অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ফেলে আসা দিনগুলি (বারো পর্ব) – হুমায়ুন কবির

রাস্তায় অনেক লোক জড়ো হয়েছে। ছেলেধরা সন্দেহে একজন ভদ্র মহিলাকে লোকজন ভয়ানক ভাবে মারধর করেছে এবং ঘটনাস্থলেই মহিলা মারা গেছেন। চয়ন পাশে দাঁড়িয়েছিলো। এই পথ দিয়েই আফসানা রোজ 'লিটল স্টার কিন্ডার গার্ডেনে' পড়াতে যান। 

আফসানা চয়নকে দেখতে পেয়ে চয়নের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো,
-কি হয়েছেরে চয়ন?
-ছেলে ধরা সন্দেহে একজন মহিলাকে লোকজন মারধর করে মেরে ফেলেছে। আসলে মহিলাটি আদৌ ছেলেধরা ছিলোনা। মহিলাটি ছিলো মানসিক ভারসাম্যহীন।
-কি বলছিস!
-জি আপা।
-মহিলাটি কোথায়?
-পুলিশ এসে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গেছে। 
-কোন ঠিকানা পাওয়া গেছে?
-আমি জানিনা আপা।

আফসানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। এসব কি হচ্ছে দেশে? এটা কি কোন সভ্য দেশ? প্রায়ই গণধোলাই ও ক্রস ফায়ারে মানুষ হত্যার খবর শুনতে পাওয়া যায়। আইন বহির্ভূত এসব হত্যাকান্ড পৃথিবীর আর কোন সভ্য দেশে ঘটে কিনা তা আফসানার জানা নেই। কেউ অপরাধী হলে তাকে আইনের হাতে তুলে দেয়া উচিত। দেশের প্রচলিত আইনে যে সাঁজা হবে সেটাই তার জন্য আইনগত অধিকার। তাছাড়া এও খবরে প্রকাশ পায় বা হত্যা কান্ডের পর জানা যায় যে, নিহত  ব্যাক্তিটি নিরপরাধ , মাদকাসক্ত  বা  মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলো। অথচ কি নিষ্ঠুর ও অমানবিকভাবে মানুষের প্রাণ কেরে নিচ্ছে এই হিংস্র মানুষরূপী দানবের দল। তাদের এতোটুকু অনুশোচনা বা তারা বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়না। মানবিকতার এই ধ্বংসাত্মক লেলিহাণ শিখায় জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের জীবন। গত কদিন আগে অন লাইনে অটোয়া, কানাডা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা 'আশ্রম''-এ লেখক, অনুবাদক ও সাংবাদিক ফারজানা নাজ শম্পার একটি কবিতায় সভ্যতার এই ধ্বংসাত্মক অবস্থার চিত্র মূর্ত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিলো। কবিতাটিতে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অবস্থাকে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরা হয়ে ছিলো। কবিতাটি আফসানার চোখের স্যামনে ভেসে উঠলো। একজন মানুষ কি যাদু মন্ত্রের বদৌলতে এমন করে লিখে! এতো অন্যায়ের মধ্যেও লেখক শুধু মাত্র মেধা ও কলমের শক্তি দিয়ে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছেন। কবিতাটি ছিলো এই রকম,

"ছন্দ সুর অর্থহীন দিগন্তে বিলীন হয়
ক্ষতবিক্ষত মানুষের আর্তনাদের স্রোতে,
মৃত শরীরের দুর্গন্ধময় গলিত লাশের স্তূপে 
বিসর্জিত হয় পবিত্র ধর্মীয় উপসনালয়ের
অপার বিশ্বাসের সকল স্নিগ্ধ মহিমা।
লক্ষ হাজার আর্তি আর নির্যাতনের চিত্র উপচে গ্রাস করছে বর্তমানের নগর সভ্যতার
সংবাদ বার্তা মাধ্যমের অধিকাংশ শব্দপ্রবাহ কে,
অন্ধশক্তির হায়েনারা প্রতিদিন
আয়েশে আর আদিম নারকীয় বাসনায় 
দুমড়ে মুচড়ে খুবলে রক্তের নকশা আঁকে
নুসরাত, তনু আর নামহীন অসংখ্য নারী, শিশুর মানবিক দেহ সুষমায়।
আর কতদিন?
বর্বরতার আর হিংসার উম্মত্ততায়
অবরুদ্ধ প্রায় শতাব্দীর সত্যরা।
সত্যব্রতী বিবেকধারী বাকরুদ্ধ একদল মানবসন্তান
অস্তগামী সুন্দর কে রক্ষায় তাগিদে
আক্রমণের হাতিয়ার তোলে আর গর্জে জানায়
ধিক্কার এই নির্বাক নিথর আধুনিক অভিশপ্ত সভ্যতাকে,
ধিক্কার জানাই রাস্ট্রযন্ত্র তোমাকে...
তথাকথিত অবারচীন বোধের অতলে ভাসা
সমাজপতিদের সুশিল নির্বোধ নীরবতাকে।"

