অটোয়া, শুক্রবার ৯ মে, ২০২৫
ফেলে আসা দিনগুলি (নবম পর্ব) -হুমায়ুন কবির

চয়নের বড় মামার বিয়ে। গতকাল নানা নিজেই চয়নদের নিতে এসেছে। শহরে থাকলেও বড় ছেলের বিয়ের আয়োজন গ্রামেই করলো।  নানা চয়নের মাকে আর সব সন্তানদের চেয়ে বেশি ভালো বাসে। কারণ চয়নের মা ছেলে মেয়েদের মধ্যে সবার বড়। নানার সংগে মামার বিয়েতে যাওয়ার আনন্দের শেষ নেই। বাবা, চয়ন ও তার ছোট বোনের জন্যে অনেক সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় ও নতুন জুতা আরো কত কি কিনে এনেছেন!

চয়নের কি যে আনন্দ হচ্ছিলো! তা বলে বুঝাবার নয়। সি. এন্ড. বি লঞ্চ ঘাট থেকে ছোট খাটো জাহাজের মতো স্টীমারে করে গ্রামে যেতে হবে। নানা আগে থেকেই প্রথম শ্রেনীর ফ্যামিলী কেবিন ভাড়া করে রেখেছিলো। চয়ন দেখতে অনেকটাই নানার মতো। যে কারণে চয়নের খালা মামারা চয়নকে বাবা বলেই ডাকে। এতে চয়নের খুব একটা খারাপ লাগেনা বরং ভালোই লাগে। এতো ছোট একজন মানুষকে সবাই বাবা বলে সম্বোধন করে, এটা চয়নের জন্য বাড়তি পাওনা।

মাঝরাতে  নদীর তীর ঘেসে ভুত বাতি জ্বলছিলো । ভুত বাতি! কি অপূর্ব! কিছুটা দূরত্ব পর পরই ভুত বাতি আছে। ভুত বাতিগুলি নির্ধারিত সময় পর পর জ্বলছে আবার নিবছে। একেবারে নিয়ম করে। ভুতবাতির আলো নদীর পার দেখে নৌযান চলতে সাহায্য করে থাকে। সার্চ লাইটের আলো আর ভুত বাতির আলোয়ে চারদিক ঝলমল করছে। আকাশে চাঁদের আলো। রুপালী জ্যোৎস্না!  এ এক অবাক করা সৌন্দর্য! নদী পথে ভ্রমনের আনন্দ এতো ,তা বড় মামার বিয়েতে না এলে চয়ন কোনদিন জানতেও পারতোনা।

কতরকমের খাবার বিক্রি হচ্ছে! একের পর এক হকার এসে হাক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ছোট একটা ছেলে চা বিস্কুট বিক্রি করছে। ঝাল মুড়ি, চানাচুর। কচি ডাব ,পান-সিগারেট সহ আরো কতো কি! যাত্রি আর হকারদের কথা বার্তায় চারপাশ যেনো মুখরিত। চয়ন জানালা দিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো। বিশুদ্ধ বাতাসে মন প্রাণ জুরিয়ে গেলো। হৃদয় যেনো আজ হাড়িয়ে যেতে চাইছে। কোথায় হাড়াবে! যেখানে মন চায় সেখানে! 
 স্টীমারে রাতে চয়ন ঘুমিয়ে পরেছিলো। সকালে মায়ের ডাকে যখন ঘুম ভাংলো তখন সকালের আলোয় পদ্মার পানি চিক চিক করছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে ডিঙ্গি নৌকাগুলিকে দুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি নৌকাটি ডুবে যাবে! আসলে তা নয়। নৌকাটি আবার ভেসে উঠছে। সারি সারি পাল তোলা নৌকা। রঙ-বেরঙের কাপড়ের টুকরার জোরাতালি দিয়ে বানানো পালগুলি যেনো রঙ ধনুর সাতটি রঙ চুরি করে পাদ্মাকে আরো রঙ্গিন করে সাজিয়েছে! চয়নের খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো স্টীমারের কিনারে যেয়ে পদ্মার পারের মানুষ ও পদ্মাকে দেখার। কিন্তু নানা কিছুতেই সেটা করতে দিলোনা। সারি সারি গয়না নৌকা দুলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছে।  কিছু কিছু গস্তি নৌকাকে কিছু লোক  দড়ি দিয়ে বেধে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই দড়িগুলিকে গুন বলে। দুই তিনজন লোক গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোক গুলির খুব কষ্ট হচ্ছে। ভিশন কস্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চয়নের কাছে ব্যাপারটা খুব কস্টের মনে হোল। আহা! কি কস্ট এদের। নদীর পারের উঁচু-নিচু পথ। পথ বলতে নদীর পার। চয়ন নানার কাছে জানতে চাইলো,
-আচ্ছা নানা, ঐ লোকগুলো নৌকাটীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
-এই নৌকাতে মাল বোঝাই করে রাখা আছে। এতে নৌকা অনেক ভারি হয়ে গেছে। তাই এরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 
- কিন্ত লোকগুলির খুব কষ্ট হচ্ছে যে!
-এখানে এটাই নিয়ম। 
-এ-কেমন নিয়ম?

