বোধ (Conscience) -ফরিদ তালুকদার
শান্তি (Bliss).. আমার বয়স ৫৭ বছর। আর আমার বোধের বয়স..? বলতে পারব না। আমার কাছের জন, কিছু কিছু প্রিয় বন্ধু এবং আরও অনেকের ধারণায় হয়তো বোধটা আমার এখনো আঁতুড় ঘরেই পড়ে আছে। আমারও যে তাতে দ্বিমত আছে তা নয়..! সবার মধ্যে কিনা জানিনা, তবে আমার মধ্যে সব সময়ই একটা শিশু বাস করে। আমি যে তাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি তাই নয়। মাঝে মধ্যে জনসমক্ষে, স্হান কাল পাত্র নির্বিশেষে প্রকাশ করে ফেলি বা জেনে শুনে সজ্ঞানে ই করি। আরও গভীরে গিয়ে বললে বলতে হয় কখনো কখনো আপন সত্তার কাছে নীরব চিৎকারে বলি আমি আবার শিশু হয়ে যেতে চাই…! হয়তো হয়ে যাবো কোন একদিন। যদি দূর্ভাগ্যক্রমে দীর্ঘায়ু পেয়ে যাই। যা আমার অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত কল্পনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বয়সের কথা দিয়ে শুরু করলাম কারন আজ থেকে ১০০ বছর, ৫০০ বছর, ৫০০০ বছর পূর্ব সমাজের সঠিক চিত্রটা তো আমার জানা নেই। ইতিহাস কিংবা চোখ বুঝে যতটুকু ধারণা পাই তার সত্যতাই বা কতটুকু? যখন জানি ইতিহাসের পাতাগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিজয়ীর হাতে তৈরী হয়। আর ভোঁতা দৃষ্টি থাকলে চোখ খুলে দেখলেই কি আর বুঝে দেখলেই বা কি? বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোরই সত্যতা অনুধাবনের জন্যে আদ্যোপান্ত খোঁড়াখুঁড়ি করতে গেলে যে চিত্র উঠে আসে তাতে তো সংশয়বাদী না হয়ে উপায় দেখিনা। আল কায়েদা কিংবা আইসিস এর মত সংগঠন গুলো তৈরী হওয়ার নেপথ্য কারিগর এবং মদতদাতা কারা এ তথ্য তো আমরা এখন প্রায় সকলেই জানি। তেমনি প্রশ্ন জাগে হিটলারের উত্থানের পথেও কি শুধু হিটলার ই দায়ী না এর জন্যে আরও নেপথ্যের কারিগর ছিলো? পৃথিবীতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরী করার উদাহরণ ও যেমন অসংখ্য তেমনি প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কিংবা ঘটনা বুমেরাং হলে নেপথ্য কারিগরদের হাতেই সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মৃত্যুর উদাহরণ ও ভুরিভুরি। এই সভ্যতায় নেপথ্যের কারিগরেরা ই সব সময় বেশী শক্তিশালী এবং তারা কদাচিৎ ই ধরা পড়ে।
যা হোক, বলছিলাম যে.. বর্তমানে আমরা এমন একটা সময় এবং সভ্যতায় বাস করি যেখানে অন্য প্রাণী তো দূরের কথা, মানুষের চেয়েও বস্তুর মূল্য অনেক অনেক গুন বেশী। হ্যাঁ, তবে অন্য প্রাণী যদি চিড়িয়াখানার হয়, যাকে দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করা যায়, ব্যবসা করা যায়, তাহলে আলাদা কথা। যেখানে এই পৃথিবীতে এখনো প্রতিদিন বিনা খাদ্যে, বিনা চিকিৎসায় হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে, সেই পৃথিবীতে, সেই দেশে, সেই স্হানের পাশেই হয়তো একটি কম্পিউটারকে সুস্থ রাখার জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থাকে..! বিষয়টাকে আরও একটু উপরের দিকে টেনে আনা যাক। বাংলাদেশের কথাই ধরি। