অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
গল্প নয় সত্যি - বন্যা হোসেন

য়ী কাজ থেকে বের হয়ে ছেলের স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। পাঁচ মিনিট পরই চলে এল হলদে রঙা বাস। বাস থেকে নেমে এল কলকল করতে থাকা একদল কচি কাঁচা। 

মা ও ছেলে বাড়ির পথে এগোয়। বাসস্টপ থেকে এক মিনিট দূরত্বে ওদের বাসা। দরজার চাবি বের করতেই দেখা গেল রাস্তার অপর পার্শ্বের একটি গাড়ি থেকে এক অপরিচিতা ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসছেন। জয়ী দরজা খুলতেই সৌরভও ঢুকে পড়ে ঘরে মাকে এক ধাক্কা দিয়ে। 

জয়ী প্রশ্নার্ত চোখে তাকাতেই আগন্তুক ভদ্রমহিলা কাছে এসে বললেন, তিনি সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে এসেছেন। সৌরভের স্কুলে কিছু ঘটনা ঘটেছে যে কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিবার ও শিশু বিভাগে ফোন করে ঘটনাটি অবহিত করে। 

পরবর্তী এক ঘন্টায় মেরিলিন নামক সমাজ কর্মীর কাছে জয়ী যা শুনল তাতে তার মাথা হেঁট। 

প্রবাস জীবনে আমরা সবাই নিজেদের বিদ্যা বুদ্ধি আর অধ্যবসায় দ্বারা জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর হই। বিশেষ করে আমাদের মত অভিবাসী বাঙালিরা। কিন্তু একটা ছোট্ট জিনিস সবাই এড়িয়ে যাই। আমাদের ছেলে মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে আমাদের অবদান কতটুকু? 

জয়ী আর আবীরের ছেলে সৌরভের বয়স ৮ বছর। জন্মের পর থেকে দেখে আসছে বাবা মায়ের নিত্য বচসা, অশান্তি, কলহ। একে অপরকে কটু বাক্যে হেয় করা এবং গালিগালাজ। সৌরভের অভিভাবক দু'জনেই উচ্চশিক্ষিত এবং কানাডিয়ান সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত। 

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেই যে মানুষ তার আদিম জংলী আচরণ ত্যাগ করতে পারে না তার নিকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এই দম্পতি। পারিবারিকভাবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ আবীর জয়ী সংসার শুরু করার পরদিন থেকেই বুঝতে পারে তারা দুজন ভিন্ন জগতের মানুষ। জয়ী গান, কবিতা ভালবাসে, শিল্প- সাহিত্য - সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহী। রুচিসম্মত অন্দরসজ্জায় পারদর্শী। অবসরে গুলতানি, আড্ডা আর পরচর্চায় সময় না কাটিয়ে ভালবাসে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যে ডুবে থাকতে। 

আবীর আড্ডাপ্রিয়, মিশুক, একগুঁয়ে, তার্কিক আর প্রচন্ড অলস। কুটোটি নাড়তে অপারগ। কিন্তু ভাল খাবার চাই তার, ছিমছাম ঘর, টিপটপ বউ আর অফুরন্ত স্বাধীনতা। 

দেশ ছেড়ে এসে প্রবাস জীবনের হাড় ভাঙা পরিশ্রম আর পড়াশোনার ব্যস্ততায় প্রথম কয়েকটি বছর কেটে গেলেও বাচ্চা এবং সেই সাথে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি জীবনে প্রবেশ করে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে গিয়ে তারা নিজেদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। 

আর এই কারণেই সেদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুরন্তপনার জন্য সৌরভের গালে এক চড় বসিয়ে দেয় আবীর। কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যায় ছেলেটা। তার প্রিয় বন্ধু ডেনিস সৌরভের গালে দাগের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করতেই সৌরভ তার জমাট ক্রোধ ঝেড়ে দেয় নিজেরই প্রিয় বন্ধুর উপর তাকে এক ঘুষিতে নাস্তানাবুদ করে। 

ক্লাস শিক্ষয়িত্রী পুরো পরিস্থিতি সামলে সৌরভকে নিয়ে পৃথক রুমে আলাপ করতে বসেন। গল্পচ্ছলে বেরিয়ে আসে সৌরভের পরিবারের প্রকৃত চিত্র। 

মেরিলিন সবকিছু জয়ীকে জানিয়ে অপেক্ষা করেন আবীরের জন্য। আবীর এলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। আবীর এবং জয়ীকে জানিয়ে দেয়া হয় সরকারের পরিবার ও শিশু বিভাগ তাদের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকবে সৌরভ। যদি ভবিষ্যতে এমন কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটে সেক্ষেত্রে এই দম্পতির এক সাথে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে এবং সৌরভকেও ফসটার পরিবারে হস্তান্তর করা হবে। 

