একজন দেশপ্রেমিকের দীর্ঘ ছায়াতে -মীজান রহমান
‘মীজানভাই, দেশে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্যে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। দোয়া করবেন’।
কদ্দিনের কথা সেটা? দুমাস? বড়জোর তিন?
তারপর শুনি তিনি নেই। রফিকুল ইসলাম চলে গেছেন। না, দেশে নয়। তার চেয়ে অনেক দূরের এক দেশে, যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরেনা।
ভাগ্যিস লোকটার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল আমার। নইলে কেমন করে জানতাম সাধারণের ছদ্মবেশে একজন অসাধারণ মানুষকে কেমন দেখায়। কেমন করে জানতাম দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষুদ্রতার কর্দমাক্ত পথের ওপরও একটি বিশাল ব্যক্তির পদচিহ্ন আঁকা হতে থাকে অলক্ষ্যে? হ্যাঁ এই লোকটি ছিলেন তাই। অবিশ্বাস্যরকম সহজ সরল একটি মানুষ। সামান্য অস্তিত্বের আড়ালে একজন অসামান্য পুরুষ।
আমি রফিকুল ইসলামকে চিনি প্রধানত দেশপ্রেমিক হিসেবে। পাঠক হয়ত বলবেন, কেন আমরা কি দেশপ্রেমিক নই? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, দেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি। তবে রফিক ইসলামের মত করে নয়। অন্ততঃ আমি যে তা নই সেটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। আমার দেশপ্রেম অনেকটা বক্তৃতামঞ্চে, মুখের বুলিতে, বড়জোর কাগজে-কলমে। কাজে নয়। রফিকসাহেবের পুরোটাই তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল একবার তাঁর ভ্যাঙ্কুভারের বাড়িতে গিয়ে একরাত থাকার, তাঁর অসম্ভব গুণবতী স্ত্রী বুলি ও তাঁর উষ্ণ আতিথেয়তায়। পুরো সময়টাই আমার কাটলো সেখানে একপ্রকার ঘোরের মধ্যে----তাঁর মুখ থেকে দেশের কথা শুনে শুনে। দেশের জন্যে আমরা কি করতে পারি বিদেশ থেকে, কিভাবে আমাদের অভাগা দেশটির দ্রুত অধঃপতনের পথে একটু আশা সঞ্চার করতে পারি, আগামি প্রজন্মের প্রাণে কেমন করে জাগাতে পারি নতুন চেতনা, নতুন উদ্যম উদ্দীপনা, সারাক্ষণ এই নিয়েই কথা বললেন তিনি। কত যে প্ল্যান-পরিকল্পনা তাঁর।
রফিকুল ইসলাম নামটি বাংলাদেশের শিক্ষিতজন কারো কাছেই অজানা নয়। তাঁর এই ব্যাপক খ্যাতির প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস----২১ শে ফেব্রুয়ারি। এটা মূলত তাঁরই সৃষ্টি। দেশের কথা ভাবতে ভাবতেই নব্বুই দশকের শেষের দিকে কোন একটা সময় তাঁর মাথায় উদয় হয়েছিল এই চিন্তাটি। তার স্বল্পকাল আগে তিনি সপরিবারে অভিবাস গ্রহণ করেছিলেন ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে, তাঁর বড় এক ভাই লুৎফর রহমানের সৌজন্য ও সহায়তায়। তাঁদের ঢাকা থেকে ক্যানাডায় পোঁছুনোর দিনটাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ---১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯৫ সাল। এই দিনটির জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব কতখানি সেটা তো কাউকে বলে দিতে হবে না, কিন্তু ওঁদের পারিবারিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এর তাৎপর্য অপরিমেয়। প্রথমত রফিকুল