অটোয়া, শুক্রবার ১০ জানুয়ারি, ২০২৫
এই শহরে দিনবদল – বন্যা হোসেন

নোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সজীব হায়দার মায়ের সাথে প্রতিদিন সকালে আয়েশ করে নাশতা করেন। পঞ্চাশ পার হয়েছে কবেই কিন্তু বিয়ে করেননি। মায়ের হাজার অনুরোধেও কর্ণপাত করেননি। ডাক্তার সাহেবের মা রাজিয়া বেগম রানু ছেলের কাছে বসে সকালের এই সময়টায় শোনেন ক্লিনিকে বিভিন্ন রোগীর বিবরণ। কোন জটিল রোগীকে নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করতে পছন্দ করেন ডাক্তার সাহেব। মা-ও মনোযোগী শ্রোতা। 

আজ কথা হচ্ছিল এক নতুন রোগী নিয়ে। গতকালই ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে। সে নাকি খুনের আসামী। নিজের আপন চাচাকে খুন করে মানসিক বৈকল্য ঘটেছে।
কথা বলতে বলতেই ফোন এল ক্লিনিক থেকে। ইসমাইল নামে এই নতুন রোগীটি প্রচুর হাঙ্গামা করছে। হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল ডাঃ সজীব। এসব রোগীরা ভাংচুর করে ক্লিনিকের ক্ষতি তো করেই, কর্মীদেরও মারধোর করে। এদেরকে কঠিন নজরে রাখতে হয়। 
ছেলের কাছে সব শুনে রানুর মায়া হয় এদের জন্য। না জানি এদের পরিবার, পরিজন কি গভীর বেদনায় দিন কাটাচ্ছে। 
তবে আজ কেন যেন ইসমাইল নামটি কানে লেগে রইলো। সে তার চাচাকে খুন করেছে এই সংবাদটি শুনে বহুদিনের পুরনো স্মৃতি জোয়ারের জলের মত ভেসে এলো। 
জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায় যার জন্য তার সন্তান, সংসার সব ছাড়তে হয়েছে তা বিস্মৃত করা কষ্টসাধ্য।

একে একে মনে পড়ে গেল তেজগাঁ এলাকায় ভাড়াবাড়ির সেই জীবন। 

রানুর চাচাশ্বশুর এসেছিল গ্রাম থেকে। দুপুরবেলায় যখন তিনটি ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তার হিমশিম দশা তখন এমন উটকো মেহমান এলে যারপরনাই অস্বস্তি হয়। হাজার হোক, শ্বশুরবাড়ির লোক। আদর যত্ন করতে রানুর আপত্তি নেই, সে বেশ পছন্দও করে লোকজন খাওয়াতে।
বিপদ তো তার অবোধ শিশুগুলো নিয়ে। ছয়, চার আর দুই বছরের তিনটি বাচ্চাকে দুপুরে খাইয়ে ঘুম না পাড়ালে পুরো সন্ধ্যা জ্বালাবে। ওদের বাবা আজিজ সাহেব সন্ধ্যায় বাড়ি এলে বাচ্চাদের চেঁচামেচি করা খুবই অপছন্দ করে। বেশি জ্বালাতন করলে এক এক সময় লাঠি নিয়ে মারতে শুরু করে...সেদিনই ছয় বছরের সজীবকে পিটিয়ে শার্টের হ্যাঙ্গার ভাঙল।   
এইসব ঝামেলা রানুর ভালো লাগে না। তার বাচ্চারা দুষ্টু, চঞ্চল কিন্তু তাই বলে গায়ে হাত দিয়ে পিটানো, হ্যাঙ্গার ভাঙা বা স্যান্ডেল মারা এসব তার সহ্য হয় না। এত নির্মম কি করে হয় মানুষ নিজের বাচ্চার প্রতি সে ভেবে পায় না। 

তাড়াহুড়ো করে হাঁড়িতে পানি দিয়ে রাখা জিয়ল কই মাছ কেটে বসিয়ে দিল কড়াইয়ে তেল দিয়ে। ভাত যা আছে তা দিয়েই হয়ে যাবে...বাচ্চারা ওদের দাদার কাছে গ্রামের গল্প শুনছে হাঁ করে। 

সজীব বায়না ধরে, দাদা আমি যাব তোমার সাথে। আম্মা আমি যাব দাদার সাথে। আমার জিনিস ব্যাগে নিয়ে যাই? 
গ্রামের যাওয়ার উৎসাহ আর উত্তেজনায় ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে গেছে। রানু হাসে।  

