বাংলা সংস্কৃতিময় অটোয়া -সুপ্তা বড়ুয়া
কানাডার রাজধানী অটোয়া যেন বাংলা সংস্কৃতির ধারক আর বাহক হয়ে উঠছে দিনকে দিন। জমজমাট হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন! কেন বললাম? এ শহরে নিয়মিত আয়োজন হয়ে চলেছে বাংলা সঙ্গীতসন্ধ্যা, গীতিনাট্য এমনকি বিখ্যাত বাংলাদেশী ব্যান্ডেরও অনুষ্ঠান। মনেই হবে না দেশ থেকে বহুদূরে উত্তরমেরুতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে। দেশজ সংস্কৃতির সুবাস দিতেই বুঝি পুরো সেপ্টেম্বরে মাস জুড়েই সরগরম ছিলো অটোয়ার বাংলা ভাষাভাষী কমিউনিটি’র সংস্কৃতি অঙ্গন।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা আশ্রমের আয়োজনে অটোয়ার প্রিয়মুখ ডালিয়া ইয়াসমিন নিয়ে এসেছিলো সঙ্গীতসন্ধ্যা। ডালিয়া ইয়াসমিন অটোয়ায় বেশ জনপ্রিয় একজন শিল্পী, অতি অল্প সময়ে তিনি বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন বাংলা কমিউনিটিতে। ডালিয়া ইয়াসমিনের একক সঙ্গীতাসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর, কার্লটন ইউনিভার্সিটি’র কৈলাশ মিত্তাল থিয়েটারে। সেদিন ডালিয়া ইয়াসমিন সুরে-সুরে ভরিয়ে তোলেন সব দর্শকদের মন। অনুষ্ঠানের শুরু হয় জনপ্রিয় গান ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না', তারপর ডালিয়া ইয়াসমিন একে একে গেয়ে শোনান ‘বরিষ ধারা মাঝে', ‘এই মন তোমাকে দিলাম', ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’, দমাদম মাস্ত কালেন্ডার' ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম' ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা' সহ আরো অনেক গান। অনুষ্ঠানে ডালিয়া ইয়াসমিনের মৌলিক গান ‘প্রেমের নৌকা’সহ কয়েকটি গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করে, প্রীতিকা মনসুর, উসরা রহমান, সাবিদা উদ্দিন, বাশিরা নাওয়ার তাহিয়া এবং আলিসিয়া ইকবাল, লামিয়া আঞ্জুম ইসলাম, যার কোরিওগ্রাফি করেন অটোয়ার আরেকজন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী ঈশিতা নাসরীন খান।
ডালিয়া ইয়াসমিন একাধারে নজরুল, দেশাত্মবোধক, বাংলা চলচ্চিত্রের গানসহ জনপ্রিয় সব বাংলা গান পরিবেশন করেন। এছাড়াও শিল্পী তার কয়েকটি মৌলিক গানও পরিবেশন করেন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের শেষাংশে ডালিয়া ইয়াসমিনের ছেলেঃ রাজিন এবং মেয়েঃ আালিসিয়া একটি গান পরিবেশনা করেন। নিজের সন্তানদেরও শেকড়ের সাথে সংযোগ স্থাপনের শিল্পীর এ প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। তার এই উদাহরণ অন্যান্য পিতামাতাদেরও উদ্ধুদ্ধ করবে নিজেদের সন্তানকে একই রুপে গড়ে তুলতে। তাছাড়া পুরো অনুষ্ঠানেই অটোয়ায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের বাঙালী ক্ষুদে শিল্পীদের অংশগ্রহণে ছিলো ঝলমল। ডালিয়া ইয়াসমিনের জন্য অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় উপহার ছিলো, তার পিতা ‘ইউসুফ আলী'র উপস্থিতি।
ডালিয়া ইয়াসমিন খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন প্রায় ৫ বছর এবং রবীন্দ্রসংগীতের উপর বিশেষ দখল রয়েছে তার। ‘ছায়ানট’ আর বিখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষক নন্দ দুলাল রায়ের কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন এই শিল্পী। নিয়মিত সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি বর্তমানে ‘হেলথ কানাডা'য় ডাটাবেজ এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে চাকুরিরত রয়েছেন এই গুণী শিল্পী।