ইসলামের বাবা মারা গিয়েছিলেন ওই তারিখে। দ্বিতীয়ত তিনি এবং তাঁর একবছরের ছোট আরেক ভাই, সাইফুল ইসলাম, দুজনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। রফিকুল ইসলাম ফিরে এসেছিলেন সৌভাগ্যক্রমে, কিন্তু ছোট ভাইটির ফেরা হয়নি, দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি। অতএব সেই দুর্বহ স্মৃতি, সেই অসহ্য বেদনাময় আখ্যান, যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, সেটা যে কতখানি গভীর একটা দাগ রেখে গিয়েছিল তাঁর অন্তরে তা কেবল অনুমানই করা যায়, অনুধাবন করার সাধ্য অন্তত আমার যে নেই সেটা জানি। অথচ কি আশ্চর্য জানেন, এই কথাগুলি কিন্তু রফিকসাহেব নিজে কোনদিন বলেননি আমাকে, কোথাও কোন বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়েও তাঁকে বলতে শুনিনি, যেন দুই ভাই মিলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া আর প্রাণপ্রিয় বন্ধুসম ভাইটিকে যুদ্ধক্ষেত্রেই একা ফেলে বাড়ি ফিরে আসা, এগুলো সবই অত্যন্ত ব্যক্তিগত দুঃখের কাহিনী, যা জনসমক্ষে বড় গলায় প্রচার করার মত নয়। বাইরে থেকে কেবল এটুকুই দেখতে পাই আমরা যে ’৫২ আর ’৭১ এ’দুটি সাল আমরা যেভাবে দেখি উনি হয়ত ঠিক সেভাবে দেখেননি----এগুলো তাঁর রক্তপ্রবাহতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেকারণেই বুঝি তাঁর ই-মেইল ঠিকানার নামকরণই ছিল এরকমঃ রফিক ’৫২ ও ’৭১।
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এর কুশিলবদের কাহিনী আজকাল বাংলাদেশের ছোটবড় সকলেরই জানা, কিন্তু প্রথম যখন সেই সদ্যজাত কাঁচা আইডিয়াটি নিজের টাইপকরা কাগজে লিপিবদ্ধ করে রফিকুল ইসলাম স্কুলবালকের সরলতায়, মেইল করে পাঠিয়ে দেন আন্তর্জাতিক জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের ঠিকানায়, তখন কিন্তু আর কেউই ছিল না তাঁর সঙ্গে। একা, সম্পূর্ণ একা। দিনটা ছিল ৯ই জানুয়ারি, ১৯৯৮ সাল। কফি আনান বাংলাদেশের সাধারণ জেলা প্রশাসকদের মত নন, পৃথিবীর শ’দুয়েক দেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে তাঁর দৈনন্দিন কারবার। তিনি অনায়াসে পারতেন বাংলাদেশ নামক একটি নগণ্য দেশের নগণ্যতর এক নাগরিক, রফিকুল ইসলাম যার নাম, ভ্যাঙ্কুভার ডাকঘরের ছাপমারা একটি ব্যক্তিগত চিঠিকে টেবিলের পাশে রাখা বিনে ছুঁড়ে ফেলতে। কিন্তু তিনি তা করেননি----অধীনস্থ এক অফিসারের দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরই বলতে গেলে চাকা ঘুরতে শুরু করে। সেই ঘূর্ণ্যমান চক্রতে অংশগ্রহণ করেন আরো অনেক দেশপ্রেমিক, ভাষাপ্রেমিক, বাংলাদেশী, গঠিত হয় ‘লাভার্স অফ মাদার ল্যাঙ্গুএজ’ নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পরিচালনার পুরো দায়িত্বটি ভদ্রলোক নিজের ঘাড়েই চাপিয়ে নেন, এবং এই সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই শেষ পর্যন্ত একটি ছোট মানুষের বড় স্বপ্ন একটা সমগ্র জাতির বৃহত্তর স্বপ্নের অর্জনে রূপান্তরিত হয়। দিনটা ছিল ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ সাল। জাতিসঙ্ঘের