চাচা খুব প্রশংসা  করেন রানুর। ঢাকা শহরে আড়াই রুমের  ভাড়াবাড়িতে তিনটা বাচ্চা নিয়ে এত সুন্দর করে সংসার সামলাচ্ছে বলে দোয়াও করলেন। রানু ধনী পরিবারের মেয়ে। তার পরিবার চাটগাঁ থেকে। তার বাবা ব্যবসায়ী বলেই হয়তোবা মেয়েকে সরকারী চাকুরের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আজিজ তার  পরিবারের  প্রথম ব্যক্তি যে ঢাকায় এসেছে চাকরি নিয়ে। গরীব না হলেও আজিজের বিশাল যৌথ পরিবারে তাকে সাহায্য করতে হয় প্রতি মাসে। 

রানু শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের পর ঢাকায় এসে একটি স্কুলে চাকরিও পেয়েছিল। পরপর বাচ্চা হওয়াতে সেই চাকরি ছেড়ে দিতে হল। অবশ্য আজিজের যে মেজাজ তাতে তার চাকরি না ছেড়ে উপায় ছিল না।

পরদিন রানুর চাচাশ্বশুর গ্রামে ফিরে গেলেন। দেশের টালমাটাল অবস্থা তখনই শুরু হল। রাত থেকেই আজিজের মুখ গম্ভীর ছিল কোন কারণে। রানু সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দেশের খবর কিছু রাখে না তা নয়। চারদিকে কেমন একটা থমথমে পরিস্থিতি। 

গতকাল সন্ধ্যায় বড় বড় নেতারা প্রেসিডেন্ট হাউজে লেঃ জেনারেল পীরজাদা, জাস্টিস কর্ণেলিয়াস, কর্ণেল হাসান এবং এম এম আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন বলেছেন, চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। এখন  প্রেসিডেন্টের ঘোষণা বাকি। পুরো দেশ জুড়েই কি যেন একটা হতে চলেছে ! 

কে যেন খবর নিয়ে এলো  অনেকে  আজ রাতে ঘর থেকে অন্যত্র সরে পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

রাত হতেই আজিজ পাশের বাসার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে চললো এক বন্ধুর আত্মীয় বাড়ি। পিছন পিছন রানু। কোলে ছোট শিশু কাজল। হাতে ব্যাগ। ব্যাগটি ধরে হাঁটছে ছোট পুত্র মুরাদ। মুরাদের হাত ধরে আছে সজীব। আজিজ এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা...মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে বিরক্ত হয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ  সামলাচ্ছে।  

রানু অসহায়ের মত তাকায় বাচ্চাদের দিকে। এত ছোট বাচ্চাগুলি এই রাতে বিছানায় থাকার কথা অথচ তাদের পালাতে হচ্ছে নিজ ঘরের আশ্রয় ছেড়ে। আজিজ শুধু মেজাজই দেখায় ...একটা বাচ্চাকেও দেখে না। সজীব, মুরাদের হাত ধরে হাঁটতে পারে...তা না। দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও আতংক হচ্ছে আজ।

তাদের পাশাপাশি আরও দুটি পরিবারও একই গন্তব্যে যাচ্ছে। তেজগাঁ এলাকা থেকে কোন দিকে যাচ্ছে রানুর ধারণা নেই। সে ঢাকা শহর বেশি চেনে না। আর এই রাতের অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারে না। তবে পথে আরও কিছু মানুষকে দেখা গেল উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে। সবাই ফিসফিস করে আজ রাতে আক্রমণের সম্ভাবনার কথাই বলছে। 

বেশ নিরিবিলি এক রাস্তায় ঝোপঝাড়ে ঘেরা এক বাড়িতে এসে পৌঁছালো তারা। সারারাত কেটে গেল আতংক আর আশংকায়। গুলি আর কামানের শব্দে কেউ দুদন্ড কথা বলতেও পারেনি। সবাই মেঝেতে শুয়েছিল। কেউ খাটের নিচে, কেউ টেবিলের নিচে। পর পর দু’রাত সে বাড়িতেই কাটিয়ে দিল তারা। 

সাতাশে মার্চ সকালে ফিরে এলো নিজ ঘরে। আজিজ বাচ্চাদের সহ রানুকে চাটগাঁয়  পাঠিয়ে দিতে চায়। সে নিজে সরকারি চাকুরে, তাই ঢাকা ছাড়তে ভয় পায়। 

