আমি, বাকাওভ এবং পিকনিক ২০১৯ -কবির চৌধুরী
অনেকটাই চর্বিত চর্বণ। তারপরেও কিছু কিছু বিষয়কে কচলাতেই হয়- লোহাকে গলানোর মত। চর্বিত চর্বণ একারনেই লেখা যে, আমি গত কয়েক বছরে অসংখ্যবার ‘আশ্রম’-এ ‘বাকাওভ’ নিয়ে আমার মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আজকেও আবার ‘বাকাওভ’ আয়োজিত “পিকনিক বা বনভোজন ২০১৯” নিয়ে সংবাদ লিখতে বসেছি। সংবাদ লেখা শুরু করে মনে হল দেশে বিদেশে প্রকাশিত অনেক অনলাইন পত্রিকায় বাকাওভের পিকনিক নিয়ে সংবাদ হবে, তাছাড়া যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেইসবুক তো আছেই যেখানে আপলোড করা শতশত ফটো পিকনিকের কথা বলবে। তাই গতানুগতিক সংবাদ না করে আবারও অটোয়া তথা কানাডার প্রাচীনতম বাংলাদেশী সংগঠন ‘বাকাওভ’ নিয়ে লিখলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমন কাজ।
প্রথমেই দেখা যাক ‘বাকাওভ’ কী? ‘বাকাওভ’ হল ‘বাংলাদেশ কানাডা এসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালী’-র সংক্ষিপ্ত নাম। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠনটি গঠন করা হয়। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কানাডায় জনমত তৈরি করা। তাই অনেকেই এই সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধের জাতক বলে বর্নণা করেন। শুরুতে আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠনটির নাম ছিল ‘বাংলাদেশ সমিতি’। কিন্তু পরবর্তীতে অটোয়ার পার্শ্ববর্তী শহর গ্যাতিনোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরকে সংগঠনের সাথে জড়িত করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ সমিতি’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ কানাডা এ্যাসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালি’ (বাকাওভ) রাখা হয়।
২১শে জুলাই ২০১৯, অটোয়ার পার্শ্ববর্তী শহর গ্যাতিনোর ‘লেক ফিলিপে পার্কে’ “বাংলাদেশ কানাডা এ্যাসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালী”(বাকাওভ) আয়োজিত ‘পিকনিক ২০১৯’-এর অনেক আয়োজনের একটি ‘দাবা প্রতিযোগিতা’র বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করতে এসে মুক্তিযোদ্ধা শিকদার মতিয়ার রহমান বলেন যে, “আমি অটোয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে ১৯৮৬ সালে কাজ করতে এসেছিলাম। তাই বলতে পারেন, সেই ৮৬ সাল থেকেই আমি ‘বাকাওভ’-কে দেখছি। সেই ‘বাকাওভ’ আর এই ‘বাকাওভ’-এর মধ্যে রাত দিন তফাৎ। আর তা সম্ভব হয়েছে নতুন নেতৃত্বের কারণে। আমি আশা করি বর্তমান নেতৃত্ব তাদের কাজ অব্যাহত রাখবে।”
মুক্তিযোদ্ধা শিকদার মতিয়ার রহমানের বক্তব্যের সাথে বহুলাংশে আমি একমত। বর্তমান নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে অনেক ভাল কাজ করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করে নির্মিত শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্যে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’-র প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, অটোয়া সিটি থেকে বাংলা হেরিটেজ সপ্তাহ পালনের সম্মতি আদায় এবং সর্বশেষ পিকনিক-২০১৯। ‘বাকাওভ’ নেতৃত্বের এই কাজগুলো আশা জাগানিয়া। তারপরেও ভয় করে। কারণ শিকদার মতিয়ার রহমানের মত আমিও বাকাওভ নামের এই সংগঠনটিকে অনেক দিন থেকে – অনেক কাছ থেকে দেখে আসছি। সেনা শাসক এরশাদের