আফসানার কেবলি মনে হতে থাকলো,
" এ কেমন সভ্যতা! তার চেয়েতো গভীর অরণ্যের জীব-জন্তুরাও অনেক সভ্য। আফসানা যেদিন ধর্ষিতা হলো, কিছু বিকৃত ও ভয়াবহ রাক্ষসদের দ্বারা। সেদিন থেকেই প্রতিটি মুহূর্ত আফাসানা বুকের ভিতরে ভয়াবহ কষ্ট নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। এ যেনো এক নরক যন্ত্রণার চেয়েও বেদনার, কষ্টের। সেদিন আফসানার চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি। আজো সেই দিনের সেই ভয়াবহতার কথা মনে হলে আফসানা এক অশুভ অন্ধকারের অতল গভীরে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় বেদনার নিল আকাশের বিশাল শূন্যতায়। "

মহিলার নাম রহিমা খাতুন। মহিলার ব্যাগে রাখা জাতীয় পরিচয় পত্র থেকে জানা গেছে।  মহিলার চার বছরের একজন মেয়ে শিশু আছে। মেয়েকে বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে খোজ খবর নেওয়ার জন্য মহিলা বিদ্যালয়ে এসেছিলেন। মহিলা কিছুটা হতাশ ছিলেন। মহিলার স্বামী মহিলাকে ডিভোর্স করার পর মায়ের সংগে ছোট একটা ভাড়া ফ্লাটে মেয়েকে নিয়ে থাকেন। সংসারে তেমন আর কেউ নেই। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা-ও বৃদ্ধা। মহিলা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন। যা বেতন পান, তাই দিয়েই সংসারের খরচ চালান। মহিলার স্বামী অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা বাসা নিয়ে থাকেন। 

আফসানার মাঝে মাঝে আগুন দিয়ে নিজেকে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু আফসানা কিছুই করতে পারে না। কারণ বৃদ্ধা মা আর ছোট্ট সোনামনি রুবাবার কথা মনে হলে সব কষ্ট আর গ্লানি বুকের ভিতরের সিন্দুকে তালা বন্দি করে রাখতে হয়। এ ছাড়া আর কি করার আছে? সামান্য মেয়ে ছেলে মানুষ আফসানা। একজন মেয়ে যেনো সম্পূর্ণ মানুষ না; মেয়ে মানুষ। আর একজন মেয়ে মানুষ মানে দুর্বল মানুষ। অথচ যে দানবটি একজন মেয়ে মানুষকে ভোগের সামগ্রী মনে করে খুবলে খুবলে ভোগের চেষ্টা করে; সেই পুরুষ মানুষ নামের দানবটি একজন মমতাময়ী মেয়ে মানুষ নামের মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে, সেই মায়ের জাতির সমস্ত দেহে এঁকে দেয় নারকীয়, দানবীয় কলংকের কালিমার চিহ্ন। 

এ লাজ্জা কার? একজন মেয়ের? না একজন মায়ের? ভাবনাগুলি সর্বক্ষণ আফসানাকে তাড়া করে ফিরে। 
"যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে, লক্ষ মুক্তি সেনা।" সেই মাটিকে আবার কেন নারীর রক্ত দিয়ে পৈশাচিক রাক্ষসেরা বেদনার লাল রঙে রাংগিয়ে কলংকিতো করবে?