রানুর অতশত ভাববার সময় নেই। সে ঘরে ফিরে বাচ্চাদের গোসল করানো, খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাদিন কেটে গেল ঘরদোর গোছাতেই। অনেকেই ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিজেদের গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে বা কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। হেঁটে, নৌকায়, গাড়িতে, লঞ্চে যে যেভাবে পারে সরে পড়ছে রাজধানী থেকে।   

চারদিক থেকে সংবাদ আসে কে কোথায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে। ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত দিন আর নির্ঘুম রাত। 

আজিজ অবশ্য এসব রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তার স্বাধীন দেশের জন্য কোন স্বপ্ন নাই। মুক্তিসেনাদের সে উপহাস করে। রেডিওতে মুক্তি সেনাদের সাহসিকতার  বর্ণনা শুনে সে গালিগালাজ করে, নিষ্ফল আক্রোশে ফেটে পড়ে। সেসময় তার সামনে বাচ্চারা কেউ থাকলে তাদের উপর দিয়েই যায় তার অক্ষম রাগের বহিঃপ্রকাশ।  

রানুর আর চাটগাঁ ফেরা হয় না। দেখতে দেখতে অক্টোবর মাস চলে আসে। বাতাসে প্রায়ই বারুদ পোড়া গন্ধ ভেসে আসে। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা নানা  রোমহর্ষক সাফল্য ঘটিয়ে চলেছে। পাক আর্মি পাগলা কুকুরের মত একেক এলাকায় গিয়ে মানুষের উপর অত্যাচার করে। এলোপাতাড়ি গুলিতে নির্দ্বিধায় মানুষ মারে। মেয়ে-বউদের ধরে নিয়ে যায়। 

তারা রাতেও আলো জ্বালায় না। বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়। 
রানুর কাছে পাশের বাসার ভাবীর ভাই এক পড়ন্ত বিকেলে এলো উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে। কিছু খেতে চায়। ভাবী তো অনেক আগেই চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। 

সাব্বির নামে এই কুড়ি বছরের তরুণ পালিয়ে মুক্তিসেনাদের দলে যোগ দিয়ে ঢাকা এসেছে। ছেলেটাকে দেখে এত মায়া হল...ওর জন্য গরম ভাত করে দিল। ভাতে আলুসেদ্ধ করে আচারের তেল দিয়ে মাখিয়ে নিল। ছেলেটা তাই গোগ্রাসে গিললো। 

যাওয়ার সময় করুণ মুখ করে ক'টা টাকা চাইল। রানুর হাতে আজিজ কখনো টাকা দেয় না। তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কিছু টাকা লুকানো আছে শাড়ির ভাঁজে। বাচ্চাদের প্রয়োজনে সে মাঝে মাঝে খরচ করে আজিজকে লুকিয়ে। সেখান থেকে তিন হাজার টাকা বের করে সাব্বিরের হাতে দিল। এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। বলে, 
---রানু আপা, আমার বোনের সামর্থ্য আছে। কিন্তু দেয় না, দিতে চায় না। আপনি আসলে মুক্তি বাহিনীর সমর্থক...এইজন্য দিলেন টাকাটা। তাই না, আপা? 
---আল্লাহ ভরসা, সাব্বির। 

ঘরে কিছু চাল, ডাল কাপড়ে বেঁধে রাখাই ছিল। মুক্তির ছেলেরা মাঝে মাঝে এসে গোপনে নিয়ে যায় তার কাছ থেকে। 

রানু বেশি ভয় পায় তার স্বামীকে...আজিজ জানতে পারলে ভয়ানক হুলুস্থুল করবে। কিন্তু তার দয়ালু মন আর নতুন দেশ দেখার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে সে সামান্য অংশীদার হতে চায়।

আজিজ যে সম্পুর্ণ অন্য মেরুর বাসিন্দা এবং পাড়ার শান্তি কমিটির সাথে ওঠাবসা করে তা টের পেয়েছে রানু। বাড়ির গেটের বাইরে মাঝে মাঝে শলা পরামর্শ করতে দেখে অদ্ভুতদর্শন আগন্তুকদের সাথে। এরা কে, কিভাবে এদের সাথে পরিচয় হল একদিন কৌতুহলভরে জানতে গিয়েছিল রানু। আজিজ গম্ভীর মুখে জানালো, এরা তার বন্ধু যারা দেশের জন্য কাজ করছে। কিন্তু আজিজের কথাবার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ফুটে ওঠে তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায় সে কাদের সঙ্গে চলাফেরা করে।

দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস চলে এলো। ভারতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীরা অনুষ্ঠান করে চাঁদা তুলে টাকা পাঠাচ্ছে মুক্তি ফৌজের জন্য। রানু দিনের বেলায় চুপি চুপি রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান আর গান শোনে। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র শুনলেই গা গরম হয়ে ওঠে। সারাদিন ধরে সে গায়, "ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা"। ছেলেমেয়েরাও শিখেছে মায়ের কাছে।

রানু বুঝতে পারে বিজয়ের দিন সন্নিকটে, আর ক”টা দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা। 

সেদিন সন্ধ্যায় আজিজও বাসায় ছিল। রানুর মেয়ে দু'বছরের কাজলের জ্বর এসেছে। মেয়েটা ঘ্যান ঘ্যান করছে। ছেলে দুটাকে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসায়। আজিজ ভিতরের ঘরে বিছানায় শুয়েছিল...এই ভরসন্ধ্যায় কেন শুয়েছিল তা আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। 

বাইরের ঘরের দরজায় ঠক ঠক শব্দ হল। সেদিন মনটা খুব ভাল ছিল রানুর। মুক্তিসেনাদের একজন এসেছিল কাকডাকা ভোরে। আজিজ টের পায়নি। কিছু খাবারের পোটলা নিয়ে গেল আর একটা কাপড়ে মোড়া ব্যাগ রেখে গেল। 
এইসব জিনিস রাখার জন্য রানু রান্নাঘরের পিছনের উঠোনে গর্ত করেছে। মাটি চাপা থাকুক আপাতত মুক্তি সেনাদের সাক্ষী প্রমাণগুলো। সময়মত বের করলেই হবে।

দরজায় ঠক ঠক শুনেই সজীব এগিয়ে যাচ্ছিল। রানু ভিতরের ঘরে স্বামীকে খবর দেয়। আজিজ বলে, 
--বশির ভাই আসার কথা। দরজা খুলে দাও, আমি আসছি। 
বশির ভাইকে রানু আগে থেকেই চেনে, তাই নিশ্চিন্তে দরজা খুলতে গেল। সজীবও উঠে গেল মায়ের পিছু পিছু। 
এরপর কি হয়েছিল সে আর বলতে পারে না। 

ফিরে এলো দুদিন পর ১৫ তারিখ রাতে। সজীবও তার সঙ্গে ছিল। কি করে সজীব সেদিন তার সঙ্গে চলে গিয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেনি। দরজায় বশির ভাই ছিল না। ছিল ইসমাইল নামে্র এক সুদর্শন যুবক। ছেলেটা এত সুন্দর করে রানু আপা বলে ডাকল সে ধরেই নিয়েছিল মুক্তির ছেলেই হবে নিশ্চয়। আজিজের পরিচিতরা সবাই তাকে ভাবী ডাকে।

ইসমাইল বলে, আপা একটু কথা ছিল। একটু আড়ালে আসতেন যদি। রানু কোন কিছু বিবেচনা না করেই বেরিয়ে যায়। গেটের কাছে পৌছবার আগেই তার মুখচোখ বেঁধে ফেলে কেউ। টেনে হেঁচড়ে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। তার শুধু মনে আছে সজীবের গলায় ভয়ার্ত আর্তনাদ, আম্মা। আম্মা...কই যাও? আম্মাগো...।

বেশি দূরে নিয়ে যায়নি। মাত্র পাঁচমিনিট দূরে একটি জায়গায় গাড়ি থামায় ওরা। রানুকে আবার টেনে  হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যায় ভিতরে। ওরা যখন  তাকে চড়, থাপ্পড় আর লাথি দিচ্ছিল রানু কাঁদেনি। ইসমাইলের সঙ্গে আর একটি ছেলেও ছিল যে গাড়ির চালক। দুজনেই  অকথ্য প্রহার করলো। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো কেউ। রানু নতমুখে মেঝেতে পড়ে ছটফট করছিল আর গোঙ্গাচ্ছিল। 

লোকটা বললো, “ ইসমাইল, ভিতরের ঘরে দিয়ে আয় এই হারামজাদীকে”। গলা শুনে রানু স্তম্ভিত। 