ইউনেস্কো শাখাতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয় যে ২১ ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজোড়া সকল দেশেই পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ’৫২ সালের ভাষাসংগ্রামের শহীদদের প্রতি যতটা সম্মান প্রদর্শন করতে পেরেছে আমার নিজের দেশ তার চেয়ে শতগুণ বেশি সম্মান অর্জিত হয়েছে সেদেশেরই এক দেশপ্রেমিকের একটি দুঃসাহসী স্বপ্ন আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে।
আইডিয়া এক শক্তিশালী জিনিস। ভিক্টর হিউগোর একটা বিখ্যাত উক্তি এরকমঃ একটি সেনাবাহিনীর আক্রমণকে তুমি রুখে দাঁড়াতে পারবে, কিন্তু একটা বড় আইডিয়ার আক্রমণকে প্রতিরোধ করার সাধ্য নেই কারুর। আইডিয়াকে ভয় করে বলেই তো বিজয়ী সেনাপতিরা সাধারণত শত্রুর দুর্গ ধ্বংস করে না, ধ্বংস করে তার গ্রন্থাগার, যেখানে বাস করে আইডিয়ার সৈন্যসামন্তরা। বড় আইডিয়াই বড় সৃষ্টির উৎস, সেটা বিজ্ঞানেই হোক আর শিল্পসাহিত্যেই হোক।
আমাদের এই বিনয়নম্র, অহমশূন্য মানুষটিও, আমি যেটুকু জানি, ছিলেন একজন আইডিয়া মানুষ। ক্যানাডায় আসার আগে তিনি কাজ করেছেন প্রশিকার সঙ্গে। নানাবিধ জনহিতকর কাজ নিয়েই ছিল তাঁর জীবন। বিদেশে চলে আসার পরও তিনি প্রশিকার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন----কিভাবে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বিদেশে বিস্তৃত করা যায় এনিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন মাঝেমধ্যে। উদ্দেশ্য সেই একটাই---দেশের উপকার। যখন যেভাবে সম্ভব সে উপকারের পথটি তিনি খুঁজতেন অহরহ।
একবার তাঁর মাথায় ঢুকলঃ দেশের দুর্নীতিমোচন করতে হবে। আইন করে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে কাজ হচ্ছে না। ভাবলেন তাহলে পুরষ্কারের লোভ দেখালে কেমন হয়? আমাকে ফোন করে বললেনঃ আচ্ছা মীজানভাই, এমন যদি করা যায়, দুর্নীতির পথ বাছাই করলে তোমার পদোন্নতি তো হবেই না, একপয়সা বেতনও বাড়বে না। আর দুর্নীতি যদি না করো তাহলে বেতন তো বাড়বেই, ঘন ঘন পদোন্নতিও হবে তোমার। আমি হাসলাম। দুর্নীতির মনস্তত্ব বেচারির জানা ছিল না। থাকলে হয়ত বুঝতেন যে একবেলাতে যে-ব্যক্তি একলক্ষ টাকা কামাই করতে পারবে চোরা পথে, সে লোক একবছর পর এক হাজার কি দুহাজার টাকার দিকে চেয়ে থাকবে কেন? পদোন্নতি দিয়ে কি কেউ উত্তরা-বসুন্ধরাতে দুতিনটে বাড়ি কিনতে পেরেছে, বা মেয়ের বিয়েতে পেরেছে পঞ্চাশ ভরি সোনার অলঙ্কার দিতে? দুর্নীতি ছাড়া তো সংসদের নির্বাচনেও ঢোকা সম্ভব নয় আজকাল। কিন্তু আমাদের রফিক সাহেবকে সেকথা বোঝাবে কে। সেই ‘দুর্নীতি দমনের’ আইডিয়াটির ওপর তিনি বেশ কিছুদিন লেগে ছিলেন। সম্ভবত দেশবিদেশের অনেকের সাথেই সেটা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনাও করেছিলেন। তারপর হয়ত একসময় নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাভাষার সম্মানটি জাতিসঙ্ঘের কাছ থেকে আদায় করে নেয়ার সংগ্রাম যত কঠিন তার চেয়ে শতসহস্রগুণ কঠিন হল বাংলাদেশের দুর্নীতি দূর করার কাজটি। এটি হিমালয় পর্বত---একে নড়ানোর সাধ্য নেই কারুর।