আফসানার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এ যেনো আফসানার নিজেরই জীবনের গল্প। আফসানার জীবনে যা ঘটেছে রহিমা খাতুনের জীবনেও তা-ই ঘটেছে। ধরণটা একটু আলাদা হলেও আক্রমণ ও হামলায় আক্রান্ত হওয়ার কষ্ট  একই রকম। আফসানা উচ্চ শিক্ষিতা এবং শিক্ষকতা করেন। আর রহিমা খাতুন অল্প শিক্ষিতা। কিন্তু জীবন সংগ্রামের লড়াই দু'জনের প্রায় একই রকম। আফসানার বুকের ভিতরে আবার ক্ষরণ হতে শুরু করলো। আর কতো দিন এ অসভ্যতা চলবে? কতজন মেয়ের জীবনের আলো নিভে যাবে, না হয় কলংকের কালিমায় ঢেকে যাবে? কেন এমন হবে? কেন? কেন? 

আফসানা বটতলার মোড়ের কাছাকাছি একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ান। কিছু বাচ্চাদের বাসায় গিয়েও প্রাইভেট পড়ান। মাসিক বেতন ও প্রাইভেট পড়িয়ে যা পান, তাই দিয়েই কোন রকমে মা, মেয়ে ও ছোট রুবাবাকে নিয়ে সংসারটা চালিয়ে নেন। বাবা, ভাই কেউ নেই। ভালোবেসে যে মানুষটিকে বিয়ে করে সুখের স্বপ্ন দেখেছিলো সে এখন অন্য একটি মেয়ের গর্বিত স্বামী। মেয়েকে ভালো কোথায় পড়াবেন, তেমন অবস্থাও নেই। কিন্তু বাসায় একা একা মেয়েটি কি করবে। যে কারণে আফসানা সিদ্ধান্ত নিলো যে, কম খরচে ভালো কোন বিদ্যালয়ে পড়াবেন। 
 সেদিন আফসানা সকালে উঠে ফজরের নামাজ শেষ করে মা ও মেয়ের জন্য খাবার তৈরি করে রেখে যান। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে যায়। যে কারণে আফসানাও সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যান। রুবাবা ঘুমিয়ে আছে। আফসানা রুবাবার কাছে এসে দাড়ালো। মুখের দিকে তাকাতেই সুমনের অসাধারণ সেই গানটির কথা মনে হয়ে গেলো, 

"গান তুমি হও আমার মেয়ের ঘুমিয়ে পড়া মুখ"!

উপর হয়ে কচি নরম গালে হৃদয়ের সবটুকু মমতা ঢেলে দিয়ে চুমু দিলেন। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে রুবাবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মাকে কাছে পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। বললো,
-মাগো, আজকে তুমি যেওনা। আমার ভালো লাগছেনা। তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগেনা। 
-লক্ষ্মী সোনা, আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো। তুমি ভালো থেকো। নানুর সঙ্গে খেলা করো। কার্টুন ছবি দেখো। ভালো থেকো মামনি, কেমন!
-তুমিও ভালো থেকো। সাবধানে যেও। আল্লাহ হাফেজ। টাটা।
-টাটা। আল্লাহ হাফেজ।

মায়ের কাছে এসে বললো,
-মা আমি যাই। তুমি ভালো থেকো। রুবাবার দিকে খেয়াল রেখো। 
-জি। তুইও ভালো থাকবি। সাবধানে রাস্তা পার হবি। বেশি দেরি করবিনা। রুবাবা সারাদিন তোকে খোঁজে।
-জি মা। আমি তারাতারি ফিরতে চেস্টা করবো। আসি তাহলে।
-আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।

আফসানার স্কুল ছুটি হয়েছে বেলা দুইটায়। আজকে আর প্রাইভেট পড়াতে যাবেনা। রুবাবাকে বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া খুব জরুরী। প্রধান শিক্ষিকার অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পর আফসানা জানতে চাইলেন।
- আপা, আপনাদের এখানে আমি আমার ছোট মেয়েটিকে ভর্তি করাতে চাই।
-এখন কেন? জানুয়ারীতে আমরা নতুন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নিবো। 
-জি, আমি জানি। আমি 'লিটল স্টার কিন্ডার গারটেনে' পড়াই।
-ও আচ্ছা। তাহলে ওখানেইতো ও পড়াতে পারেন। এখানে কেন?
-আসলে আপা, ওর বাবা নেই। আমারও বাবা নেই। আমার মা বৃদ্ধা ও অসুস্থ। যে টাকা পাই তাতে কোন মতে চালিয়ে নেই। যে কারণেই আপনার এখানে পড়াতে চাই। তাছাড়া আমি শুনেছি যে এখানে বাচ্চাদের আলাদা করে যত্ন নেয়া হয় এবং ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। যেকারণে আমি এখানে পড়াতে চাই। আমার ছোট্ট মেয়েটি এখানে ভালো ও নিরাপদে থাকবে।
-অবশ্যই নিরাপদে থাকবে । জানুয়ারীতে আপনি মেয়েকে নিয়ে আসবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিবো ।