দুদিন ধরে বশির আর তার চেলা চামুন্ডারা একের পর এক নির্যাতন করে গেছে। তার কাপড়গুলো ওরা সরিয়ে  রাখায় গলায় ফাঁস দেয়াও সম্ভব হয়নি।
কি করে সজীব গাড়ির পিছু নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ওই বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল তা এক রহস্য! বশিরের চ্যালারা টের পেয়ে ছোট্ট সজীবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। ১৫ তারিখ সকালে কি যেন হুটোপাটি লেগে গেল...ছোটাছুটি করে কেউ এলো, গেলো। রানু শুধু শব্দ শুনছিল। 
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার আগে রানুর কাপড়গুলি রেখে যায়। তাদের মা, ছেলেকে জানে মারেনি এই রক্ষা।

সজীবকে উদ্ধার করে মা ছেলে কান্নায় ভেংগে পড়ে। তবে তার আগে পালাতে হবে। আবার যদি কেউ এসে পড়ে।  
বাড়ি না ফিরলেই  ভালো ছিল। সেদিন কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রানু শুধু ঘুমাল তিন সন্তানকে জড়িয়ে। পরদিন দেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে সবাই উত্তেজিত ছিল।
 কিন্তু সেই একটি দিনই কেবল তাকে রেহাই দিয়েছিল এই সমাজ।

ঝড়ের মত কালো মেঘ ধেয়ে এলো রানুর সংসারে। এক মুহূর্তের সাইক্লোনে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাদের সবাইকে। শুধু অমাবস্যার অমানিশা...জোছনার আলো রানুর জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে।

নতুন দেশে নতুন দিন গড়ার শপথ নিয়েছিল যারা দৃপ্ত কন্ঠে তারাই আবার রুখে দাঁড়াল রানুর বিরুদ্ধে। রানুর স্বামী আজিজ এর মাঝেই ভোল পালটে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বনে গেল  রাতারাতি।
গ্রাম থেকে চাচাশ্বশুর পুনরায় এলেন। এবং রানুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে গেলেন।

আজিজ স্পষ্টতই জানিয়ে দিল, তার পক্ষে সম্ভব নয় রানুর সঙ্গে সংসার করা। রানু যেন সজীবকেও নিয়ে যায় সঙ্গে...কারণ ওর প্রভাবে বাকি দুজনও অবাধ্য হতে পারে। সজীবের অপরাধ, সে মায়ের শ্লীলতাহানির সাক্ষী। 

ভাগ্যিস, সজীবকে নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় জুটেছিল। মুরাদ আর কাজলকে আর কখনো দেখতে দেয়া হয়নি। ওরা এখন বিদেশে থাকে। মায়ের সাথে যোগাযোগ হলেও পুনরায় সেই সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সারা জীবন কত বিষ ঢালা হয়েছে ওদের মনে ! সেই বিষের রেশ কাটানো কি এত সহজ ! আজিজ আবার সংসার পেতে হয়তোবা সুখের সন্ধান পেয়েছে। 

********

আজ এত বছর পর নাশতার টেবিলে বসে সব মনে করলেন রানু। এখন আর কান্না পায় না। এতগুলো বছর চরম এক অপমান নিয়ে বেঁচে আছেন...চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। 

বিনা অপরাধে সংসার আর সমাজ তাঁকে যে শাস্তি দিল এইজন্য কার কাছে বিচার চাইবেন? দেশের জন্য ভালোবাসা, মুক্তিসেনাদের প্রতি মমতা আর সহানুভূতিই তাঁকে সমাজের কাছে দোষী করেছে। 

এ কোন সমাজ ? তাঁর  মত লাঞ্ছিতা আর নির্যাতিতা নারীদের নাম দিয়েছে বীরাঙ্গনা। কিন্তু বীরের কোন সম্মান নেই, এইসব নারীদের মূল্য হল আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া আবর্জনার মত। শৌর্য, বীর্য প্রদর্শন করে এঁরা আত্মাহুতি দিলেই সমাজ হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত।  

ক্লিনিকে ফোন করে রিসেপশনিস্ট মেয়েটির কাছে ইসমাইলের পুরো নাম জেনে নিলেন রানু। ইসমাইল মোহাম্মদ। বশির মোহাম্মদ চাচার নাম...স্পষ্ট মনে আছে। চাচাকে খুন করে আজ সে উন্মাদ।

 সমাজ, রাষ্ট্র এই ঘৃণ্য পিশাচগুলির বিচার করেনি। প্রকৃতির অভিশাপে এই পাপীদের শাস্তি হল তাঁরই জীবদ্দশায়, এইটুকুই সান্ত্বনা।

পাপীর শাস্তি হয় না কে বলে! ৪৮ বছর পরেই নাহয় হল…! 

 বন্যা হোসেন । অটোয়া, কানাডা