অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ইউরোপের পথে পথে (সতেরো) – দীপিকা ঘোষ

    ষোলো শতকের ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে জড়িত ভ্যাটিকান সিটির প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস। ভ্যাটিকান একটি চার্চভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র। ‘সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা’, এই রাষ্ট্রের প্রধান চার্চ। এটি চার্চের সংক্ষিপ্ত নাম। ইটালিয়ান ভাষায় সম্পূর্ণ নাম(Basilica papale di San Pietro in Vaticano)। অর্থাৎ ভ্যাটিকান শহরের প্রধান সন্ত, পোপ পিটারের বিল্ডিং। ক্যাথলিক বিশ্বাসের ঐতিহ্যের ধারক সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা, বিশ্বের  সর্ববৃহৎ চার্চ। ইতিহাস জানাচ্ছে যিশু খ্রীষ্টের ১২জন নিকটতম প্রধান শিষ্যের অন্যতম ছিলেন সেইন্ট পিটার।  খ্রীষ্টধর্মের সর্বপ্রথম পোপ তিনি। রোমসম্রাট নিরো তাঁকে ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার হুকুম দেন। আজকের ‘সেন্ট পিটার’স ব্যাসিলাকা’ যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানেই ছিল পিটারের সমাধিস্থল। এই স্থান এককালে সম্রাট নিরোর সার্কাসের কেন্দ্রভূমিও ছিল। ব্যাসিলিকার সামনেই রয়েছে বিস্তীর্ণ চত্বর। চত্বরের নাম ‘পিটার স্কয়ার’। চার্চে যাওয়ার জন্য এখানে দর্শকদের লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হয়। সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছে দেখি সহস্র মানুষের লম্বা লাইন পড়েছে সাতটা থেকে। সে দৃশ্য দেখে শুচির গলায় মৃদু ক্ষোভ ধ্বনিত হলো-
     দেখেছো মামণি, বলছিলাম না সকাল সাতটায় আসতে না পারলে লাইন অনেক লম্বা হয়ে যাবে? দেখো তাই হয়েছে কিনা!
     অসুবিধে নেই। না হয় লাইনে একটু বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকবি।
     তাই বললে হবে? আমরা আজ পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে রোম দেখবো, কাল তোমায় বলিনি?
     আজ অবশ্য রবিবার নয়। রোমে থাকলে প্রত্যেক রবিবার দুপুরে, পিটার স্কয়ারে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে পোপের আধ্যাত্মিক ভাষণ দানের নিয়ম রয়েছে। ভ্যাটিক্যান সিটির বর্তমান পোপের নাম, সেইন্ট ফ্রান্সিস। ২০১৩ এর ১৩ই মার্চ ২৬৬ তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। রোদের উত্তাপ ক্রমশই প্রখরতা বাড়াচ্ছিল। এক সময় ধৈর্য হারিয়ে সামনের লাল চুলের ছেলেটিকে ঘোষ জিজ্ঞেস করলো-
     এত ধীরগতিতে লাইন এগুচ্ছে কেন, জানো?
     সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জবাব দিলো-
     সিকিউরিটির চেকপয়েন্টে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওখানে মেটাল ডিটেকটর ছাড়াও এক্স-রে মেশিনে চেকিং হচ্ছে। এয়ারপোর্টে যে ধরনের স্ক্রিনিং ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, প্রয়োজনে সেগুলোর সবই ব্যবহৃত হচ্ছে এখানে! সেই জন্যই...!
     কত সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে?
     জানি না। আমি তো দু ঘন্টার ওপর অপেক্ষা করে আছি!
     মেসো লাইন স্কিপ করি চলো, সঙ্গে সঙ্গে কণিষ্কর প্রস্তাব শোনা গেলো।
     সেটা তুমি করতে পারো না পাপান!
     হ্যাঁ পারি দিদিভাই! এইমাত্র সার্চ করে দেখলাম, ওই যে ওদিকের ঘরটায় গিয়ে স্কিপ ফি দিলেই আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না। ট্যুরিস্ট গাইডও পাওয়া যাবে। কেউ কেউ যাচ্ছে দেখো! এখানে দাঁড়িয়ে কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে? যদি তিন চার ঘন্টা লেগে যায়?



