সময় না হলেও চারপাশে উপচে পড়ছে যাত্রীদের ভিড়। আধুনিক মানুষের ব্যস্তময় জীবনের একটি খণ্ডচিত্র তাতে মুহূর্তেই উদঘাটিত হলো চোখের সামনে। এরপর সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নিচে নেমে আসতে চোখে পড়লো, TVM (টিকেট ভেন্ডিং মেশিন) মেশিন থেকে যাত্রীরা টিকেট সংগ্রহ করছে। অনেকে মেট্রো পাস, সামনের চেকিং মেশিনে স্পর্শ করে ভেতরে প্রবেশের ছাড়পত্র পাচ্ছে। আশেপাশে কোনো ব্যক্তি টিকেট চেকারের অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না। মেশিনই এখানে টিকেট সিস্টেম পরিচালনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মরত। অর্থাৎ মানুষ টিকেট চেকারের প্রতিনিধিত্ব করছে ইলেকট্রনিক যন্ত্র। যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা ক্রমাগতই বাড়ছে। কারণ এরা নাকি মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত আর নির্ভুলভাবে কর্তব্য পালন করতে সক্ষম। চেকিং মেশিন কমিউটার পাস এবং ম্যাগনেটিক টিকেট, দু ধরনের টিকেটকেই গ্রহণ করতে সমর্থ। তার সবুজ সংকেতে যাত্রীরা দ্রুত পায়ে বোর্ডিং প্লাটফর্মের দিকে ছুটছে। এখনকার জনজীবনে সময় একটি বিরাট ফ্যাক্টর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছেলেবুড়ো সবাই কারণে, এমনকি অকারণেও সারাক্ষণই ছুটছে। সুতরাং একুশ শতকের দুই প্রতিভূ সঙ্গে থাকায় আমাদেরও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হলো।
তারপরেও পেছন থেকে শুচির মন্তব্য শোনা গেলো-
মামণি, অত আস্তে হেঁটো না! তাড়াতাড়ি ছোটার অভ্যেস করো! না ছুটলে শরীর ফিট থাকবে কী করে? দেখছো তো, তোমার চাইতেও অনেক বেশি বয়সের মানুষগুলো কত জোরে জোরে ছুটছে?
বললাম –
আর কত জোরে ছুটবো শুচি? তোদের সবেতেই শুধু শুধু ছুটোছুটি করার একটা বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে! ট্রেন তো ঘন ঘনই আসছে! অত ছোটার কী আছে?
জবাবে কণিষ্ক বিজ্ঞের মতো বললো –
মেসো, তুমি কি জানো, আমেরিকায় মেজর হেলথ ইস্যু কোনগুলো? এগুলো হচ্ছে করোনারি আর্টারি ডিজিজ, টাইপ টু ডায়াবেটিস, স্ট্রোক আর কয়েক ধরনের ক্যান্সার। এর সবগুলোর জন্য দায়ী, আলসেমি! তোমাদের ওখানকার ওল্ড জেনারেশনের মানুষ শুধু খায় আর গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়! ওই জন্যই ছেলেদের মধ্যে ৩২.২% আর মেয়েদের মধ্যে ৩৫.৫% ওবেসিটিতে ভুগছে!