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে আরো একটা আইডিয়া তাঁর মাথায় কাজ করছিল। আমাদের ভাষাটির সংস্কার দরকার---এটি আরামকেদারায় বসা ভদ্রলোকদের ভাষা হতে পারে, কিন্তু গ্রামেগঞ্জের চাষাভূষা আর পথেঘাটের গরিবদুখিদের উপযোগী ভাষা নয়। তাদের জন্য দুটি ‘উ’কার, দুটি ‘ই’কার, দুটি ‘ন’, তিনটে ‘স’, দুটি ‘র’----এগুলো বড্ড গোলমেলে। এগুলো আসলে বড়লোকদের বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। এগুলোকে বাদ দিতে হবে। বর্ণমালাতে ‘ই’কার থাকবে একটি, ‘উ’কার একটি,...এমনি করে সবকটি অক্ষরই থাকবে একটি করে, তার বেশি নয়। আর হ্যাঁ, যুক্তাক্ষরের উপদ্রব থেকে রেহাই দিতে হবে সাধারণ মানুষকে! এইরকম যুক্তাক্ষরমুক্ত, ‘সুসংস্কৃত’ বানানসম্মত একটি চিঠি যেদিন পেলাম ই-মেইলে সেদিন ভয়ানক ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম---ভুল দেখছি নাতো? চোখের জ্যোতি আমার আগের মত নেই, বোধশক্তিও কিঞ্চিৎ স্তিমিত, অতএব কি দেখতে কি দেখে ফেলি বুঝিনা সবসময়। তাই হয়ত না বুঝেই বলেছিলামঃ না ভাই এটি ঠিক সমর্থন করতে পারছিনা আমি। তিনি একটু দমে গিয়েছিলেন জানি। দোষটা আমারই। আমি তো তাঁর মত বড় আইডিয়ার মানুষ নই, আমি তো বাধা দেবই। এলবার্ট হাবার্ড নামক এক পণ্ডিত বলেছিলেন এক জায়গায়ঃ একটা আইডিয়া যদি ভয়াবহ কিছু না হয় তাহলে সেটা আইডিয়া নামেরই যোগ্য নয়। হয়ত রফিকুল ইসলামের আইডিয়াটিও সেরকম একটি ‘ভয়াবহ’ আইডিয়া যার সময় এখনো হয়নি বলেই আমি বুঝতে পারিনি। শত হলেও ভাষা তো যুগের মতই গতিশীল---যুগ বদলাবে মানুষ বদলাবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তো ভাষাকেও বদলাতে হবে। বদলাবে না কেবল আমার মত স্থবির বৃদ্ধেরা। কে জানে, হয়ত অদূর ভবিষ্যতে যখন আমি থাকব না, রফিকুল ইসলাম তো এখুনি নেই, তখন বাংলাভাষা ঠিক তাঁর মত করেই বিবর্তিত হয়ে হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অবয়ব ধারণ করবে যা আমার মনোমত চেহারায় না থেকে বরং রফিকুল ইসলামের সরলিকৃত ধারণার সঙ্গেই মিলে যাবে বেশি।
কথা ছিল তাঁরা সপরিবারে দেশে যাবেন ১৯শে অক্টোবর। সেপ্টেম্বরের মাঝমাঝিতে গেলেন রক্তপরীক্ষার জন্য। সেটা দরকার ছিল, কারণ সবেমাত্র সেরে উঠেছিলেন এক শক্ত অসুখ থেকে---লুকেমিয়া। একটি ছোটবোন দেশ থেকে এসে ভাইকে বোনমেরো দিয়েছিলেন বলেই রক্ষা। পাকা দুবছর ভুগলেন বেচারি। তবু ভাবলাম আমরা, বড় কথা তিনি এবং তাঁর পরিবারের সবাই ভাবলেন, ফাঁড়া কেটে গেছে। আবার চোখ মেলে মন ঢেলে তাকানো যায় জীবনের যাকিছু সুন্দর যাকিছু আনন্দময় তার দিকে। তাই না দেশের পথে যাত্রার আয়োজন।
রক্তপরীক্ষার পর ডাক্তার ফোন করে বললেন দেখা করতে তাঁর সঙ্গে---২৩ শে সেপ্টেম্বর। তাঁরা সবাই ডাক্তারের অফিসে---বুক কাঁপছে। না জানি কি শুনতে হয় ডাক্তারের মুখে। তিনি এলেন। পাশে বসলেন আস্তে করে। হ্যাঁ, খবর ভালো নয় মিস্টার ইসলাম----আপনার ক্যান্সার ফিরে এসেছে। এবং এবার আর রক্ষা করার কোনও উপায় নেই।
কতটা সময় আছে বলে মনে হয় আপনার?