     ভ্যাটিকান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এর চারদিকে ইটালি। পৃথিবীর সবচাইতে ছোট্ট স্বাধীন দেশ। আয়তন মাত্রই ১০৯ একর। এই আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রের রাজধানীর নাম ভ্যাটিকান সিটি। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় কর্তা স্বয়ং পোপ। ভ্যাটিকানের নিজস্ব পুলিশবাহিনী ছাড়াও ক্ষুদ্রতম আকারের সশস্ত্র সুইস ফোর্স রয়েছে। পোপসহ প্রাসাদ রক্ষার দায়িত্বে তারা নিয়োজিত। ছোট্ট রাষ্ট্রের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থাও স্বাধীন। ইটালিয়ান মার্কেটের ১৫ শতাংশ স্টকহোল্ডার ভ্যাটিকান সিটি। ব্যাংক, ইনসিওরেন্স, স্টিল, কেমিক্যাল এবং গৃহনির্মাণসহ নানা ধরনের নির্মাণ সংস্থাগুলোতে রয়েছে তার বিনিয়োগ। 
     ভেতরে প্রবেশ করলাম বিশাল ব্রঞ্জের দরজা পার হয়ে। কী রাজকীয় আভিজাত্য চারদিকে ছড়ানো! চারদিকে ভারি ভারি বিশাল স্তম্ভ সুসজ্জিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো চার্চকে ধরে রেখেছে সবল হাতের মুষ্টিতে। ওপরে মার্বেল পাথরের অপরূপ কারুকার্যখচিত দেয়াল। আরও ওপরে ধনুকাকৃতি ছাদ। চাকচিক্যের জোয়ার দেখে মনে হলো নির্মল রাতের কোটি নক্ষত্রভরা অসীম আকাশটাকে দেখছি যেন। শক্তির প্রাচুর্য সর্বত্র ফেটে পড়ছে বিস্ময়কর নীরবতা নিয়ে। বড় বিস্ময় জাগলো দেখে, ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দে এমন স্থাপত্যশিল্পের নির্মাণকাজের শুরু কিভাবে সম্ভব হয়েছিল সুচারুভাবে সেই কথা ভেবে। মহিলা গাইড ভ্যালোরিয়া, তার ছোট্ট গ্রুপ নিয়ে ধীর পদক্ষেপে চলতে চলতে ব্যাখ্যা করছেন সবকিছু। আরও খানিকটা অগ্রসর হয়েই একটি বিশাল স্ট্যাচুর সামনে এসে থেমে পড়লেন। সাদা মূর্তিটির পা ছুঁয়ে পবিত্র চরণামৃতের মতো অবিরাম গড়িয়ে আসছিল নির্মল জলের ধারা। সঙ্গের দর্শনার্থীরা প্রেমভরে সেই পবিত্র জল এক এক করে মুখে দিলেন দেখলাম।
     গাইড বললেন–
     এই স্ট্যাচু সেইন্ট দ্বিতীয় পলের।
     বড় ভক্তি হলো দেখে। প্রণাম করে খানিকটা জল আমিও মুখে তুললাম।
     ভ্যালোরিয়া বলে চলেছেন-
     বিশ্বের পবিত্রতম ক্যাথলিক তীর্থস্থান এই ক্যাথেড্রল! এটি হচ্ছে ‘সিস্টিন চ্যাপল’। ‘ওল্ড টেস্টামেন্টের’ (হিব্রু বাইবেল) কাহিনী এখানে শিল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৫০৮ থেকে ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এর দেয়াল এবং ছাদের পেইন্টিং-এর কাজ করেছেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। সময়টা ইটালির রেঁনেসা যুগের সোনালি অধ্যায়! এটা হচ্ছে ‘দি ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম’(আদমের জন্মকাহিনীর বৃত্তান্ত)।আর ওই যে ডানদিকে হচ্ছে ‘দি লাস্ট জাজমেন্ট’এর গল্পের দৃশ্য(শেষ বিচারের দৃশ্যাবলী)।এই আর্টের সবই গোল্ড দিয়ে প্লাস্টার পেইন্ট।
     শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে-
     বাপরে! তরল সোনায় এই বিশাল চিত্রকাজ! সে তো অনেক খরচার ঠ্যালা!
     গাইড ভ্যালোরিয়ার পেছনে ‘হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার’ মতো একঝাঁক ট্যুরিস্ট ইঁদুর। মুগ্ধ ভাবগাম্ভীর্যে তাকে  অনুসরণ করে হেঁটে চলেছে নিঃশব্দে। গাইডের কথা শুনতে শুনতে মন হয়তো হারিয়েছিল হাজার বছর পেছনের দিকে। হঠাৎ কচি কণ্ঠের প্রশ্ন শুনে বর্তমানে ফিরে এলাম-
     মাম, দি লাস্ট জাজমেন্টের ছবিতে ওরা সবাই কেন যুদ্ধ করছে? কেন মেরে ফেলছে মানুষগুলোকে? কেন কেউ ওদের বারণ করছে না?
