আমাদের অসহিষ্ণু সমাজ -সুপ্তা বড়ুয়া
২০১৫ সালের শুরুর দিকে, মানে জানুয়ারিতেই অভিজিৎ রায়ের একটা বই পড়তে শুরু করেছি, যদিও খুব কমই জানতাম তার সম্পর্কে। মূলত অভিজিৎ রায়ের বইটা পড়তে শুরু করার পেছনের কারণ ছিলো, আমাদের এই শহরেই বসবাস করা আরেকজন প্রথিতযশা মানুষ মিজানুর রহমানের সদ্য প্রয়াণ। মিজানুর রহমান সম্পর্কে পড়তে গিয়েই অভিজিৎ রায় সম্পর্কে জেনেছিলাম। অভিজিৎ রায়ের লেখা বইয়ের মধ্যে আমার পড়া প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'। পদার্থবিজ্ঞানকে এমন সহজ সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্য এমন একজন মানুষ উদ্যোগ নিয়েছে দেখেই উনার প্রতি এত কৃতজ্ঞতা আমার, যা'র অনুভূতি কখনো নষ্ট হবে না। আমি কি তখনো জানতাম, আর মাত্র মাস খানেক পরেই, এ মানুষটাকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে হবে ?
অন্যায়-অপরাধকে যেকোন উপায়ে এড়িয়ে কেন যাচ্ছি আমরা ? সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো, আমরা আধা সত্য বলবো (যেটা মিথ্যার’ই নামান্তর), আধা ন্যায় পথে চলবো। সত্য যখন আমাদের জন্য সুবিধাজনক মনে হবে তখন সত্য বলবো আর সত্য যখন বিপদজনক হবে তখন ‘যদি, কিন্তু, তারপর' লাগাবো। আমরা অভিজিৎ রায়কে ভুলে গেছি, অনন্ত বিকাশ, ওয়াশিকুর রহমান, নীলয় নীল, প্রকাশক দীপন সকলকে ভুলে গেছি৷ আজ আবরার হত্যায় যারা হা-হুতাশ করেছে, তারা ভুলে গেছে এই অভিজিৎ বুয়েটের’ই ছাত্র ছিলো। তখন বুয়েটে কি এভাবে প্রতিবাদ হয়েছিলো, নিকট অতীত ২০১৮ সালে যে ছাত্র আন্দোলন এক বিরাট পথ পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারতো, সেই আন্দোলনও যখন ভন্ডুল করে দেওয়া হলো, তখন কি বুয়েটের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এইভাবে প্রতিবাদ করেছিলো? (এই লেখা শেষ হতে হতে, অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু বিচার কি হবে?)
যারা আবরার হত্যায় প্রতিবাদ করেছে, তাদের বিরাট অংশই একদিন গুণী লেখক-প্রকাশকদের হত্যাকে জায়েজ করেছে। আজ তারা বলছে, লেখার জন্য কাউকে হত্যা করা যায় না, অথচ তারাই অভিজিৎ, নীলয়, অনন্তদের ক্ষেত্রে বলেছে, ‘হ্যাঁ, লেখার জন্যও মানুষ হত্যা করা যায়’। সেই লেখা প্রকাশের জন্য প্রকাশককেও হত্যা করা যায়, এমনকি সমকামী হওয়ার জন্য জুলহাস ও তনয়কেও হত্যা করা যায়, আপনার ধর্মের জন্য আপনাকে হত্যা করা যায়, আপনার ভিন্ন জাতিসত্তার হলে আপনাদের কন্যাদের ধর্ষণ করা যায়, ছেলে ধরা সন্দেহ হলেই কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করলেই তার উপর প্রতিশোধস্বরুপ তার স্বামীকে হত্যা করা যায়, কেউ সম্পর্ক স্থাপনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেই তাকে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে মারা যায়, ধর্ষণ শেষে শিশুদের হত্যা তো করা তো একদম নৈতিক দায়িত্বই বলতে পারেন।
আসলে ব্যাপারটা আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে যে, প্রতিটি অন্যায় হওয়ার পর, আমরা হিসাব নিকাশ করতে বসবো কার বিরুদ্ধে অন্যায় হলো, সে কোন ধর্মের ছিলো, কোন বর্ণের ছিলো, নারী কি পুরুষ ছিলো। আমাদের এত হিসাব নিকাশ করতে করতে আরো কয়েকটি অন্যায় হয়ে যাবে! যতক্ষণ সমস্যায় আমরা নিজেরা ভুক্তভোগী নই, ততক্ষণ আমাদের যে কোন অন্যায়কে জায়েজ করতে কারণ দর্শাতে কোন জুরি নেই। তবে ‘Injustice anywhere injustice everywhere'! আশা করি, আমাদের জাতিটি জার্মান কবি মার্টিন নিম্যোলার “ওরা প্রথমতঃ এসেছিলো” এই কবিতাটির প্রতিটি লাইন একদিন উপলব্ধি করতে পারবে!
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিলো,
আমি কোন কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই!
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেলো,
আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই!
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই!
আবারও আসলো ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বললো না,
কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিলো না।
(মার্টিন নিম্যোলার - ওরা প্রথমতঃ এসেছিলো)
এই বছরের আলোচিত কয়েকটি হত্যাকান্ড দেখুন। এক মা'কে পিটিয়ে হত্যা করলো ছেলে ধরা সন্দেহে। রিফাত নামের ছেলেটাকে কুপিয়ে মারলো নয়ন বন্ড, নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হলো আর মিন্নী মেয়েটাকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের টানাহেঁচড়া। এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো, বিচারও হলো। কিন্তু কি লাভ, মানুষের নৃশংসতার রুপ আমরা দিনকে দিন দেখছি, তাতে করে সমাজকে আমরা কিংবা সমাজ আমাদের কি ইঙ্গিত দিচ্ছে?
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি বাক স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। আপনি মানুষকে যতই অন্ন, বস্ত্র দিয়ে সন্তুষ্ট রাখুন না কেন, মানুষকে যদি তার মত প্রকাশ করতে না দেওয়া হয়, তবে মানুষ একদিন গোলাবারুদ হয়ে ফোটে। একবার চিন্তা করুন, বাঙালীরা প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো ভাষার উপর আঘাতে। বলা যায় সম্মিলিত আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে ভাষার উপর আঘাতেই। সেই জাতি আমরা, তাহলে কি করে আমরাই মুক্তমত প্রকাশে এরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সমর্থন করি? ফেসবুকে একজন লিখলো, ‘আজ আবরার হত্যায় আমরা কাঁদছি। কিন্তু এই আমরাই এই মতটাকে স্থায়িত্ব দিয়েছি, মত প্রকাশের জন্যও কাউকে হত্যা করা যায়’। তাহলে আমরা এত কাঁদছি কেন?
মাঝে মাঝে আমি ভীষণ দুমড়ে মুষড়ে পড়ি সমাজের এমন আচরণ দেখে। দিনকে দিন অসহিষ্ণুতা যেন আমাদের জাতীয় চরিত্রে রূপ নিয়েছে। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ, কিন্তু সেই পাপই আমার উপর আরোপিত হয় নিজের শেকড়ে যখন আস্থা রাখতে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছি! ভিন্ন মতকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে আমরা শিখি নি, ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করতেও আমরা জানি না! কলমের প্রশ্নের উত্তর ছুরি দিয়ে আঘাত করে, হত্যা করে দেওয়া যায় না।
এ সমাজের কাছে কি আশা করা যায়?
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া
-
নিবন্ধ // মতামত
-
17-11-2019
-
-