নানা চয়নকে কাছে টেনে প্রথমে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু খেলো। তারপর বললেন, 
-একদিন বড় হয়ে তুমি এদের এ-কাজের পরিবর্তে অন্য কাজের ব্যবস্থা করে দিও। আর মালামাল বহন করার জন্য বড় বড় কারগু জাহাজ এনে দিও। দেখবে তখন আর এদের আর এতো কষ্ট থাকবেনা।
-জি নানা, আপনি দোয়া করবেন। 
নানা চয়নকে বুকের সংগে আরো গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরলো। কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু কিছুই বললো না। এতো ছোট একজন শিশুর মুখে এতো সুন্দর মানবিক কথা শুনে নানা মুগ্ধ হয়ে গেলো। চয়ন যেনো সত্যি সত্যিই নানার ছেলে বেলার অবিকল সেই মানুষটি। খুব ভালো লাগছে! 

কিছু পাওয়ার পূর্ণতা আর কিছু না পাওয়ার অপূর্ণতা নিয়েই নানা বাড়িতে এলো। চারিদিকে থৈ থৈ আনন্দ! কত কে এসেছে। চয়ন কাউকেই চিনতে পারছেনা। নানা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলছে,
-আমার বড় মেয়ের ছেলে। ঠিক আমার মতো, না?
-জি মিয়া ভাই, একেবারে আপনার মতো। 
নানা অনেক্ষণ চয়নকে কোলে নিয়ে থাকলো। কতজনের কোলে চয়ন উঠলো তার হিসেব নেই। কোলে চড়ার মতো অতটা ছোট নয় চয়ন। কিন্তু তাতে কি! এরা চয়নের আপন জন। এদের ভালোবাসা এমনই। 

গায়ে হলুদের পরে জরির কাজ করা শিতল পাটির বিছানা পেতে বড় মামাকে বসানো হলো। আরো যারা বিয়েতে এসেছে তাদের অনেকেই এসে বসলো। মিস্টি আর পায়েস খেতে দেয়া হলো। ব্যাপারটা চয়নের কাছে খুব ভালো লাগলো। ভিশন ভালো লাগলো। সন্ধার পর হ্যাজাক লাইটের নরম আলোয় চয়নের নানা বাড়িটা আনন্দে ঝল মল করতে থাকলো। ছয় বেহারার পালকি এলো। বেহারাগুলি কি সুন্দর করে সেজেছে! পায়ে ঘুঙুরও বেধেছ। সবার হাতেই লাঠি। রাবেয়া খালাও এসেছে। খালা আজকে অসাধারণ করে সেজেছে। লাল রঙের চওড়া কাজ করা পারের গরদের শাড়ি আর তাজা বেলি ফুলের সাজে রাবেয়া  খালাকে ঠিক যেনো পরির মত লাগছে। খালা চয়নকে মহুয়া গাছের নিচে নিয়ে এলো। আজ এতো চাঁদের আলো! মহুয়া ফুলের মাতাল করা গন্ধ যেনো মাতাল করে দিচ্ছে।
 নানা এসে বললো,
-আমার শারীরটা বেশি ভালো না। আমি যেতে পারবোনা। তোমরা যাও। আমার নাতিটাকে পালকিতে করে নিয়ে যাও। ও এতোটা পথ হাটতে পাড়বেনা। কখনো হেটে কোথাও যায়নি।

কিন্তু বেহারারা সেটা মানলো না। কি আর করা! কোন এক অচেনা আত্মীয়ের কোলে চড়েই বড় মামার বিয়ের বর যাত্রার সংগে রওয়ানা হলো। বেহারার দল শুর করে গান ধরলো,
-হুন হুনা। হুন হুন। হুন হুনা। হুন হুনা।

মামার বিয়েতে নানা রাজি ছিলোনা। কারণ বিয়ের জন্য বংশটা খুবই জরুরী। নতুন বৌয়ের তেমন কিছুই নেই। পদ্মার বুকে সমস্তটা হাড়িয়ে যাওয়ার পর মামির বাবা ও ভাইয়েরা পাবনা জেলার ইশ্বরদীতে ছোট খাট ব্যাবসা দিয়ে ওখানেই বাস করছে। মামির বড় বোন বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছে। যা হোক একে বারে খারাপ হয়নি।