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বা কোন কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানেও ছোট থেকে মাঝারি বেতনের যে কর্মচারীরা কাজ করেন, তাদের অনেকের কর্মক্ষেত্রে ই হয়তো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্হা আছে। এ ব্যবস্হা যতটা না কর্মচারীদের আরামের জন্যে তার চেয়েও বেশী অফিসের শো আপ বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি গুলোর সুস্বাস্থ্যের জন্যে। এখন,.. এই কর্মচারীরা ই যখন কাজে আসেন তাদের অনেককেই হয়তো মায়ের গর্ভ থেকে বেড়িয়ে আসার সেই সময়ের চেয়েও বেশী যুদ্ধ করতে হয় ব্যস্ত সময়ের একটি বাসে একটু জায়গা করে নিতে বা বাস থেকে বেড়িয়ে আসতে। বাসের মধ্যে গরম, ঘাম, রাস্তার যানযট তো আছেই। সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথের চিত্রেও কোন ব্যতিক্রম নেই। এর পরের যে সময়টুকু বিশ্রাম এবং ঘুমের জন্যে বরাদ্দ সেখানের চিত্রেও কিছু কমতি নেই। বাংলাদেশে এখন বছরের বেশীর ভাগ সময়টায় ই যে গরম পড়ে তাতে ছোট্ট আবাসনের ঐ জায়গাটুকু সারাদিনে তাতানো চুল্লীর ছোট সংস্করণ হয়ে থাকে। যেখানে ঢোকা মাত্র শরীরের মাংস মজ্জা সব গলে গলে পড়তে চায়। সারেঙ্গী-তবলার যুগলের মত এর সাথে থাকে মশকের দংশনী সংগীত। বাসায় ফ্যান থাকলেও হয়তো বিদ্যুত নেই। বিদ্যুত থাকলেও ফ্যান নিক্ষিপ্ত লু হাওয়ার অনুভূতি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে তবে কুইনাইন সারাবে কে’ কথাটি মনে করিয়ে দেয়..! এর সাথে ঘরে যদি থাকে দু' একটা ট্যাঁও বাচ্চা তাহলে তো হলোই..। রাতের হিসেবে আর কোন ঝামেলা নেই..! পরের দিনটা..? কাটা আঁটকে যাওয়া কলের গানের মত আবারও পূরণ রুটিন। এর মাঝেই বেতনের টাকার বিনিময়টা ষোল আনার জায়গায় সতের আনা বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয় ( সরকারি অফিসের বিষয়টা এখানে প্রযোজ্য নয়..! ) এভাবেই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, গোটা জীবন পার..! এদের আর দিন শ্রমিকের রক্ত ঘামেই গড়ে উঠছে টিনটেড গ্লাসের (tinted glass) আব্রুতে ঢাকা সব অট্টালিকা। শুধু তাই নয়, কৈ এর তেলে কৈ ভাজার মতোই এদের রক্ত শোষণের টাকায়ই হয় গবেষণা কিভাবে এই ধারা অটুট রাখা যায় অনাগত ভবিষ্যৎ জুড়ে। বাহ্.. ধন্য আমাদের এই সভ্যতা।
দেশ ছেড়ে বিদেশে হিজরত করার পূর্বে যেখানে ছোটখাটো একটা কাজ করতাম তা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি গ্রুপ অব কম্পানির ছোট শাখা। বিষয়টা একটুখানি প্রাসংগিক হতে পারে বলেই বলছি। এখানে আমাদের শাখায় যারা কাজ করতাম বছরের শেষে সবার ( আমারটা বাদে ) বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবিত সুপারিশটা আমারই তৈরী করতে হতো। তা প্রথম বছর যখন এই প্রস্তাব নিয়ে সি ই ও ( প্রধান নির্বাহী অফিসার ) স্যারের কাছে নিয়ে যাই প্রস্তাব পত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, গত ৪/৫ বছর ধরে