#৮ বছর পরের প্রথম পরিণতি

সতর্কবানী শুনে এই দম্পতি এখন আর ছেলের সামনে ঝগড়া করে না। কিন্তু তাদের সম্পর্কের বিন্দুমাত্র উন্নতি তো হয়ইনি বরং অবনতি হয়েছে। আবীর বউয়ের সাথে সম্পর্কের উন্নতি না করে ক্ষণিকের ভালবাসায় বুঁদ হয়ে আছে। বিভিন্ন নারীর আনাগোনায় তার জীবন বড্ড রঙিন। 

জয়ী নিজেকে প্রমাণ করার নেশায় নেমেছে। তাকে যেন প্রমাণ করতেই হবে সে শ্রেষ্ঠ কর্মী কানাডার পরিসংখ্যান দপ্তরে। পর পর পদোন্নতি তাকে চ্যালেঞ্জ করছে আরও উপরে উঠার সিঁড়িতে পদার্পণ করার। প্রমত্ত এই নেশায় ডুবে তার নিজস্ব কামরাতেই সে ব্যস্ত সময় কাটায় কম্পিউটারের সামনে। একটিমাত্র সন্তান কি করে বড় হচ্ছে তা খুব একটা জানে না। সন্তানের মননে, চিন্তায় যে বাবা মায়ের জন্য প্রবল ঘৃণা কল্পনাতেও নেই জয়ীর।

আবীর এবং জয়ী একটি ভাবনায় শুধু সহমত পোষণ করে। দুজনেই মনে করে সৌরভের জন্যই তারা আছে একসাথে। দিনের পর দিন তাদের মাঝে প্রয়োজন ছাড়া কোন বাক্যবিনিময় হয় না। নেই কোন আনন্দ, উচ্ছ্বাস, সুখানুভূতি। 

এই পরিস্থিতিতে একটি উঠতি ১৬ বছরের তরুণের কি পরিণতি হতে পারে? 

হয় সে পারিবারিক শিষ্টাচার মনে রেখে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেই বাড়ি থেকে বহুদূরের প্রতিষ্ঠানে পড়তে যায়। মনে থাকে বাবামায়ের জন্য প্রবল ঘৃণা। বাড়িতে ফিরতে প্রচন্ড অনীহা। 

অথবা, সৌরভের মত বিভ্রান্তি আর উন্মাদনায় নিজের ক্ষতি করে। 

সৌরভ তার ১৬ বছরের জন্মদিনে বাবা মাকে না জানিয়ে তার ফেসবুক একাউন্টে স্ট্যাটাস দেয় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। বলাই বাহুল্য, এবয়সী তরুণ তরুণীদের বন্ধুতালিকা হয় ৫০০০ / ১০০০০। সে এক গ্রীষ্মের দুপুরে এয়ার বি এন বি এর মাধ্যমে একটি তিন বেডরুমের বাড়ি ভাড়া নেয়। ফেসবুকের স্ট্যাটাসের বদৌলতে দলে দলে ছেলেমেয়ে এসে নক করে দরজায়। বলেই দেয়া হয়েছিল, সৌরভের জন্মদিনের পার্টি। খাবার ব্যবস্থা যার যার নিজের পাশ্চাত্যের নিয়ম অনুযায়ী। বন্ধুরা পিজ্জা, বিয়ার এবং নিজেদের বাবা মায়ের সংগ্রহ থেকে কঠিন, তরল পানীয় নিয়ে আসে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের দিকে সেই ছোট্ট বাড়িটিতে তরুণ তরুণীদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ এর কাছাকাছি। ঝনঝনে সুরের মূর্চ্ছনায় শোনা যায় না কোন কথা। কিছু ছেলেমেয়ে উদ্দাম গানের সাথে উত্তাল নৃত্যে রত। কেউ গোল হয়ে বসে গুঞ্জন করছে। কেউ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে, কারো হাসির রিনিঝিনিতে কেউ চমকে উঠছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। কিছু তরুণ তরুণী প্রথম দর্শনেই ভালবাসার সুখে মত্ত। বাকি কয়জনা এক কোণায় ধোঁয়া ফুকছে। কয়েকজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অতিরিক্ত উন্মাদনায় অসহ্য হয়ে। 