এদিকে নানার শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকলো। অনেকটা চয়নের মায়ের বুকেই আশ্রয় নিলো। চয়নের নানা বলল,
-আমার নতুন ব্যাবসাটা তোমাকে দেখাতে পারলাম না। তোমাকে কিছু লিখে দিয়েও যেতে পারলাম না। রাবুকে তুমিই দেখে রেখো। ফাহিম একদিন তার ভুলগুলি ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে। আমার এতো ভালো একটি মেয়ে। কি হয়ে গেলো! তবে আমার সবকিছুই তুমি, রাবু, বড় খোকা আর ছোট খোকাই মালিক। তুমি ওদের দেখো। ওরাতো বর যাত্রায়! তুমি আমাকে মাফ করে দিও। ওদের মাফ করে দিতে বলো। 
চয়নের মা বললো,
-আপনি এসব কি বলছেন বাবা? আপনি শান্ত হোন।
-তুমি আমাকে বলতে দাও। তুমি যাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছো, তারা তোমাকে কোন সম্মান দিবে কিনা জানিনা, তবে অসম্মান যেনো না করে।  এইযে বাড়ি ঘর, এই সব কিছু তোমাদের জন্যই করেছি।  বড় খোকার বউ কেমন হবে জানিনা। তুমি তাকে বলো যে, আমি তাকে অনেক অনেক দোয়া করে গেছি। চীনকে  দেখে রেখো। 
-বাবা, আপনি চুপ করুন। শান্ত হোন। 

আর কি শান্ত হবে! আস্তে আস্তে চয়নের মায়ের বুকে শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো চিরদিনের মতো।
-বাবা! ও বাবা! বাবা আপনি কথা বলুন। বাবা----! বড় খোকা, ছোট খোকা, রাবেয়া ! তোরা কোথায়? বাবা কথা বলছেনা। আসে পাশের সবাই চয়নের মায়ের কান্না শুনে ছুটে এলো। ততোক্ষণে চয়নের নানার প্রাণহীন দেহ নিথর হয়ে গেছে। স্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে চিরদিনের জন্যে।

তখনও সবাই কনের বাড়িতে। বড় মামার বিয়ে! আনন্দে সবাই মাতোয়ারা। ফেরার সময় সমস্ত পথই নতুন বউ কান্না করলো। এভাবে নতুন বউ কান্না করে? কি জানি হয়তো করে। মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কস্টে হয়তো এমন করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে।  

বর যাত্রীর দল ফেরার পর কান্নার রোল পরে গেলো। বড় মামা এক লাফ দিয়ে পালকি থেকে নেমে বাবা বলে চীৎকার করে বেড়িয়ে এলো। এতো লোকজন! কতো মেহমান এসেছে। বিয়ের আনন্দ স্থমিত হয়ে গেলো। আজ অবধি কোন বাড়িতে সম্ববত এই ধরণের বিষাদের ঘটনা আর ঘটে নাই। চয়নের বড় মামার বিয়েতে ঘটলো। কিছু বৃদ্ধা মহিলারা বলাবলি করতে লাগলেন এই বলে যে,
-বউডা অলক্ষ্মী। নইলে এমন ঘটনাও ঘটে! বাড়িতে ঢুকার আগেই বাড়ির মালিককে খেয়ে ঢুকলো। এমন বউয়ের মুখ দেখাও পাপ। কেউ বউকে বরণ করে নিতে এলো না। কিন্তু চয়নের মা এলো। চয়নের মা অনেক সংযমী বড় মনের মানুষ। জরিনার হাতে বরণ ডালা দিয়ে নিজেই পালকি থেকে স্নেহের ছোট ভাই যাকে জন্মের পর থেকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে তার বউকে সদ্য বাবার শোক বুকে সামলে নিয়ে বরণ করে নিলো। 
-এসো বউ মা। এসো। সব সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছাতেই হয়। তুমি কেদোনা। 
  অনেক বেদনার ভিতরে নতুন বউ গৃহীত হলো। আনন্দ আর বেদনায় চয়নের বড় মামার বিয়ে সম্পন্ন হোল।

চয়ন এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই সেদিনের বড় মামার বিয়ের আনন্দ দেখতে পায়। নানার চলে যাওয়ার শুন্যতা অনুভোগ করে। নানা ভাইয়ের সঙ্গ পায়। আর শুনতে পায় ছয় বেহারার শুর করে গাওয়া সেই সেদিনের বিয়ের গান।
হুন হুনা, হুন হুনা। হুন হুনা। হুন হুনা।
যায়ারে লক্ষ্মী স্বামীর ঘরে ছয় বেহারার পালকি চোরে। চলবে…

হুমায়ুন কবির
ঢাকা, বাংলাদেশ।