তোমাদের এই শাখাটায় শুধু ভর্তুকিই দিয়ে এসেছি ( বলাবাহুল্য যোগদানের সময় তিনি বলেছিলেন যে, আমিতো এটা বন্ধ ই করে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার সাথে কথা বলার পরে মনে হলো আরও দু'টা বছর দেখবো ) আর তুমি এসেছো এমন একটা প্রস্তাব নিয়ে? জবাবে বলেছিলাম, স্যার ভর্তুকি ৫ বছর দিয়েছেন হয়তো আরও দু'বছর দিবেন আপনার সেই ক্ষমতা আছে কিন্তু একজন কর্মচারী যার সকালবেলা ঠিকমত নাস্তাটা খেয়ে আসার সামর্থ্য নেই, কাজে এসে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয় বিকেলে অসুস্থ সন্তানের ডাক্তার ওষুধের টাকাটা কোথা থেকে পাবে তাহলে তার দ্বারা কতটুকু সৃজনশীল শ্রম আশা করা যায়? স্যার পলকহীন ভাবে আমার দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকলেন। পরে সবুজ কালির কলমটা ( বছরের এই সময়টায় তার টেবিলে দু'টা কলম থাকতো। লাল কালি আর সবুজ কালি ) হাতে নিলেন এবং সবগুলো নামের সামনে চেক মার্ক করলেন। এরপরে যে ক’বছর ছিলাম স্যার আমার বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবিত অংক নিয়ে আর কখনোই কোন প্রশ্ন করেন নি। ১৮ বছরের মত হতে’ চললো দেশ ছেড়ে অন্য মেরুতে চলে এসেছি। স্যার পরলোকে। যতটুকু জানি ব্যবসায়িক সফলতার বিবেচনায় আমাদের সেই শাখাটি আর কখনো ঋণের অংক দেখেনি।
প্রথমবার বিদেশ পাড়ির সময় স্বল্প ভাষী জনক বলেছিলেন ‘ বাবা তোমরা দু'জন ই ( নব দম্পতি, ছয় মাসের প্রথম সন্তান সহ তিন জনের সংসার ) দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা, বাড়তি তেমন কোন দায় দায়িত্ব নেই, টাকার জন্যে তোমাকে কেন বিদেশ যেতে হবে..? শান্তি অন্য বিষয়। জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে কিন্তু তা দিয়ে শান্তি কেনা যায় না। তেমন আমল দেইনি। তবে বুঝতে খুব সময় লাগেনি। এয়ারপোর্টে সেদিন যখন ইমিগ্রেশন লাইনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলাম.. সে মুহূর্তের অনুভূতিটা শুধু যে সারাজীবনের জন্যে খোদাই হয়ে থাকবে মনের ভিতর তা ই নয়, সম্ভব হলে বের করে এনে বাঁধিয়ে রাখতাম। তরুণ বয়সে মজা করে বলতাম ‘ন্যাড়া বেল তলায় দু’বার যায়। প্রথমবার মাথায় পড়ে, আর দ্বিতীয়বার যায় সেটাকে তুলে আনতে। আমার অবস্হাটা সেরকমই। প্রথম হিজরতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরে দেশে ফিরে পাঁচ বছরের ব্যবধানে আবারও বাক্স পেটরা বাঁধার পালা। তবে এবার সপরিবারে। দ্বিতীয় হিজরতের গন্তব্য পৃথিবীর অন্যতম একটি সভ্য মানবিক দেশ কানাডা।
মানুষ (Homo sapiens).. আমাদের জিন ক্রোমোজমের মধ্যে ই আমরা যাযাবরের বৈশিষ্ট্য বহন করে বেড়াই। আমাদের পূর্ব পুরুষ, যারা তখনো ফসল উৎপাদন করতে শিখেননি, তারা অন্য প্রাণীদের মতোই খাদ্যের জন্যে এক স্হান থেকে আর এক স্হানে ঘুরে বেড়াতো। অন্য অনেক প্রাণীদের মধ্যে এখনো যেটা বর্তমান। ফসল উৎপাদন করতে শেখার পর থেকে আমরা ঘরবাড়ি বানিয়ে স্থিতিশীল জীবনের ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়াতে