শুচি নতুন ডাক্তার হয়েছে। স্থূলত্ব তার সবচাইতে অপছন্দের বিষয়। ভাইয়ের মতো সেও রোজ জিমে গিয়ে ক্যালোরি বার্ন করে। ওজন বেড়ে গেলেই খাওয়া কমিয়ে দেয়। সুতরাং সেও নিজের দীর্ঘ অভিমত প্রকাশ করতে ছাড়লো না –
আমাদের এখানে কিন্তু স্কুলে মোটা বাচ্চাদের একদমই এ্যালাউ করে না মেসো! কারণ ওরা অনেক কিছুতেই পিছিয়ে থাকে। প্যারেন্টদের তাই দায়িত্ব থাকে, ছেলেমেয়েদের ওজন কমিয়ে আনার! দেখো, এখানে কেউই কিন্তু আমেরিকানদের মতো নয়! সবার কথা বলছি না! জানি, অনেকেই খুব কনসাস! রোজ জিমে যায়। কন্ট্রোলড ডায়েট। কিন্তু কেউ কেউ কিন্তু খুবই বাজে রকমভাবের মোটা! মা তাই বলছিল, দেখেছিস শুচি, ওদের ওয়েস্টের ওপর বালিশ রেখে রীতিমতো ঘুমিয়ে থাকা যায়! কথা শেষ করে নিজের কৌতুকে নিজেই অস্ফুটে হাসলো শুচি।
এদেশে এসে অবধি ওদের মুখে বিচিত্র বিষয়ের আলোচনা শুনতে শুনতে এই সত্য উপলব্ধি করেছি, একুশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম কেবল যে প্রযুক্তির ভাষা বুঝতে সক্ষম তাই নয়। পুরো বিশ্বের সঙ্গে তাদের মানসিক সংযুক্তি এদেরকে এক অসাধারণ বোধগম্যতা এনে দিয়েছে। বিশ্ব সম্পর্কে এরা তাই সচেতন। পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। এবং সামাজিক জীব হিসেবেও সমাজ-সংস্কৃতির যে কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কৌশল এদের রপ্ত। কথায় বলে, যস্মিন দেশে যদাচার! সেই আচার অমান্য করলে ঘোরতর বিপত্তির সম্ভাবনা! সুতরাং দুই ইয়্যাং প্রজন্মের সঙ্গে বাধ্য হয়েই ছুটতে হলো এরপরে। তাদের কাছেই শুনতে হলো, দ্রুতমানতাই আধুনিক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুতগতি জোয়ার আনতে সেই কারণেই মানুষের শ্রম আজ যন্ত্রশক্তির অধিকারে। এবং সেই কারণেই ক্লান্তিহীনভাবে বিশ্ব জুড়ে একের পরে এক প্রযুক্তি বিপ্লবের ঘনঘটা।
অবশ্য ছুটে এসেও অপেক্ষা করতে হলো না। পনেরো সেকেণ্ডের মধ্যেই ব্যাপক প্রাণস্পন্দনের সমারোহ ছড়িয়ে টিউব ট্রেন এসে পড়লো সামনে। স্বয়ংক্রিয় দরজা দিয়ে যাত্রীদের ওঠা নামা চললো দুর্দান্ত ঝড়ের বেগে। ফের ঝড়ের বেগেই স্টেশন ছেড়ে ছুটে চললো মেট্রো। সবকিছু চোখের নিমেষে আরম্ভ থেকে পরিসমাপ্ত হলো কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে। চারপাশে দুরন্ত গতির বিচিত্র আয়োজন দেখতে দেখতে মন আবারও বললো –
প্রযুক্তির এতখানি যদৃচ্ছ ব্যবহার, সুদূর ভবিষ্যতে মানুষের জন্য কোনো বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনবে না তো?