     উত্তরে জননী নিঃশব্দে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে নিরস্ত করলো ছেলেকে। বালক নীরবতার গুরুত্ব বুঝে সঙ্গে সঙ্গেই নীরব হলো। যেন নীরবতাই এমন গভীর জিজ্ঞাসার একমাত্র জবাব। গাইড বর্ণনার সূত্র ধরে ফের বলতে আরম্ভ করলেন-
     এখানে শিশু যিশুর সঙ্গে কুমারী মাতা, স্নেহময়ী মেরি। প্রভু যিশুর জীবনকাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে এসব চিত্র। শিষ্যদের সঙ্গে তিনি চলেছেন মরুভূমির পথে। রোম সমাটের আদেশে বিচারপর্ব চলছে তাঁর। ক্রশবিদ্ধ করা হচ্ছে তাঁকে। এখানে রয়েছে ‘নিউ টেস্টামেন্টের’(খ্রীষ্টান বাইবেল) গল্পের সব দৃশ্যছবি।
     ভ্যালোরিয়ার ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে মনে পড়ছে, মহারাষ্ট্রের অজন্তা গুহার জাতক কাহিনীর দৃশ্যচিত্র। পাথরের গায়ের খোদা্ই কার্যে আর পেইন্টিং শিল্পের নিপুণতায় ঠিক এভাবেই সেখানেও চিত্রায়িত হয়েছে বুদ্ধদেবের জীবন গল্প। এরপরে মিউজিয়াম, রাফেল রুম, পোপদের ডজনখানি সমাধিমন্দির দেখে ওপরে আসার সময় চোখে পড়লো খুঁটিনাটি বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানার জন্য অডিও টেপ থেকে বুকলেট অবধি বেচাকেনার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। বুঝলাম, এখানকার ভাস্কর্য, স্থাপত্য, মুর‌্যাল পেইন্টিং, ধর্মীয় আর্টসহ শিল্পের আরও যেসব বিচিত্র পদ্ধতি রয়েছে তারা সবাই রূপকে প্রতীকে জাঁকজমকভাবে মূলত খ্রীষ্টধর্মের মর্মবাণীকেই ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে। এর পবিত্রতা তাই এমন সমাহিত।
     তবে সেই সঙ্গেই মনে হলো-
     প্রতি মাসে এখানে যে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়, সেটা ধর্মীয় আবেদন কিংবা আধ্যাত্মিক পরিবেশে মোহিত হওয়ার কারণেই নয়। ব্যাসিলিকার অপরূপ শিল্পসৌকর্যও হয়তো বহু দর্শককেই আকর্ষণ করে আনে।

     পিটার স্কয়ার থেকে পাঁচ ছয় মিনিটের হাঁটা পথের মধ্যে বিশাল প্লাজা। ভ্যাটিকানের বিখ্যাত আইসক্রীমের দোকান ‘Gelateria Del Monte' দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ক্রেতাদের ভিড়ের কারণে ব্যস্ততা বেড়েছে সার্ভারদের মধ্যে। ফ্রান্স, ইটালির সবখানেই দেখছি ডিশ অথবা কোণ দু রকম আইসক্রীমই জনপ্রিয় খাবার। আইসক্রীম তৈরীতে শিল্পসংস্কৃতির দেশে শিল্পসমৃদ্ধ রুচির ছোঁয়াও চমৎকার। নানা কারুকার্যে দৃষ্টিনন্দন হয়ে খরিদ্দারদের সামনে তারা উপস্থিত হয়। স্বাদে গন্ধেও দারুণ! কোনোটিতে ক্যারামেল, ডার্ক অথবা মিল্ক চকোলেটের আস্বাদ। কোনোটাতে আবার লেমনগ্রাস, হ্যাজেলনাট, পেস্তা, স্ট্রবেরি, তরমুজ, অরেঞ্জ কিংবা আমের গন্ধের সমারোহ। ঘাম ঝরানো গরম এলে সতেজ হওয়ার গরজে সব দোকানে দোকানে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। খাওয়া শেষে ‘রোমান কলোসিয়ামের’ উদ্দেশ্যে সবাই করে হাঁটতে শুরু করেছিল। সহসা পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো-
     হেয় বিসন্নো দিউয়ানা বত্তিইয়া দাক্কাউয়া?