সংস্কৃতির আরেক শাখা নৃত্য নিয়ে সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ সেই কৈলাশ মিত্তালেই বসলো ‘নৃত্যশালা’ আয়োজিত এবং ইন্দ্রাণী চৌধুরীর পরিচালনায় ‘হরিখেলা’ গীতিনাট্য। রবীন্দ্রনাথের ‘হরিখেলা’ কবিতার উপর ভিত্তি করে গীতিনাট্য ‘হরিখেলা’ -ভালোবাসা, প্রতিশোধ, প্রতিফলের উপকথা। এই কবিতার গীতিনাট্যে রূপ দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় শ্রীমতি ঝর্ণা চ্যাটার্জী। আয়োজনের প্রথমাংশ শুরু হয় নৃত্যশালার ক্ষুদে শিল্পীদের পরিবেশনায় কত্থক আর ভজনের মিলিত পরিবেশনায়। জুনিয়র নৃত্যশিল্পীরা হলোঃ চন্দ্রিমা, তাকবীর, আনাহি, সামারা এবং নাবিহা। এর পরপরই ইন্দ্রাণী চৌধুরীর পরিচালনায় Indo-Canadian Cultural Centre-এর বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের পরিবেশনায় ভারতের নয়টি প্রদেশঃ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, কেরালা, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা এবং পাঞ্জাবের ‘নবরাত্রি’ উদযাপনে নারী-পুরুষের বাহারী সাজসজ্জা-গহনার উপর অটোয়ায় প্রথম ও বিরল এক ফ্যাশন শো রুপে তুলে ধরা হয় মঞ্চে। ধারাভাষ্যে ছিলেন অনিন্দ্য চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শেষাংশে পরিবেশন করা হয়, গীতিনাট্য ‘হরিখেলা’, মূলত একটি ভালোবাসার রুপকথা মনে হলেও, আসলে একটি প্রতিফল আর প্রতিশোধের কাহিনী তুলে ধরা হয় গীতিনাট্যে। দুঃসাহসিক রাজপুত নারীদের প্রতিশোধ আর পাঠান নবাবের প্রতিফল প্রাপ্তির এক অনন্য সংযোজন ছিলো। ভূনাগ রাজার রাণীর চরিত্রায়ণে ইন্দ্রাণী চৌধুরী আর পাঠান নবাব কেশর খাঁ চরিত্রায়ণে অঙ্কিতা বাগচী! গীতিনাট্যের ধারাভাষ্যে ছিলেনঃ সৌমি গুহ আর আর্য মুখার্জি!
অসাধারণ অভিনয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুষ্ঠান, পূর্বের তিনটি গীতিনাট্যেরই ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্র রচনাবলীর একনিষ্ঠ ভক্ত আর গুণগ্রাহী ইন্দ্রাণী চৌধুরীর পূর্বাপর গীতিনাট্যগুলোও ছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পদাবলী', ‘চন্ডালিকা’ আর ‘চিত্রাঙ্গদা’ উপর ভিত্তি করে! এই গুণী শিল্পীর নৃত্যকলা মূলত পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতীয়, মনিপুরী, কত্থক, রাবীন্দ্রিক ঘরানার, যেটা অটোয়ায় সবার বিশেষ নজর আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছে!
কলকাতায় জন্ম আর বেড়ে ওটা এই গুণী শিল্পীর রয়েছে ২৮ বছরের নৃত্যর শিক্ষিকা হিসেবে অভিজ্ঞতা, যার মধ্যে ১৬ বছর ধরে উনি ভারতের বাইরেও নাচের পাঠ দিয়ে গেছেন ইউকে, ওমান এবং বর্তমানে কানাডায়। ইন্দ্রাণী চৌধুরীর ‘নৃত্যশালা’ অটোয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করে চলেছে, উল্লেখযোগ্যঃ Bangladesh day on Parliament Hill, Holi and Diwali on Parliament hill, India Day, Tulip Festival at Landsdowne Park, The Great India Festival, Ekushey February by Bangladesh High Commission and many more ! ‘নৃত্যশালা’ অটোয়ায় বাংলা সংস্কৃতি বিকাশে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। আশা করি এই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও দর্শকদের নিত্যনতুন পরিবেশনায় মুগ্ধ করে রাখবে ইন্দ্রাণী চৌধুরী তার ‘নৃত্যশালা’ নিয়ে !