যদ্দূর চোখে পড়ছে ট্রেনের কামরাগুলো বিচিত্র রেসের জনঅরণ্যে ঠাসা। আর সে জনঅরণ্যের ভিড়ে নিরন্তর ঘটতে থাকা দৃশ্যছবিও বড় বিচিত্র। প্রথমেই নজর কেড়ে নিলো সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভূত সাজসজ্জার দুই ককেশিয়ান তরুণী। দুজনেরই মাথা কামানো। চাঁদির ওপরে ময়ূরের ঝুঁটির মতো টুকটুকে একগুচ্ছ লাল চুল, সবুজ পুঁতির ব্যাণ্ড দিয়ে সাবধানে আটকে রাখা। দুজনেরই জিনসের প্যান্ট কোমর থেকে হাঁটু অবধি টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া। একজন লম্বায় ছ’ফিট ছাড়িয়ে। অন্যজন তার বুকের কাছে। পরস্পর বন্ধু সম্ভবত। কিংবা সহকর্মী। অথবা আরও অন্যকিছু। একই হেডফোন জ্যাকের তার, দুজনে একখানা কানে লাগিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গিতে শরীর জুড়ে নাচের তরঙ্গ তুলছিল। আর তাই দেখে একজোড়া পুডল পাপি (তুলোর বলের মতো ছোট্ট কুকুর) অতি উৎসাহে তাদের মালকিনের কোলে একেকবার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল, আবার পরক্ষণে পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তুলোর দুটি বোঁচকা হয়ে। এরই মধ্যে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা ট্রেনের দুর্দান্ত গতি উপেক্ষা করে সারাক্ষণ পরস্পরকে চুম্বন করতে করতে হঠাৎই বেসামাল হয়ে পড়ে গেলো তাদের ওপরে।
সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র কটাক্ষের বিস্ফোরণ ঘটালো পাপিদের মালকিন –
হ্যালো গাইস! প্লিজ কাম ডাউন!
প্রতি স্টেশনেই নতুন যাত্রী উঠছে। নেমে যাচ্ছে যাত্রী। আমাদের গন্তব্য গ্রেট রাসেল স্ট্রিট, ব্লুমসবারি। সেটাই ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ঠিকানা। ট্রেন একের পরে এক স্টেশন অতিক্রম করছে, আর নেম বাটনে জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক আলো। শুচি দূরের থেকে হাতের ইশারায় ইঙ্গিত করলো –
পরের স্টেশনে নামতে হবে।
ততোক্ষণে বোঝা হয়ে গিয়েছিল ট্রেন সিস্টেমের রহস্য। ইঙ্গিতেই বললাম –
জানি।
ব্লুমসবারি ষ্টেশনে নেমে আণ্ডারগ্রাউণ্ড থেকে ওপরে উঠে আসতেই চোখে পড়লো রাস্তার দুধারে বিশাল বিশাল অ্যাশগাছ ব্যাপক ছায়া ছড়িয়ে মাঝখানের পথটুকু স্নিগ্ধ করে রেখেছে শীতলতার স্পর্শ দিয়ে। ব্রিটিশ যাদুঘরে পোঁছুতে অনেক ফুটপাথ পেরুতে হলো কড়া রোদে হেঁটে-হেঁটে। অদূরে সুবিখ্যাত ইউনিভার্সিটি কলেজ লণ্ডনের ক্যাম্পাস। সংক্ষেপে সবাই বলে ‘ইউ সি এল’। দলে দলে তরুণ তরুণীরা ব্যাকপ্যাক পিঠে হেঁটে চলেছে ব্যস্ত ভাবে। কেউ একা। কেউ বন্ধু পরিবৃত হয়ে। রাস্তার অন্যপাশে অজস্র গাছের জড়াজড়ি। সেখানে সবুজ শান্ত গার্ডেনপার্ক। পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। যার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে বিংশ শতাব্দী থেকে কুড়ি লক্ষ বছরের প্রাগৈতিহাসিক অতীতের মানবসভ্যতার নিদর্শন। ভেতরে প্রবেশ করে তার যতটুকু ইতিহাস পাঠ করা গেলো তাতেই মনে হলো, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের এক অসাধারণ গবেষণাগারে প্রবেশ করেছি আমরা।