     ফিরে তাকাতেই একটি জলের বোতল উঁচু করে ধরলো বক্তা। সবার দু চোখের বিস্ময় দেখে শুচি শান্ত স্বরে বললো-
     ইটালিয়ান বলছে।
     উত্তরে একগাল হাসি ঝরালো মানুষটা-
     বাঙালি? দেইখাই বুঝতে পারছি! আমি বাংলাদেশের! বাংলা বলবো, নাকি লোক্যাল ভাষা?
     ঘোষের ঠোঁটের ফাঁকে কৌতুকের হাসি ঝিলিক দিলো-
     আমাদের তো এখানকার ভাষা জানা নেই! বলে লাভ কী?
     জানি আপনারা নতুন! আমি অবশ্য এখানকার ভাষা ভালোই বলতে পারি। এখানে পাঁচ বচ্ছর আগে আসার পরে ক্লাশ কইরা শিখতে হইছে! ভাষা না জানলে এদেশে জব করে খাওয়া হেব্বি কঠিন কাজ!
     সে তো ঠিক কথাই! এখানে বাঙালির সংখ্যা কেমন?
     ভালোই! কম না এক্কেবারে! ভেনিসেও আমার অনেক বন্ধুরা আছে!
     আপনার সঙ্গের এরা দুজনও বাংলাদেশের নাকি?
     না স্যার! একজন শ্রীলংকার। আরেকজন বিহারের।
     জল বিক্রীর জব ভালো চলছে?
     চলছে মোটামুটি! এই জব এখানে বহুজনেই তো করে! আমাদের এরিয়াতেই পুনারো জন পানি বিক্রীর কাজে করে! তাই..! পানি লাগবে স্যার?

     বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, মিলিটারি মিউজিয়াম, ছোট বড় চার্চ দূর থেকেই চোখে পড়ছে। পর্যটক আর স্থানীয় মানুষের ভিড়ে ছোট ছোট জনসমাবেশ দেখা দিয়েছে পথের পাশে। একটি অল্প বয়সী দক্ষিণ এশিয়ার ছেলে পিচকারির মতো ইলেকট্রিক স্প্রেয়ার পাম্প থেকে রঙ ছিটিয়ে স্কেচ পেপারের ওপর ইটালির দর্শনীয় স্থানের ছবি এঁকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে রঙের ফুটকুরিতে কয়েক মুহূর্তে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে জীবন্ত চেহারাছবি! কী বিস্ময়কর শিল্প প্রতিভা! বাঁদিকে ডম্বরুর শব্দে চোখ ফেরাতেই দেখি, বাঁদরের খেলাও জমে উঠেছে একপাশে। কাছেই ভিখারি বসেছে কম্বল বিছিয়ে। তবে দর্শকদের বিস্ময় সম্ভবত ফেটে চৌচির হয়ে গেলো তখনই যখন দুজন ভারি চেহারার মানুষকে ভেসে থাকতে দেখলো শূন্যে। মহাশূন্যে যেমন প্লেন ভেসে চলে, ঈগল উড়ে বেড়ায় আকাশে তেমনি তারা ভেসে রয়েছে। সবজান্তা কণিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে আমার বিস্ময় ভাঙালো–
     ওরা আসলে ইনভিজিবল প্ল্যাটফর্মের ওপর বসে রয়েছে মামণি! ওটা ম্যাজিক নয়! দেখছো না, কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে চারপাশ?
     প্ল্যাটফর্ম আবার অদৃশ্য থাকে কী করে পাপান?
     কেন থাকবে না? নিচে একটা সরু স্ট্যাণ্ড রয়েছে তো! তাই বোঝা যাচ্ছে না! লণ্ডন স্ট্রিটেও একজন এসব দেখাতো। পরে ওর ট্রিকটা সবাই ধরে ফেলেছে! আমি নিজে জানি!