চার মাস কি ছয়, বড়জোর।
তাঁরা বাড়ি ফিরে এলেন। বড় ছেলে জ্যোতি ছিল সঙ্গে, বুলিও। জ্যোতি বললঃ বাবা আমি ড্রাইভ করি? রফিক সাহেব বললেন, খুব ধীর, শান্ত গলায়, না বেটা, আমিই পারব। এতে কি আছে? তোমরা অস্থির হয়ো না। আমি ঠিক আছি।
হ্যাঁ, উনি ঠিক ছিলেন ঠিকই, কারণ রফিকুল ইসলাম এমন একজন মানুষ ছিলেন যে জীবনের কোন অবস্থাতেই তাঁর শক্ত মনোবলটি টলানোর সাধ্য ছিল না কারুর। দেশের জন্যে, নিজের আপনজনদের জন্যে যত আবেগই থাকুক তাঁর, নিজের জন্যে যেটুকু আবেগ না থাকলেই নয় সেটুকু তিনি নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রাখতেন। বড় মনের দেশপ্রেমিকরা কেবল দেশের জন্যেই কাঁদেন, আর কিছুতেই তাঁদের চোখে পানি আসবে না। অতএব আসন্ন মৃত্যুর সংবাদ তাঁকে ভয়ে কাতর করে ফেলবে কেন? কিন্তু তাঁর স্ত্রী আর জ্যষ্ঠ পুত্রের পক্ষে ঠিক থাকাটা অত সহজ ছিল না। বরং তাঁর ঠিক থাকাটাই যেন আরো অস্থির করে তুলছিল তাদের।
তার দুদিন পর আমি অটোয়া থেকে টেলিফোন করেছিলাম খোঁজখবর নেবার জন্যে, যা আমি মাঝে মাঝেই করতাম। তখনই তিনি বললেন, ঠিক সেরকমই শান্ত গলায়, যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়, যে তাঁদের দেশে যাওয়ার আয়োজনটি বাতেল করতে হল। কেন? ডাক্তার বলেছেন ক্যান্সার ফিরে এসেছে। সময় নেই খুব---চার থেকে ছয় মাস। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ---একটা শব্দও বেরুল না মুখ দিয়ে। না, তাঁর খারাপ খবর শুনে নয়, লোকটা এমন ধীরস্থির থাকছেন কেমন করে? মৃত্যুর ভয় কাবু করে না এমন মানুষ পৃথিবীতে কজন পাবেন আপনি? এ-ভয় এমনই ক্ষমতাশীল যে পাঁড় নাস্তিকও দোয়াদরূদ পড়তে শুরু করে দেয়, চোখের জলে দুনিয়া ভাসিয়ে ছোটবড় সবার কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে, মোল্লা ভাড়া করে তৌবা পড়ে। সেখানে এই সাধারণের বেশে অসাধারণ মানুষটি, মুক্তিযোদ্ধা, পরম ধর্মবিশ্বাসী একটি পূর্ণাংগ ভালোমানুষ, আমাকে বলছেন তাঁর আর সময় নেই খুব? যেন এটা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনেরই একটি অনুল্লেখযোগ্য, তুচ্ছ, ব্যাপার। মনটা আমার আপনা থেকেই নত হয়ে গেল। নিজেকে ধন্য বোধ করলাম এই মানুষটিকে ব্যক্তিগতভাবে জানতে পারার সৌভাগ্যতে।
রফিকুল ইসলামকে নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক শোকসভা হয়েছে, জানি। অনেক জ্ঞানীগুণি ব্যক্তি দামি দামি কথা বলেছেন তাঁকে নিয়ে, এবং ভবিষ্যতে আরো বলবেন, আরো লিখবেন। আমরা বাংলাদেশীরা ভীষণ আলোচনাপ্রিয় জাতি। উপলক্ষ পেলেই হল, আমরা গোল হয়ে বসে যাই ‘আলোচনা’ করব বলে। রফিকুল ইসলাম নিজে খুব ‘আলোচনা’ ভক্ত ছিলেন বলে আমার জানা নেই। উনি হয়ত চাইতেন দেশের জন্যে কোনও গঠনমূলক কর্মসূচী বিয়ে আলোচনা, বা নতুন কোনও প্রস্তাব দাঁড় করিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এর মতই একটা দুঃসাহসী কাজ করে দেশকে বিশ্বের কাছে বড় করে তোলা।
দেশ, দেশ আর দেশ, এই ছিল তাঁর মন্ত্র। এই মন্ত্র কি কখনো তাঁর দেশবাসীর প্রাণে প্রবেশ করবে?
অটোয়া, ১৮ই ডিসেম্বর, ‘১৩ মুক্তিসন ৪৩
উত্তর আমেরিকার পাঠকনন্দিত লেখক ড. মীজান রহমানও ২০১৫ সালে আমাদেরকে রেখে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে উভয়েই আমাদের গর্ব। উভয়ের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি...
-
নিবন্ধ // মতামত
-
20-11-2019
-
-