শিখেছি কিন্তু চরিত্রের মধ্যে যাযাবর তথা ভ্রমণ প্রিয়তা এখনো রয়ে গেছে। সভ্য আভরণের অন্তরালে রয়ে গেছে আরও অনেক পাশবিক প্রিয়তা (সময় হলে এ বিষয় নিয়ে অন্য কখনো আলোচনা করা যাবে)। যা হোক বলছিলাম যাযাবর প্রবনতার কথা। জীবনের ভিত্তি ভূমি ছেড়ে আমরা এখনো দেশান্তরি হই। কেউ হই সেই আগের মতই একেবারে ভাগ্যান্বেষনে, কেউ হই আর্থিক ভাবে আরেকটু ভালো থাকার জন্যে। কেউ হই দ্বিতীয় পাসপোর্ট নিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের স্ট্যাটাসটাকে আর এক ধাপ বাড়িয়ে নেয়ার জন্যে। কেউ হই তারুণ্যে, কেউ মধ্য বয়সে আবার কেউ আরও পরে। তবে এই উদবাস্তুতার (কেতাবী ভাষায় অভিভাসীত্বের) পিছনে সবারই তার মত করে কোন না কোন ব্যাখ্যা আছে। বাংলাদেশের মত দেশ থেকে অভিবাসী হওয়ার পেছনে বেশীরভাগেরই উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং সাথে সামাজিক নিরাপত্তা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা আমরা পেয়েও যাই। কিন্তু জীবনের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শব্দটি তা হলো শান্তি। এই অধিকাংশের আমরা সবাই কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে অভিবাসী হওয়ার পরে আমাদের জীবনের শান্তি বৃদ্ধি হয়েছে..? কানাডায় আসার পরে বেশ বড় সড় একটা সংখ্যার অভিবাসীদের দেখে মনে হয় তারা পূরণ ঠিকানা ছেড়ে নূতন ঠিকানার সন্ধানে ছুটে বেড়ান ঠিকই কিন্তু নিজের মনোজগতে বসতের ঠিকানাটাই কোনদিন চিনেন না! সারাজীবন শুধু বেহালার তারে সুর খোঁজার মত একবার এ মাথা আরেকবার ও মাথা করেন কিন্তু প্রয়োজনীয় সুরটি সারাজীবন নাগালের বাইরেই থেকে যায়। কিছুদিন দেখি চাল চলন, পোশাকে আশাকে পশ্চিমাদের ও লজ্জা দিয়ে দেন। তারপরেই আবার দেখা যায় হিজাবের আধিক্যতায় ওয়াহাবি মুসলিমান্ত প্রাণদের ও হারিয়ে দেন। কখনো কখনো এমন পরিবর্তন চলতেই থাকে..! আরেক শ্রেণী আছেন যাদের একটি গোত্র পিছনে ফেলে আসা দেশে এমনিতেই বিত্তশালী আর অন্যটি এখানে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দেশেই বিত্ত গড়েন। অভিবাসী দেশের সবরকম সুযোগ সুবিধা শুধু নেন ই না অপব্যবহারও ( Abuse ) করেন কিন্তু নূতন দেশটিকে কখনো আপন ভাবেন না। বিষয় টা যেন স্বর্গে থেকেও তাকে আপন না ভাবা। এই দুই গোত্রের জীবন যাপনে একটি বিষয়ে খুবই সামঞ্জস্য রয়েছে। দুই পার্টি ই এদেশ – সেদেশের মধ্যে এতোই ছাফা – মারওয়া করেন যে হজ্জ পালন না করলেও হয়তো আল্লাহ এদের বেহশত নিশ্চিত করে দিবেন..! তবে একটা সমস্যা হতে পারে, বেহেশতে গিয়েও যদি এনারা বেহেশত আর দোজখের মাঝে এমন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন তখন আল্লাহ নিশ্চয়ই একটু নারাজ হবেন। দুই দেশেই এদের সুরম্য সুন্দর বাসস্থান থাকে। কিন্তু এর কোথাও তাদের ভালো ঘুম হয় কিনা সন্দেহ। জীবনের অনেকটা সময়ই যে এদের কেটে যায় এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে আর আকাশের জেলখানায়..!