     লোকের ভিড় পেছনে ফেলে অনেকটা হাঁটতে হাঁটতে কলোসিয়ামে পৌঁছোনোর আগে নজরে পড়লো পরম যত্নে একটি জীর্ণ অট্টালিকার ভিডিও নিচ্ছেন চীনা ভদ্রলোক। পাশেই সম্ভবত তার স্ত্রী। পিঠে ঝোলানো ব্যাগপ্যাক। খুব ছোটখাটো শীর্ণকায় চেহারা। এমন ভাঙাচোরা বিল্ডিং-এর এত যত্নসহকারে ভিডিও ধারণের কারণ নিয়ে প্রশ্ন জাগলো মনে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঘোষ প্রশ্ন করতেই হেসে বললেন-
     আমি প্রফেসর অনুরাক। এ আমার স্ত্রী সাদকা। আমার কলিগও। আমরা দুজনেই থাইল্যাল্ডের। প্রত্ননৃতাত্ত্বিক বিভাগে আছি। আপাতত প্রাচীন রোমের ওপর কাজ করছি। এই প্রাসাদটা ছিল জুলিয়াস সিজারের! গত বছর ফটো তুলে নিয়েছিলাম, বিশেষ কাজ হয়নি। এবার তাই..।
     আচ্ছা, আমরা শুনেছিলাম সিজারকে তাঁর বউ মাশরুম স্যুপের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে....! শুচির মন্তব্য শেষ হবার আগেই প্রফেসর অনুরাক হাসলেন-
     খ্রীষ্টজন্মের প্রায় ষাট বছর আগের ঘটনা! অনেক কল্পনা আর গুজবের মিশেল হওয়াই স্বাভাবিক। তবে আমার জানা মতে, সিজারকে ষড়যন্ত্র করে সিনেটররা হত্যা করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী নন।
     প্রাসাদের ভেতরে ঢোকা যাবে?
     প্রাইভেট ট্যুরে সেটা সম্ভব নয়। গাইডেড ট্যুরেও এখানে সব জায়গা দেখানো হয় না নিরাপত্তার কারণে। বহু পুরনো কিনা।
     মেসো, আমরা তাহলে কলোসিয়াম দেখে আসি। অনলাইনে টিকেট কাটার সময় গাইডের কথা জানিয়েছিলাম ওদের। সেখানে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানা যাবে।
     কয়েক পা সামনে এগিয়েছিলাম কলোসিয়ামের পথে। হঠাৎ পেছন থেকে প্রফেসর অনুরাক কথা বললেন পরম আত্মীয়ের মতো-
     আজ তোমরা ওখানে ইংলিশ গাইড পেয়ে যাবে, অসুবিধে হবে না।
     ওঃ!শনিবার ছাড়া বুঝি ইংলিশ গাইড থাকে না?
     আমার জানামতে থাকে না।
     জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে প্রফেসর!
     উত্তরে অনুরাক এবং সাদকা হাত তুলে নমস্কার করে মোলায়েম ভঙ্গিতে হাসলেন।

     সরাসরি নয় খানিকটা ঘুরে সিকিউরিটির চেকপয়েন্টে ছাড়পত্র পাওয়ার পর বিশালাকৃতির কলোসিয়ামে প্রবেশ করা হলো। প্রায় দু হাজার বছরের পাথরের তৈরী কলোসিয়ামে বাধর্ক্যের জীর্ণতার সুস্পষ্ট চিহ্ন স্থানে স্থানে ছড়ানো। মহাকালের স্পর্শ আর কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের(১২৩৩, ১২৫৫, ১৩৪৯ খ্রীষ্টাব্দ)প্রবল আঘাতে  বারবার এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোমান ফোরামের পূর্বদিকে এর অবস্থিতি।
     ট্যুর গাইড সেরিনা বলছেন-
     কলোসিয়াম মানে থিয়েটার হল কিংবা স্টেডিয়াম। ৭০ থেকে ৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।  রোমান জনতার জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে এটি ছিল বিরাট উপহার। এখানে ৮০০০০ দর্শকের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জরুরি পরিস্থিতিতে যাতে মিনিটে ৫০০০ দর্শক প্রবেশ করতে এবং বেরিয়ে যেতে পারে, তার জন্য ৭৬টি গেট তৈরী করা হয়েছিল এখানে। কলোসিয়ামের উচ্চতা ১৫৯ ফুট।
     এর সবই বাইরের বৃত্তান্ত। জানার কৌতূহল আরও বেশি গভীরে রয়েছে অনেকেরই। কেন কলোসিয়াম প্রাচীন রোমের কিংবদন্তী হয়ে আজও লক্ষ লক্ষ পর্যটককে আকর্ষণ করে আনছে দূর দূরান্ত থেকে, সেই ইতিহাসের মর্মকথা এখনো অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে সেরিনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। দর্শকদের ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন-
     তখনকার রোমসাম্রাজ্যে বিনোদনের জন্য আরও অনেক থিয়েটার হল এবং স্টেডিয়াম তৈরী করা হয়েছিল, তাহলে রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে কলোসিয়ামকেই কেন চিহ্নিত করা হলো?