চাপিয়ে দেওয়া জগদ্দল পাথরের চাপ থেকে মুক্তি পেতে ১৯৮৮ সালে কানাডায় আসার দিন থেকেই। আশ্চর্য হলেও সত্য, কানাডায় এসে অটোয়ার বিখ্যাত চ্যাপেল টাওয়ারের ১২ তলার ১২০১ নাম্বার রুমে প্রবেশ করেই আমি “বাংলাদেশ কানাডা এসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালী”-এর স্পর্শ পেয়ে যাই। টি টেবিলের উপর রাখা ‘মাসিক বাংলাদেশ’ নামক পত্রিকাতে ‘বাকাওভ’-এর কিছু সংবাদ দেখতে পাই। সেখান থেকেই ‘বাকাওভ’-এর সাথে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা, যে ঘনিষ্ঠতা আজও বিদ্যমান।
এই দীর্ঘ সময়ে আমি বাকাওভের উত্থান-পতন দুই-ই দেখেছি। যদিও পতন খুব আস্তে আস্তে হয়েছে তবে তার উত্থান ছিল দেখার মত, মনে রাখার মত। এখনও আমরা পুরাতনরা যখন ‘বাকাওভ’ নিয়ে আলোচনা করি তখন সেই সব দিনের কথা আলোচনা করি। আমাদের স্মৃতির পাতায় উঁকি দেয় ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০১০ এবং ২০১৭। ১৯৯১ সালের ‘বাকাওভ’-এর জাগরণে আমি একজন দর্শক ছিলাম। কিন্তু তারপরের অর্থাৎ ১৯৯৬, ২০১০ এবং ২০১৮ এর ‘বাকাওভ’ পুনর্গঠনে আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম। ২২ শে অক্টোবর, ২০১৭ যখন (সদ্য প্রয়াত) সৈয়দ ফারুক আনোয়ার মিন্টু ভাইকে, অটোয়ার প্রথম বাংলাদেশী সংগঠন “বাংলাদেশ কানাডা এ্যাসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালী”-কে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন তিনি আমাকে সেই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে নেন। সেই প্রক্রিয়ার একজন সদস্য হিসাবে বলতে চাই আমাদের এই কাজ সহজ ছিল না। শহরে প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশির বসবাস যাদের অধিকাংশই নতুন এসেছেন। অনেকের কাছেই ‘বাকাওভ’ নামটা একেবারে নতুন। এছাড়া অনেকেই তৈরি হওয়া নতুন নতুন সংগঠনের সাথে জড়িত, যাদের কাছে নিত্য-নতুন আইডিয়া আর যোগ্যতা। এছাড়া পুরাতন নেতৃবৃন্দ নিজেদের গড়া বিভিন্ন ধরনের সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় বাকাওভ পুনর্গঠন করতে আমাদেরকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে- বেগ পেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমরা ‘বাকাওভ’-কে পুনর্গঠন করেছিলাম। যদিও অনেকে মনে করেন, আমাদের পুনর্গঠন পরিপূর্ণতা পায় নি। কারণ, ইলেকশানকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়, প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অনেকই আমাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে নিজেদেরকে আলাদা করে নেন। আমি বলব, আমাদের এই বিভাজন কোনভাবেই কাম্য ছিল না। কিন্তু হয়েছে, এটাই সত্য- এটাই মানবধর্ম। আর এই জায়গাটিতে আমার ভয়, না জানি আবার ব্যক্তিত্বের সংঘাত বা সামান্য মতানৈক্যের কারণে ‘বাকাওভ’ না আবার হারিয়ে যায়- উদ্যোমি নেতৃত্ব নিজেদেরকে গুঁটিয়ে নেয়। তবে আমার বিশ্বাস বর্তমান কমিটি তা হতে দেবে না। তারুণ্যে ভরপুর নেতৃত্ব শীঘ্রই নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন “বাংলাদেশ কানাডা এ্যাসোসিয়েশন অব অটোয়া ভ্যালী” (বাকাওভ)-কে অটোয়ায় বসবাসকারী সকল বাংলাদেশিদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলবে।
জয়তু ‘বাকাওভ’
কবির চৌধুরী
জুলাই ২৩, ২০১৯
অটোয়া, কানাডা।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
23-07-2019
-
-