এদিকে, ওই দুটো অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ অটোয়া মাতিয়ে গেলো বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যান্ডদল ‘মাইলস’। এটাই অটোয়ার বুকে কোন বৃহত্তর, জনপ্রিয় ব্যান্ডের প্রথম সফর। ব্যান্ডের যেসব গান শুনলেই বাঙালীরা নস্টালজিক হয়ে পড়ে, ফিরে যায় দুরন্ত কৈশোর-যৌবনে ‘মাইলস’এর অসংখ্য কালজয়ী গানও উল্লেখযোগ্য। ‘মাইলস' এমন একটি নাম যার পাশে বিশেষণ, ব্যাখ্যা সবই তুচ্ছ, কারণ এই একটা নামেই যেন অনেক অনেক না বলা শব্দের মেলবন্ধন! অটোয়ার « সিন্ডিকেট ৭১ » নামের একটি সংগঠন এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
পর্দা ওঠার সাথে সাথে সারা ‘কৈলাশ মিত্তাল হল' যেন উল্লাসে ফেটে পড়ে। আমরা বুঝি তখন সবাই এই উত্তরগোলার্ধ থেকে ছুটে গেলাম নিজভূমে, আমরা সবাই ফিরে গিয়েছিলাম দেশের মাটিতে সেই উচ্ছ্বাসময় যৌবনে। ‘জ্বালা জ্বালা' গানের সুর আর গানের ছন্দে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো পুরো থিয়েটার। একে একে গেয়ে চলে শাফিন আহমেদ আর হামিন আহমেদ ‘যাদু’, ‘পাহাড়ী মেয়ে’ ‘হারানো প্রেম' ‘আর কতকাল খুজবো তোমায়', ‘প্রিয়তমা মেঘ’, ‘নীলা’, ‘চাঁদ-তারা’, ‘পিয়াসী মন', ‘ধিকি ধিকি’, ‘ফাস্ট্রেশন’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান। এক নাগাড়ে গেয়ে চলেছিলেন শাফিন আর হামিন, আমরা যেন মোহিত হয়ে ছিলাম কোন হেমিলনের বাঁশিওয়ালার যাদুতে, এটা যেন সঙ্গীত আয়োজন ছিলো না ঠিক, ছিলো নিজেদেরকে নিজের ফেলা আসা সুবর্ণ অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা সন্ধ্যা। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো শাফিন আর হামিন যখন গানগুলোর বিষয়েও ভীষণ চমৎকার সব তথ্য দিচ্ছিলো। যেমন এতকাল যদিও আমরা ভেবেছি ‘আর কতকাল খুজবো তোমায়' গানটি প্রেমের গান, আসলে শাফিন আহমেদ ব্যাখ্যা করলেন এই গানটি সৃষ্টির স্রষ্টাকে খোঁজার প্রয়াস। গান যখন হয়ে ওঠে শিল্পী আর দর্শকের বন্ধন, তখনই মনে হয় সৃষ্টির মহত্ত্ব নিয়ে কোন প্রশ্নই থাকে না।
সেকারণেই হয়তো একটা বিরতি দেওয়াতে দর্শকদের মাঝে আফসোস সৃষ্টি হয়, সেই আফসোস ছড়িয়ে পড়লো শাফিন আর হামিন আহমেদের কন্ঠেও। তাই তো দ্বিতীয়ার্ধে তিন-চারটা গান গাওয়ার পর যখন পর্দা নামলো দর্শকদের যেন আশ মিটলো না, কে চায় বলুন এমন যৌবন হারিয়ে ফেলতে। ‘ফিরিয়ে দাও' গানের সাথে যখন অনুষ্ঠান শেষ হলো, আমাদের সকলেরই যেন আকুলতা ‘ফিরিয়ে দাও' সেই ছায়াময়-মায়াময়-উন্মাতাল কৈশোর-যৌবন, সবাই যেন আমরা সত্যিই বলছি ‘এভাবে চলে যেও না!’
অটোয়ায় নিত্যনতুন অনুষ্ঠান হয়েই চলেছে, যেমন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহান্তে দূর্গা পূজার উৎসবে মুখর ছিলো অটোয়া আর এই দূর্গা পূজোয় ক্ষুদে শিল্পীদের পরিবেশনায় ছোটদের নাটক ‘তাসের দেশ' মঞ্চস্থ হয় দেশান্তরীর প্রযোজনায়। তাছাড়া আগামী ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশী কমিউনিটি ‘অটোয়া হোপফাউন্ডেশন’এর জন্য একটি ফান্ডরেইজিং ইভেন্ট-এর আয়োজন করেছে, যেটি উৎসর্গ করা হচ্ছে প্রয়াত জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পী, কিংবদন্তি ‘আইয়ুব বাচ্চু'কে। কানাডা সরকারকে এমন মহতি আর অর্থপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানটি সহায়তা করবে নিজের শেকড়কে বুকে ধারণ করে। আমরা সত্যিই গর্বিত অনুভব করছি এমন মহতি উদ্যোগ দেখে। আশা করি সকলের অংশগ্রহণে এই মহৎ উদ্যোগটি সাফল্য লাভ করবে।
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া
-
নিবন্ধ // মতামত
-
12-10-2019
-
-