ছোট বেলায় পড়েছিলাম..
“কোথায় স্বর্গ?
কোথায় নরক?
কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর”
--- শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২ – ১৯৩৬, লালমনিরহাট, বাংলাদেশ)।
খুবই খাঁটি কথা। পরীক্ষা পাশের জন্যে ব্যাখ্যা মুখস্থ করে ফেললেও তখন আসল মর্মার্থের সিকি ভাগও বুঝিনি। মর্তের এই মাটিতে থেকে নিজেদের মনোজগতে যদি আমরা শান্তির স্বর্গ গড়তে না পারি তাহলে সেই মন নিয়ে মৃত্যুর পড়ে সম্পূর্ণ কল্পিত সেই স্বর্গে গিয়েও বিশেষ কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না।
মনোজগতের এই স্বর্গ কিভাবে গড়বো তা প্রতিটা মানুষকে নিজের মত করেই খুঁজে বেড় করতে হবে। তবে একটা বিষয় হলফ করে বলা যায়, কেবল অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে এই শান্তির স্বর্গের মালিক হওয়া যায় না। হ্যাঁ.. ছোট্ট এই জীবনে সুস্থ শান্তির এমন একটা আবহ তৈরী করতে অবশ্যই কিছুটা অর্থ স্বচ্ছলতার দরকার আছে। কিন্তু সেটা খুব বেশী অংকের নয়। আর এই স্বচ্ছলতাটুকু চারপাশের সবার জীবনে থাকাটা আর একটা আবশ্যিক ব্যাপার। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় অক্ষত থাকে না। পূরণ কথা। চারপাশের মানুষকে অভুক্ত আশ্রয়হীন রেখে শুধু নিজের জন্যে তাজমহল গড়লে সে তাজমহলে পরিশুদ্ধ শান্তির বাতাস আশা করা বাতুলতা। যে চিত্রটা এখন বাংলাদেশের মত দেশ গুলোতে পরিস্কার। মোদ্দা কথা, শীলমারি গ্রামের কোন এক মিসির আলী সারাদিন হার পরিশ্রমের পরে সন্ধ্যার দাওয়ায় বসে তার সাজানো হুক্কায় টান দিয়ে যে সুখ, যে শান্তি পায়, উন্নত বিশ্বের আমার জীবনে আমি যে তার চেয়ে খুব বেশী কিছু শান্তিতে আছি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
মনে হচ্ছে আমাদের সমাজে বিরাজমান অশান্তির দীর্ঘ এই ছায়ার চেয়েও আমার প্রবন্ধের অবয়ব বড় হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং প্রসংগে ফেরা যাক। যা বলছিলাম.. আমরা এই সভ্যতাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছি যেখানে অর্থ, ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির লোভ সর্বগ্রাসী। এমনকি ঈশ্বর গ্রাসী। এটা বলছি কারন যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, ভয় পান তারাও এই লোভের বশবর্তী হয়ে জেনেশুনে সব ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছেন দিন রাত। লেখার পরবর্তী অংশটা আমার পূর্বের একটি লেখার কিছুটা অনুরণন মনে হতে পারে। তা হোক। তারপরও লিখছি। হয়তো লিখেই যাবো, একনায়ক শাসক, শোষক তথা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আজন্ম প্রতিবাদের মত।