কথাগুলি শুনার পর আফসানার খুব ভালো লাগলো। প্রধান শিক্ষিকার কাছ থেকে বিদায় নিলো। 
-আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপা।
-আপনাকেও ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
-জি আপনিও ভালো থাকবেন।

বিদ্যালয়ের গেট থেকে বের হয়ে আফসানা বাড়িতে ফেরার জন্য হাটতে শুরু করলো। বটতলার মোড়ে একটি চা, পান ও  বিভিন্ন মনিহারি পণ্যের দোকান আছে। আজকে সেটা বন্ধ। কাছাকাছি  চার-পাঁচ জন বখাটে ধরণের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আফসানার বুক অজানা আশংকায়  কেপে  উঠলো। তবুও আফসানাকে বাড়ি ফিরতে হবে। রুবাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। মাও অপেক্ষা করছে। একজন বয়স্ক মা অপেক্ষা করছেন তার একমাত্র মেয়ের জন্যে। আর একজন ছোট্ট মেয়ে অপেক্ষা করছে তার মমতাময়ী মায়ের জন্যে। দু'জনের অপেক্ষার ধরণ একই রকম। আফসানা একবার ভাবলো একটু অপেক্ষা করবে। লোকজন নেই। একা একা যাবে! ছেলেগুলিকে কেমন যেনো নেশাগ্রস্থ মনে হচ্ছে। আবার ছোট্ট রুবাবা অপেক্ষা করছে। বিদায় নিয়ে আসার সময় বলেছিলো,
" মাগো! আজকে তুমি যেওনা। আমার ভালো লাগছেনা। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগেনা"।

কিছুটা এগোনোর পর ছেলেগুলি দৌড়ে আফসানার কাছে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো। আফসানার মুখ চেপে ধরলো। আফসানা নিজেকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। একসময় নিজেকে রক্তাক্ত অবস্থায় আবিস্কার করলো। একটা নির্জন পুরোনো বাড়িতে। আসে পাশে কেউ নেই। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাড়ালো। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।  যতটা পারলো নিজেকে ঠিকঠাক করে বাসায় ফিরতে চেষ্টা করলো।

চয়নদের বাসার পরের দু'তলা বাড়িটাতেই আফসানা মা ও মেয়েকে নিয়ে থাকেন। চয়ন দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সা থেকে আফসানকে অসুস্থ মানুষের মতো নামতে দেখে চয়ন প্রায় দৌড়েই আফসানার কাছে গেলো।
-কি হয়েছে আপা?
-কিছুনা। শারীরটা বেশি ভালো লাগছেনা।
-আমি আসি তোমার সঙ্গে?
-না থাক। আমি যেতে পারবো।
-তা হোক। দাও তোমার ব্যাগটা। আমি ঠিক বুঝতে পারছি, তুমি অসুস্থ। 

আফসানার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে আফসানার পিছন পিছন হাটতে শুরু করলো। চয়ন লক্ষ করলো যে, আফসানাকে বেশ অসুস্থ লাগছে। 
-আপা, তোমার কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন?
-আরে না। কিছু হয়নি আমার। তুই অযথাই ভাবছিস। 
-আচ্ছা চলো তাহলে।

দুজনে হাটতে শুরু করলো। বাসার কাছে এসে আফসানা বললো,
- তাহলে আমি যাই কেমন। তুই বাসায় চলে যা। খালাম্মাকে আমার সালাম জানাবি। তুইও সাবধানে যাবি। পৌঁছে আমাকে ফোন করে জানাবি।
-জি আপা। অবশ্যই।

 আফসানা সেদিন টিভিতে ওয়াইল্ড লাইফে যা দেখেছিলো। আজকে সম্ববত তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটলো। ওইল্ড লাইফে দেখানো হচ্ছিলো,