ব্রিটিশ মিউজিয়াম বিশ্বের প্রথম ন্যাশনাল পাবলিক যাদুঘর। ধনী ইংরেজ ডাক্তার এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার হ্যানস স্লোয়াএনের অনুপ্রেরণায় তাঁর উইল অনুযায়ী ব্রিটিশ মিউজিয়ামের যাত্রা শুরু। স্লোয়াএন চেয়েছিলেন, বিশ্বের মানুষ জানুক, দেখুক এবং বুঝুক মানবসভ্যতা আর পৃথিবীর ইতিহাস। ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্লুমসবারির মন্টাগু হাউজে। এখনো সেখানেই যাদুঘর অবস্থিত। তবে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরী হওয়ায় তার পরিধি বেড়ে আয়তন এখন আট লক্ষ সাত হাজার স্কয়ার ফিট। গ্যালারির সংখ্যা চুরানব্বই। বছরে দর্শকের সংখ্যা ষাট লাখ। এখনও পর্য্ন্ত সংগ্রহশালায় সংগৃহীত হয়েছে আশি লাখ নিদর্শন। প্রত্যেকটি গ্যালারি আলাদা নম্বরে চিহ্নিত করে কালেকশনের বিস্তৃত ইতিহাস নির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য ব্যাপক সংগ্রহের ভেতর থেকে উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোই কেবল প্রদর্শন করা হয়। এই সংখ্যা বর্তমানে আশি হাজার।
বিপুল আয়োজনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ সুশৃঙ্খল পরিবেশন দেখতে দেখতে মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থানুর মতো বার বার দাঁড়িয়ে পড়ে হারিয়ে গেলাম হাজার বছর অতীতের নিশ্ছিদ্র চোরাগলিতে। যে অতীতকে কোনোদিন দেখিনি, জানিনি, তাকেও কল্পনার জগৎ সহসা বিস্ফারিত হয়ে ছুঁতে ছুঁতে শিহরিত হলো বার বার। পেছন থেকে শুনতে পেলাম –
মামণি, এত সময় ধরে দেখলে তিন দিনেও কিন্তু শেষ করতে পারবে না! ওদিকটায় ঈজিপশিয়ান মামিগুলো রয়েছে! চলো, দেখে আসি।
কিন্তু এখানেও মিশরের অনেক ইতিহাস লেখা আছে শুচি। সব পড়ে দ্যাখ ভালো করে!
শুচি মুহূর্তের মনোযোগ ফেলেই তার ভ্রূ জোড়া ওপরে তুললো –
এটা তো ফারাওদের সমাধি!
হ্যাঁ! খ্রীষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের! তখন রাজা রাণীরা মারা গেলে দাসদাসী ছাড়াও বিভিন্ন পোষ্টের রাজকর্মচারি মেরে সঙ্গে সমাধি দেওয়া হতো! কারণ ওরা বিশ্বাস করতো, মৃত্যুর পরে জীবন আছে এবং সে জীবন পৃথিবীর চেয়ে আলাদা হতে পারে না। তাই পৃথিবীতে যেমন ওরা ছিলেন, তার সব ব্যবস্থা পরকালেও থাকতে হবে! ওই দ্যাখ ব্যবহারের জন্য সব রকম জিনিষপত্রও রাখা হতো সমাধির কাছে! এমনকি খাবার জিনিষ আর টাকা পয়সাও!
ইতিহাসের আরও কয়েকটি লাইন পড়তে গিয়ে শুচি আবারও বিস্মিত হলো –
মামণি জানো, এটা রিলিজিয়াস ব্যাপার ছিল! দেখো লেখা রয়েছে সমাজের সব বড় মানুষরাই এই রিচুয়্যাল ফলো করতো! বাপরে! কী বারবারিক! মমি তৈরীর কমপ্লেক্স প্রসেস কী করে এরা আবিষ্কার করেছিল?
মিশরের মমি ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। হাজার হাজার বছর আগের মানুষগুলো এখনো মানুষের অবয়ব নিয়েই সুদূর অতীতের অস্তিত্ব বহন করছে। শুচি এবারও বললো –
মমিফিকেশনের কেমিস্ট্রি কিন্তু সাংঘাতিক জটিল ব্যাপার মেসো! সেই যুগে এভাবে প্রিজার্ভ করার কথা ভাবা যায়, বলো?