আমার মনে হয় অর্থের গ্রহন বলয়ের এই পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরা। ফ্যাক্টরির কনভেয়র বেল্টের সামনের দিকে একটা বাক্স যেমন, জন্মের পর থেকেই আমাদের সন্তানদের আমরা যেন তেমনি একটা অবস্হানে ফেলে দেই। যেখানে সারি সারি দাঁড়ানো ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের মতোই (যারা বাক্সগুলোর বিভিন্ন অংশের ফিনিশিং টাস্ দেয়) স্কুলের বাইরের সময়টুকুতে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অংক, ইংলিশ, বিজ্ঞানের প্রাইভেট শিক্ষকেরা। সুরঙ্গের মধ্যে একটি কনভেয়র বেল্টের উপর ছোটে আমাদের সন্তানেরা। ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট হিসেবে যখন বেড়িয়ে আসে, তখন তাদের জীবনে একটিই মাত্র লক্ষ্য থাকে এবং তা হলো অর্থ উপার্জন করা..! দু' একটা ভাঙা কিংবা বেল্টের পথ থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া বাক্সের মতোই এদের মধ্যে কেউ কেউ এই মানসিক চাপ নিতে না পেড়ে হয়ে যায় একরকম মানসিক রোগী অথবা দ্রুতই পুড়ে শেষ হয়ে গিয়ে জীবনের সুস্থ কক্ষপথ থেকে ছিটকে যায় চিরতরে..! বলাবাহুল্য, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক আমি নিজেও এমন পিতা-মাতাদের একজন। কারন..? শঙ্কা..! সন্তান জন্মানোর পরেই আমাদের শঙ্কায় পেয়ে বসে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। এবং সেই নিরাপত্তার সর্ব প্রথম নিয়ামক..? অর্থ..! এই শঙ্কার কারনেই আমরা আমাদের সন্তানদের মানুষ থেকে এক রকম অমানুষ হবার কারখানায় ফেলে দেই। এই শঙ্কার কারনেই আমরা সবাই একশো মিটার দৌড়ের রেস ট্রাকে টানা রেখার গন্ডীর পথে নিয়ত ছুটতে থাকি। কেউ শুধু বেঁচে থাকার জন্যে, কেউ অতিরিক্ত লোভের বশবর্তী হয়ে। আর পৃথিবীর দানব কর্পোরেটরা অদৃশ্য সব চাবুক হাতে আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়..! ছুটতে ছুটতে আমরা গোটা পৃথিবীটাকেই নিয়ে এসেছি ভয়ংকর এক শঙ্কার উপত্যকায়। অনতিদূরেই যার ওঁৎ পেতে আছে এক অতলান্ত গিরিখাদ..!
হয়তো এখনই সময় একবার থমকে দাঁড়ানোর। আমাদের আপাতঃ প্রয়োজন, বাহুল্য প্রয়োজনের মত চাবুক গুলোকে উপেক্ষা করে একবার থমকে দাঁড়ানো। বিশেষ করে যারা বাড়তি লোভের বশবর্তী হয়ে ছুটছি। শুধু ছুটেই লাভ নেই। ছুটেই শান্তি নেই..! প্রয়োজন একবার পিছন ফিরে তাকানো। একবার জীবনের সঠিক হিসেবটা করা। কতটা পেয়েছি আমরা..? আরও কতখানি চাই..? তা না হলে আন্তন চেখভের “কতটুকুন জমি চাই” গল্পের সেই লোভী কৃষকের মতোই হয়তো হবে আমাদের ভবিতব্য..! এবং সেই অনিবার্যতা এখন প্রায় স্পষ্টই আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীর এই অবয়বে..!!
ফরিদ তালুকদার । কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
25-08-2019
-
-