"একটি হরিণ ছোট বনের ভিতরের ছোট জলাশয়ে পানি খেতে এসেছে। একটি মাছরাঙা পাখি হরিণটিকে ভীষণ জ্বালাতন করছে। বার বার পাখিটি হরিণটির পিঠে এসে বসে হরিণটিকে শুড়শুড়ি দিচ্ছে। হরিণটি একটু বেশিই তৃষ্ণার্ত ছিলো। যে কারণে পাখিটির জ্বালাতন সহ্য করে খুব সাবধানে পানির দিকে মুখ বাড়ালো। তবে ভীষণ ভয়ে ভয়ে পানির দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলো। কারণ হিংস্র কুমিরেরা অত্যন্ত কৌশলে পানিতে নিরবে লুকিয়ে থাকে। হরিণ বা অন্য কোন প্রানীরা যখন পানি খেতে আসে , তখন তাদের আক্রমন করে এবং নিজেরা একসঙ্গে টেনে হিচড়ে, দুমড়ে মুচড়ে খুবলে খেয়ে নিজেদের ক্ষুদা নিবারণ করে।


কুমিরেরা এমন করে লুকিয়ে থাকে যে, আক্রমণ করার আগ পর্যন্ত কিছুই টের পাওয়া যায়না। তবে সব সময় যে এমনটা ঘটে তা না। শুধু মাত্র ক্ষুদা পেলেই এইভাবে আক্রমণ করে। হরিণটি খুব সাবধানে মুখ বাড়ালেও পানির নিচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলো কুমির। হরিণটিকে থাবা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরিণটি জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণপন চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে বাঁচাতে পারলোনা। এর পর পাশের জলাশয় থেকে আরো কিছু কুমির এসে হরিণটিকে ধরে নিয়ে গেলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হরিণটিকে টেনে ছিড়ে কুমিরেরা সবাই মিলে খেয়ে  ফেললো"।

আফসানাও নিজেকে বাঁচাতে খুব চেষ্টা করেছিলো। কিন্ত মানুষ যদি দানবের চেয়েও হিংস্র হয়, তখন মানুষের আর কি করার থাকে! কিছুই করার থাকেনা। আফসানা সমাজকর্ম বিষয়ে স্না্তকোত্তর করেছে। বাবা মারা যাওয়ার  পর রবিউলে মানে রবিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। কতো সুন্দর সুন্দর দিন কেটেছে ওদের দুজনের। সেগুলি এখন শুধুই স্মৃতি। রবি এখন অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা থাকে। মাঝে মাঝে মেয়ে রুবাবাকে দেখতে আসে। রুবাবা প্রায়ই বাবাকে প্রশ্ন করে,
-বাবা তুমি আমাদের সঙ্গে থাকোনা কেন? আগেতো রোজ আমাদের সংগে থাকতে।

মেয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে রবি কিছুই বলতে পারেনা। কি বলেবে? কি-ইবা বলার আছে? মেয়েকে ভুলানোর জন্য আরো বেশি আদর করতে থাকে। সবকিছু জানার পর চয়নের সুন্দর পৃথিবীটা দুলতে শুরু করলো। আর কতদিন এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি নারীর জন্য নিরপত্তার বিষয়টা এতো নিষ্ক্রিয় থাকবে? যে দেশের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী একজন নারী। সেই দেশের এমন দূরবস্থা কেন? স্থানীয় প্রশাসনেও অনেক নারী জনপ্রতিনিধি আছেন। তারাও নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এগিয়ে আসতে পারেন। দরকার শুধু স্বদিচ্ছা।

তবুও চয়ন বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে চায়। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য কলম দিয়ে লড়াই করতে চায়। বার বার কেবলি আফসানা আপার কথা মনে পরছে। আফসানা আপা যেনো বলছে,
" তুই বাসায় চলে যা। খালাম্মাকে আমার সালাম জানাবি। তুইও সাবধানে যাবি। পৌঁছে আমাকে ফোন করে জানাবি। আরে! আমার কিছু হয়নি। তুই অযথাই আমার জন্য ভাবছিস।" চলবে...

হুমায়ুন কবির
ঢাকা, বাংলাদেশ।