কিছুক্ষণ পর একদল ছেলেপেলে দৌড়ে ঘরে ঢুকলো। হড়বড় করে কিছু বলছে প্রাণপণে চেঁচিয়ে। দৌড়ে কেউ ফোন বের করে ৯১১ কল দিল। পুলিশ এল কয়েক মিনিটের মাঝে। দুই তরুণকে পাওয়া গেল অজ্ঞান অবস্থায়। মাদক সেবন করে বাড়ির টালির ছাদে উঠতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন সৌরভ। 

ছেলেটার বাবা মা যখন খবর পেল তখন সে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে চেতনাহীন হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। 

অথবা, এমনও হয়!!
#৮ বছর পরের দ্বিতীয় পরিণতিঃ 

মেরিলিন শেষবার যখন এসেছিল তখনই সৌরভের মনোজগতের উন্নতি দেখে খুশি হয়েছিল। 

বাবা মা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং দাম্পত্য সম্পর্কের উন্নতি না হলেও একসাথেই থাকবে সৌরভের জন্য। তারা সৌরভের সামনে দারুণ অভিনয় করেন। আড়ালে যাই ঘটুক না কেন!! 

দুজন দক্ষ পেশাজীবি, সরকারি কর্মকর্তা সন্তানের জন্য নিজেদের জীবন আত্মত্যাগ করছেন। উভয়ের জীবনই বিষাদ ভারাক্রান্ত। তাদের সম্পর্ক একচুলও এগোয়নি। রুমমেটের মত মেনে নিয়েছেন একে অপরকে আপোস করে। 

ছেলের ১৬ বছরের জন্মদিনে তিনজনে নামী রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। ছেলের জন্য দামী উপহার এনেছে আবীর। 

সৌরভের হাতে একটি করে সাদা খাম বাবা মায়ের জন্য। তারা বেশ অবাক দৃষ্টিতে খাম হাতে নিলেন। গর্ব আর বিষ্ময়মাখা খুশিতে খাম খুলে ভিতরের সাদা কাগজে লেখা লাইনটির দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। 

" Guys, you have got to know when it’s time to turn the next page of your life. You have done enough for me. Let it go and move on." 

রক্তশূণ্য সাদা চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা বাবা মায়ের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে সৌরভ জানাল, সে সবকিছু জানে এবং বোঝে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের মাঝে পারিবারিক আবহ উপলব্ধি করে যা নিজের পরিবারে অনুপস্থিত। তার বাবা মা নিষ্করুণ এক প্রতিজ্ঞা কেবল পালন করে যাচ্ছেন ঐক্যবদ্ধভাবে। সেখানে আছে শুধু কর্তব্য পালনের দায়বদ্ধতা। একফোঁটা আবেগ নেই, খুনসুটি নেই, অধিকারবোধ আর প্রত্যাশা নেই। জন্মদিনে আজ বাবা মাকে মুক্তি দিতে চাইছে দায়িত্ব পালনের নাগপাশ থেকে। যেন তারা নিজেদের মত করে জীবন সাজিয়ে নিতে পারে, হোক সে একাকী বা নতুন সঙ্গীকে নিয়ে।। 

* দুটি পরিণতির কথা বলা হল যেহেতু প্রাথমিক গল্পটা একই ছিল দুটি পরিবারের । অর্থাৎ, বাবা মায়ের দাম্পত্য জীবনের অশান্তি পরিবারে নিঃসঙ্গতা আর বিমর্ষতার কালো অভিশাপ নিয়ে এসেছে। 

অনেকেই মনে করেন, ছেলে মেয়ের জন্যই একসাথে থাকতে হবে যদিও প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরেই ঘটি বাটি ছোড়াছুড়ি করেন নিজেরা। এবং এসব ছেলেমেয়েদের সামনেই ঘটে। ভাল মন্দ, উচিত অনুচিতের প্রশ্নে না গিয়ে ভাবা দরকার কিভাবে সবার মানসিক উৎকর্ষতা সম্ভব। 

প্রত্যেকের পরিস্থিতি ভিন্ন, স্থান কাল ভেদে ঘটনার তারতম্য ও প্রেক্ষাপটও ভিন্ন হয়। সদিচ্ছা আর সহনশীলতা যে কোন পরিবারেই সুখের মূলমন্ত্র। যেখানে আপোস করার মানসিকতা নেই, সহিষ্ণুতা যেখানে অলীক স্বপ্ন সেখানে বেশি কিছু আশা করা বাঞ্জনীয় নয়। বাবা মায়ের দাম্পত্য কলহ সন্তানের মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে যা কোন মলমের প্রলেপেই শুকোয় না।

বন্যা হোসেন । অটোয়া
নভেম্বর, ২০১৯