সে তো নিশ্চয়ই! আর ওই পার্থেনন মার্বেলসের ক্লাসিক ভাস্কর্য্গুলোও কিন্তু উন্নতমানের আর্ট শুচি! ওগুলো দেখে উড়িষ্যার সূর্য মন্দিরের কথা বার বার মনে পড়ছিল!
সেটা কী মেসো? আমার তো দেখা হয়নি!
দিদিভাই, তোমরা তখন এশিয়ার দিকটা দেখছিলে। আর এটা গ্রীস আর রোমের গ্যালারিতে। ওটা গ্রীকদের শহর রক্ষার দেবী এথেনার মন্দির। এথেন্সের অ্যাক্রোপোলিস মাউন্টেইনের ওপরে খ্রীষ্ট জন্মের ৪৪৭ থেকে ৪৩২ বছর আগে ছিল। অটোম্যানরা এথেন্স দখল করে ১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দে মসজিদ বানিয়ে দেয়। কিন্তু ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৯ পর্য্ন্ত অটোম্যানদের সঙ্গে ইটালির নেভি কমাণ্ডার ইন-চিফ ফ্রান্সিসকো মরোসিনির সঙ্গে যুদ্ধের সময় কামানের আগুনে স্কাল্পচারগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
কণিষ্ক একটানা কথাগুলো এমনভাবে বললো যেন যাদুঘরের গাইডম্যান হিসেবে ভাস্কর্যগুলোর ওপর সে ব্যাখ্যা দিচ্ছে। খুশি হয়ে বললাম-
তুই কি সব মুখস্থ করে এলি নাকি?
আমি সব পড়েছি মামণি। সবই লেখা রয়েছে তো।
তোমরা কি কিং মউসোলাসের সমাধির আর্কিটেকচার দেখেছো পাপান?
না দিদিভাই। কিন্তু আমরা রোজেট্টা স্টোন দেখেছি। ওই স্টোনটার ওপরে তিন ধরনের ভাষায় লেখা আছে। গ্রীক, ডেমোটিক আর কপটিক। মডার্ন স্কলাররা ওই স্টোন থেকেই এনশিয়েন্ট ইতিহাস জেনেছেন।
এরপরে আরও ঘন্টা দুয়েক ধরে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে স্পষ্ট বোধোদয় হলো, এমন ব্যাপক আয়োজনের বিশাল জ্ঞানসম্পদ সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য কত কঠিন পরিশ্রম, সুগভীর নিষ্ঠা, অর্থ আর ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার প্রয়োজন হয়েছিল। কী অসাধারণ পারিপাট্য, অপরিসীম যত্নে সভ্যতার এমন অমূল্য সম্পদ আহরণ করতে হয়েছে সুদীর্ঘ সময় ধরে। আফ্রিকা থেকে এশিয়া, ইউরোপ থেকে দুই আমেরিকান সভ্যতার এমন দিক নেই যার সন্ধান এখানে মেলে না। শিল্পসংস্কতি, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, প্রকৃতির পাঠশালার আরও যত রকম অবারিত জ্ঞানসম্পদ রয়েছে তার সবই নতুন যুগের মানুষের ধারণার জন্য, নতুন যুগে নতুন আবিষ্কারের জন্য এক উন্মুক্ত দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে এখানে।
চলে আসার আগে সব দেখেশুনে মন আরও একবার বললো –
নিষ্ঠার এতবড় সংগ্রহশালা শুধু তো কেবল বাইরের চোখ দিয়ে চেয়ে দেখার জিনিষ নয়! এরা অতীত জীবনেরও এমনই এক সমাধি মন্দির যেখানে কান পাতলেই শোনা যায়, অখণ্ড মহাকালের কথা শোনাতে কতখানি ব্যাকুল তারা! চলবে...
দীপিকা ঘোষ
ওহাইয়ো, আমেরিকা।
-
গ্রন্থালোচনা // ভ্রমণ
-
15-05-2019
-
-