     সেরিনা এবার বিস্তৃত বললেন-
     কারণ রোমান শাসনের যুগে এটাই ছিল বৃহত্তম বিল্ডিং। এছাড়াও রাজশক্তির নিষ্ঠুরতা এবং উন্মত্ত শক্তিরও  প্রতীক ছিল এটি। ৩৯০ বছরে চারলক্ষ মানুষের রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছে এখানে। নিহত হয়েছে দশ লক্ষ বন্য পশু। এখানে ক্রীতদাস এবং সাধারণ অপরাধীদের পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য ছেড়ে দেওয়া হতো। সে দৃশ্য এই স্টেডিয়ামে বসেই ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ বিনোদন হিসেবে উপভোগ করতো।
     তারপর?
     তারপর উভয়ের মধ্যে যুদ্ধে জয়লাভ করে যে মানুষটা প্রাণে বেঁচে যেতো, তাকে আবারও যুদ্ধ করতে হতো হিংস্র সিংহ অথবা বাঘের সঙ্গে। এই যুদ্ধেও হয় পশু অথবা মানুষ, একজনকে জীবন হারাতেই হতো! কারণ এছাড়া নিষ্কৃতি ছিল না!
     কী অসম্ভব বর্বরতার ইতিহাস! আজকের মানবতাবাদী সভ্য ইউরোপের দিকে দৃষ্টিপাত করে এমন ঘটনার কথা কল্পনায় আনা চলে? শুনতে শুনতে সেই সংকীর্ণ গলির দিকে তাকিয়ে দু সহস্র বছর পরেকার অন্যান্য আরও অজস্র শ্রোতার মতো কেঁপে উঠলাম অন্তরে। যেখানে হতভাগ্য মানুষ কিংবা পশুগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল আবারও নজর ফেললাম সেখানে। দুটো দিকই বন্ধ। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়ার পথ খোলা নেই। হঠাৎ সহস্র বছরের অতীত থেকে অনেকগুলো হৃদয়ছেঁড়া তীব্র আর্তনাদের চিৎকার ভেসে এলো কানে। চোখ দুটো কখন জলে ভিজে গেলো জানা নেই।
     ফিরে এসে রেস্টুর‌্যান্টে ঢোকার পথে সহস্র পর্যটকের ভিড় দেখা গেলো। তাদের মধ্যে চাইনিজ অরিজিনের মানুষের সংখ্যা ৩০% এর কম নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দর্শকও সামান্য কিছু চোখে পড়ছে। গত দু তিন সপ্তাহ ধরে ইউরোপের পথে মানুষ দেখেছি বিস্তর। আমেরিকান, ইটালিয়ান, ফরাসি, ইংরেজ। আফ্রিকান, আরবীয়, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয়। বার বারই মনে হয়েছে-
     বাইরের চেহারায়, মানুষের চলাফেরায়, ভাষায় কিংবা অভিব্যক্তিতে আপাতত পার্থক্য যেমনই থাক, এভাবে মানবজাতির মাইগ্রেশন আর পারস্পরিক সংমিশ্রণে এই বৈচিত্র্য কি হারিয়ে যাবে না ভবিষ্যতে? বিভিন্ন রেস নিয়ে বিজ্ঞান এখন যে জেনিটিক বিশ্লেষণের কথা বলছে, সেদিন সেটা থাকবে তো?
     কারণ প্রত্ননৃতাত্ত্বিক গবেষণাই জানিয়ে দিচ্ছে-
     কয়েক লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার একমাত্র মানবজাতি থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছে, বিশ্বব্যাপি আধুনিক মানুষের বিচিত্রতা। তারাই নাকি ছড়িয়ে গিয়েছে আফ্রিকা থেকে আরবে। এশিয়া থেকে ইউরোপে। অষ্ট্রেলিয়া ছাড়িয়ে আমেরিকায়। আর সেটা হয়েছে, চার্লস ডারউইনের সেই বিখ্যাত ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ পদ্ধতিতে। যে পদ্ধতিতে শিম্পাঞ্জি থেকে একদিন নরজাতির আবির্ভাব।
     কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্বের ইতিহাস যদি অতীতের পথে ফিরে যেতে চায়? তাহলে কী হবে তার পরিণতি? চলবে…

দীপিকা ঘোষ । ওহাইয়ো, আমেরিকা